ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এই শহরকে চেনা শুরু বাবা-মায়ের হাত ধরেই : পৌলমী

প্রকাশিত: ২০:১৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এই শহরকে চেনা শুরু বাবা-মায়ের হাত ধরেই : পৌলমী

অনলাইন ডেস্ক ॥ ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে, শীতকাল। বাপি আমাকে আর দাদাকে সোয়েটারে, টুপিতে, গরম মোজাতে প্রায় মুড়িয়ে ফেলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তখন আমার বয়স প্রায় দু’বছর। প্রথম ট্রামটা ধরে ময়দানের পাশ দিয়ে প্রায় সারা শহর ঘুরিয়ে নিয়ে আসত। ট্রাম-এর টুং টুং শব্দ এখনও কানে ভাসে। সেই আমার কলকাতা চেনা শুরু, এই শহরের সম্পর্কে মুগ্ধতা শুরু। আমার কলকাতার সঙ্গে এক নিবিড় প্রেমের শুরু। কলকাতা চেনা বা কলকাতা সম্পর্কে পরিচিত হওয়ার অনেকটাই আমার বাবা মায়ের হাত ধরে। বাপি, মা আমাদের অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে— যেমন উত্তর কলকাতা। উত্তর কলকাতার কফি হাউসে বাপি নিয়মিত আড্ডা মারতে যেত। এই কফি হাউসের আড্ডা, কলেজস্ট্রিটের বইপাড়া, বাপির নর্থ সিটি কলেজ, মার স্কটিশচার্চ কলেজ, বাপিদের মির্জাপুর স্ট্রিটের বাড়ি, উত্তর কলকাতার সমস্ত অলিগলি, পুরনো দিনের বনেদি বাড়ি এই সব কিছুর ওপর আমি একটা আলাদা আকর্ষণ বোধ করি। যখন সময় পাই আমি এখনও মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে কুমোরটুলির পাশ দিয়ে গিয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি। বাপি আর মা আমাকে ছোট থেকেই অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখানো এবং রবীন্দ্রসদন ও কলামন্দিরে নানান দেশি ও বিদেশি অনুষ্ঠান দেখতে নিয়ে যেত। অ্যাকাডেমি ও বিড়লা অ্যাকাডেমিতে স্কাল্পচার এবং পেন্টিং-এর প্রদর্শনীতে নিয়ে যেত, মনে আছে রঁদা-র প্রদর্শনী। শীতকালে পার্ক সার্কাসে সার্কাস দেখতে নিয়ে যেত। এইভাবেই ছোটবেলা থেকে কলকাতা শহরের ইউনিক কালচারাল ইথস আমাকে ভয়ঙ্কর রকম ভাবে আচ্ছন্ন করে থাকে। কলকাতাকে ভালবাসার একটা স্মৃতি আমার মনের মধ্যে এখনও সজীব সতেজ হয়ে আছে। ছেলেবেলায় আমি যখন আমার গুরু কলামণ্ডলম থাঙ্কমণি কুট্টির নাচের ক্লাসে যেতাম, ক্লাসের পর মা আমাকে নিতে আসত। শুধু ছেলেবেলা কেন, অনেক বড় অবধি আমি আর মা সেই ভীষণ মায়াময় বিকেলগুলোয় হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম বা আমার মাসির বাড়ি যেতাম। কখনও আবার আমার বাপি আর মায়ের বন্ধুদের বাড়িতে যেতাম। সেই সূর্য ডোবার অদ্ভুত মোহময়ী আলোয় শহরটাকে মনে হত যেন এক স্বপ্নরাজ্য। যেখানে মা আর আমি পরম বন্ধুতায় সেই স্বপ্নরাজ্যে যেন ভেসে বেড়াতাম। আমার মনখারাপ হলেই বাপি আমাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যেত গঙ্গার ধারে। যেখানে আমরা ভুট্টা খেতাম, অনেক কথা বলতাম, গঙ্গার পারে বসে বসে সূর্য ডুবছে দেখতাম, একটার পর একটা নৌকা যাচ্ছে, একটার পর একটা স্টিমার চলে যাচ্ছে এক ফেরি ঘাট ছেড়ে অন্য ফেরি ঘাটে। আস্তে আস্তে গঙ্গার ওপর সূর্যটা ডুবে যেত, আর আমি মন ভাল করে বাপির সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসতাম। কলকাতা মানে ঢাকুরিয়া লেক, সেই লেক আর লেকের ধারের রাস্তা তখন এত বড় রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিল না। আমরা প্রথমে সাদার্ন অ্যাভিনিউ তারপর লেক টেম্পল রোডে মেনকা সিনেমার পেছনে থাকতাম। ভোরবেলা আর বিকেলে