ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

অভিমত ॥ সন্ত্রাসই জঙ্গীর ধর্ম

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অভিমত ॥ সন্ত্রাসই জঙ্গীর ধর্ম

মানুষের ভাবনার জায়গাটা যেন ছোট হয়ে আসছে। সবাই ভাবছে, তবে ভাবনার পেছনের ভাবনাগুলো ভাববার সময় কারও নেই। যেমন ধরুন- বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জঙ্গীবাদ। বিভিন্নজন নানা ধরনের জটিল চিন্তার মাধ্যমে জঙ্গীবাদ নির্মূলের সমাধানের পথ খুঁজছে। বিষয়টিকে বাস্তবতার নিরিখে সমাধান করার ক্ষেত্রে এক ধরনের অপূর্ণতা কাজ করছে। গতানুগতিক ভাবনা থেকে বিষয়টিকে অন্যভাবে সমাধানের চিন্তা করা যায়। সম্প্রতি হলি আর্টিজানের বিষয়টি আমরা উদাহরণ হিসেবে আনতে পারি। ধরা যাক, একজন শিক্ষিত তরুণ। এখানে আমি বড় বড় বই পড়ে শিক্ষিত তরুণের কথা বলছি। কিন্তু স্বশিক্ষিত তরুণের কথা বলছি না। তরুণটি যদি গতানুগতিক শিক্ষার সঙ্গে স্বশিক্ষিত হতো তাহলে সে জঙ্গীবাদে জড়ানোর আগে অনেক বিষয় চিন্তা করত। মনে করুন, সেই তরুণটির পরিবারে যদি মা, বাবা, ছোট ভাই-বোন থাকে তাহলে বিষয়টি কি হতো? আমরা কিন্তু সেই ভাবনার জায়গাটা তরুণের মধ্যে তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। হলি আর্টিজানে যে জঙ্গীরা মারা গেল তাদের বাবা-মাসহ পরিবার তাদের শনাক্ত করার জন্য এগিয়ে এলো না। বাবা-মায়ের যারা আদরের দুলাল ছিল তাদের লাশও তারা গ্রহণ করল না। কবর দেয়ার সময়ও তাদের দেখা মিলল না। এটি গেল ঘটনার একটি দিক। ঘটনার আরেকটি দিক আছে। আর সেই দিকটির কথা যদি আমরা তরুণদের মানসপটে ধারণ করাতে পারি তবে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এখন বাংলাদেশে সব মানুষের কাছে জঙ্গীবাদী পরিবারগুলোর পরিচয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন তাদের অবস্থা কি হয়েছে তা যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তবে দেখব জঙ্গী তরুণটির বোনদের বিয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ এমন কি কেউ আছে যে জঙ্গীর বোনের সঙ্গে বা তার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে যাবে? বোন গুণবতী-রূপবতী হলেও সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবে। তার মানে বোন যে আগামীতে সোনার সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল তা আর কখনও বাস্তবতায় রূপ নেবে না। ছোট ভাই হয়ত বড় সরকারী চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিল। কিন্তু কোন সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান উচ্চমানের শিক্ষিত হলেও জঙ্গীর ওই ভাইকে চাকরি দেবে না। বাস্তবতা বলছে তারা চাকরি থেকে বঞ্চিত হবে। সমাজে বাস করতে হলে পাড়া-প্রতিবেশীসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজনরা কি জঙ্গী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারবে? বাস্তবতা হলো পারবে না। ধরে নিলাম ওই পরিবারের সবাই নির্দোষ। তারপরও তারা যখন রাস্তা-ঘাটে প্রয়োজনের তাগিদে চলাফেরা করবে সবাই তাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে। বিদেশে ভাই-বোনরা হয়ত উচ্চশিক্ষার চিন্তা করেছিল। কিন্তু বাইরের দেশগুলো কি জঙ্গীর ভাইবোনদের বিদেশে প্রবেশের সুযোগ দেবে? কঠিন সত্য হলো দেবে না। আর ওই পরিবারটিও কি মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচতে পারবে? পারবে না। তার মানে ওই তথাকথিত শিক্ষিত তরুণটি বিভ্রান্তির জালে জড়িয়ে তার পরিবারের বিপর্যয়ের কথা একবারও ভাবেনি। যদি একবারও ভাবত তবে সে কখনই নিজেকে জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করত না। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তার মানে কি হলোÑ সে নিজেকেও শেষ করল আর পরিবারকে অতল সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেল। কাজেই সমাজে সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের এই বিষয়গুলো তরুণদের বোঝানোর দায়িত্ব নিতে হবে। কেননা কোন ধর্মই সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদের কথা বলে না। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেনÑ তাদের কোন ধর্ম নেই, সন্ত্রাসই তাদের ধর্ম। ২. একটা বিষয় না বললেই নয়। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও সেই দেশের জনগণকে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তেমন একটা সচেতন হতে দেখা যায়নি। কিন্তু আবহমান সংস্কৃতিতে লালিত বাংলাদেশের সকল মানুষ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তা আসলেই আমাদের গৌরবের একটি বিষয়। কেননা, বাঙালী কখনও উগ্রতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং দেবে না। আমাদের সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু অবাকই হননি, তাদের মধ্যে নিরাশা তৈরি হয়েছে। এটাই আমাদের অর্জন। ৩. জঙ্গীবাদীরা বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে হত্যা করেছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন ধর্ম ছিল না। তবে একটি ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। একটি শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন নিষ্পাপ শিশুটির জানার কথা নয় সে কোন্ ধর্মের পরিবারে জন্মগ্রহণ করল। সবকিছুই নির্ধারণ করে রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিকর্তা যা কিছু করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন। সব ধর্মের মানুষ এই কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। ফলে বাপ-দাদার যে ধর্ম সেই ধর্মে লালিত-পালিত হয়ে একটি শিশু একজন মানুষে পরিণত হয়। তাহলে জঙ্গীবাদীরা যখন একটি ধর্মের মিথ্যা লেবাস পরে অন্য ধর্মের মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে তা অধর্মের পর্যায়ে পড়ে যায়। আবার তাদের মধ্যেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব। ফলে যে ধর্মের কথা বলে তারা আক্রমণ করেছে সেই ধর্মে বিশ্বাসী মানুষও তাদের থেকে রেহাই পায়নি। এজন্য বঙ্গবন্ধুর একটি কথাকে আমরা ধারণ করতে পারি। তিনি বলেছিলেনÑ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। প্রত্যেক মানুষ তার নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। অর্থাৎ প্রকৃত ধর্মপরায়ণ হবে। আর ধর্মপরায়ণ মানুষের কাছে সকল মানুষই সুরক্ষিত। লেখক : রেজিস্ট্রার ও বিভাগীয় প্রধান ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), গাজীপুর
×