লেকের ধারে সাইকেল চালানো, খেলতে যাওয়া এইসবের স্মৃতি আজও আমার মনে আনন্দের খোরাক জোগায়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে যে ভাবে উঁচু উঁচু রেলিং দিয়ে লেক এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো ঘিরে দিয়েছে তা দেখে খুব খারাপ লাগছে। আমার মন, চোখ সব যেন আটকে যাচ্ছে। রেলিংগুলো এক ঝটকায় আমাদের যেন দূরে সরিয়ে দিল! কলকাতা মানে ফুচকা, চুরমুর, আলুকাবলি, রোল, ঘুগনি পাউরুটি, চাউমিন, ডিম টোস্ট, ঘটিগরম, মোমো, ইডলি, ধোসা, বড়া, ছোলাবটরা, বিরিয়ানি। পর্ক সসেজ, বেকন সালামি হ্যাম – নিউমার্কেট থেকে এখন কিনে আনি। নিজাম আর অমর শাহ রোডের মোড়ে বিফ কাবাব, ধর্মতলার বিফ-বিরিয়ানি আর হালিম। কলকাতার খাবারের অন্ধ ভক্ত আমি। পার্কস্ট্রিট এর মোকাম্বো আর পিটার ক্যাটও আমার পছন্দের রেস্তোরাঁ। এই কলকাতায় আমরা এখনও যে নিশ্চিন্তে পর্ক আর বিফ খেতে পারি সেটাও কলকাতার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমরা যে পাড়ায় বড় হয়েছি সেখানে কয়েকটা মধ্যবিত্ত পরিবার একসঙ্গে থাকতাম। সেখানে আমার প্রাণের বন্ধু ছিল সুস্মিতা। সাউথ ইণ্ডিয়ান মেয়ে। আমি যেহেতু একটা সাউথ ইণ্ডিয়ান আর্ট ফর্ম নাচতাম, ওরা আমাকে খুব উৎসাহ দিত। আমাদের বাড়ির আশেপাশে গুজরাতি, পঞ্জাবি সব জাতির মানুষ থাকতেন। তাই আমরা সবাই মিলেমিশে হই হই করে দিন কাটাতাম। আমাদের পাশেই এক মারোয়াড়ি পরিবার থাকত, সেখানে আমি টিভি দেখতে যেতাম। আমি মডার্ন হাইস্কুলে পড়েছি, আমি খুব জোর দিয়ে বলছি আমি আজ যা যা হয়েছি তার পেছনে মডার্ন হাইস্কুলের অনেকটা ভূমিকা আছে। এই স্কুলে কিন্তু শুধু বাঙালি মেয়েরা পড়ত না, এখানে নানা জাতির মেয়েরা পড়তে আসত এবং তাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব এখনও অটুট। মডার্ন হাইস্কুলের শিক্ষিকাদের কাছে যা শিখেছি তা আজও আমি মেনে চলি। আমার থিয়েটারের শুরুও মডার্ন হাইস্কুল থেকে। স্কুলেই প্রথম শেক্সপিয়র-এর নাটক করি সুদর্শনা বাগচীর নির্দেশনায়। তারপর শাজাহান করি, সেখানে আমি ঔরঙ্গজেব হয়েছিলাম। ‘তাসের দেশ’ও স্কুলেই প্রথম করি। পুজোর নবরাত্রির সময় আমি এক গুজরাতি বন্ধুর বাড়ি চলে যেতাম এবং গারবা নাচ নাচতাম। এক দিকে পুজোর ঢাক বাজছে আর এক দিকে আমরা সারা রাত গারবা নাচছি। এই যে ‘ইউনিটি অ্যান্ড ডাইভারসিটি’ এই চরিত্রটা আমার মনে হয় কলকাতায় সব থেকে ভাল দেখা যায়। কলকাতা মানেই বৃষ্টি হলে ট্রাফিক জাম, এটা ছোটবেলা থেকেই দেখছি, যা এখনও ঠিক করা গেল না। কলকাতার একটা দিক আমায় ইদানিং খুব ভাবায়। এই যে পুকুর, জলাশয় সব বুজে বড় বড় বাড়ি উঠছে, এই যে সবুজ কমে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে এর ভয়ঙ্কর এক প্রভাব আমাদের ওপর পড়বেই, তখন আমরা কী করব? আর একটা জিনিস। কলকাতার যে সহিষ্ণুতা আগে ছিল তা আজকাল যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক কালে মেয়েরা তাদের পোশাক নির্বাচন এবং ব্যক্তিগত পছন্দের জন্য খুবই আক্রান্ত হচ্ছে। এটা কিন্তু আমার শহরের এক নতুন, অচেনা ও ভয়ঙ্কর মুখ, যা আমাকে ভাবাচ্ছে। এই শহর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে, এই শহরই আমার প্রাণশক্তি, এই শহর আমার প্রেরণা। কলকাতার এই উষ্ণতা যেন সবসময় আমায় ছুঁয়ে থাকে। কলকাতা যেন আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে সবসময়। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×