ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অতীত থেকে শক্তি সঞ্চয় করে সামনে এগোতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ৩০ জুলাই ২০১৬

অতীত থেকে শক্তি সঞ্চয় করে সামনে এগোতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অতীতকে স্মরণে রেখেই তা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে হবে। বৃহস্পতিবার রাতে শের-ই-বাংলানগরে পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে বাংলাদেশ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী একাত্তরে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বে তৎকালীন পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘আমি স্বাধীনতার আগের বাঙালীদের অবস্থান তুলে ধরতে চাই। আমি এটা বার বারই প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, তার কারণ এই বৈষম্যের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অতীত স্মরণে রাখতে হবে, এটাই আমাদের ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি যোগাবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা এনে দেন। এটা কিন্তু একদিনে আসেনি। ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যদিয়ে বিজয় অর্জনের মাধ্যমেই এই স্বাধীনতা আসে। তিনি বলেন, কিন্তু আজ অনেকেই ভুলে যান তখন (স্বাধীনতার পূর্বে) বাঙালীদের কি অবস্থা ছিল, বাঙালীরা কোন অবস্থানে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময়ে বাঙালীরা চরম শোষিত, নিগৃহীত এবং বঞ্চিত ছিল। খাদ্য, পরনের কাপড়, চিকিৎসা, শিক্ষা- সব কিছুর অভাব ছিল। তিনি বলেন, মায়ের কোলে অভুক্ত শিশুর মৃত্যু, দিনের পর দিন না খেতে পারা অভুক্ত মানুষ, কোন আশ্রয় নেই, ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে দেশের মানুষ জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছিল। শেখ হাসিনা বলেন, এই অভুক্ত মানুষগুলোর অধিকারের কথা বলাতেই বঙ্গবন্ধুকে সে সময় বারংবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, জাতির পিতা ভাষণ দিলেই মামলা, জেল-জুলুম-নির্যাতন। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু তাঁর অবস্থান থেকে এতটুকু টলেননি। বরং তিনি তাঁর নীতির প্রতি অবিচল থেকেই মানুষের অধিকার আদায়ে লড়াই করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন ১২শ’ মাইলের দূরত্বে পাকিস্তানের দু’টি প্রদেশের একটি ছিল পূর্ববাংলা এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। আমরা সংখ্যার দিক দিয়ে যেমন বেশি ছিলাম, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও পূর্ববাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে ছিল। শেখ হাসিনা বলেন, যখন আমরা বাঙালীদের আজকের অবস্থান দেখি, দেখি তারা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছেন, কিন্তু পাকিস্তানীরা একটু খর্বকায় এবং হালকা-পাতলা বলে বাঙালীদের পাত্তাই দিত না, বাঙালীরা দেশ চালিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে এটা তারা মানতেই চাইত না। তিনি বলেন, যে পাকিস্তানীরা আমাদের অবহেলা করত তাদের কাছেই পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। বাঙালী দেখিয়ে দেয় যে, আমরাও পারি। জাতিরজনক যে বলেছিলেন, বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না, তারা পারেনি। প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, পাকিস্তানের মোটসংখ্যার শতকরা ৫৬ শতাংশ পূর্ববাংলার হলেও এবং বাঙালীরা অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও পাকিস্তানীরা সে সময় সেই টাকাতেই করাচি, রাওয়ালপি-ি এবং ইসলামাবাদে তিন তিনবার রাজধানী স্থানান্তর করে। শেখ হাসিনা বলেন, পূর্ববাংলার মানুষের উন্নয়নে পাকিস্তানীরা একটি কদমও আগে বাড়ায়নি। সে সময় পূর্ব বাংলায় পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কথা হলেও শুধু জায়গা চিহ্নিত করা ছাড়া আর কাজ এগোয়নি। উপরন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে পরে সেই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। যাই হোক, আল্লাহর রহমতে আমরা এতদিনে ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় কর্মক্ষেত্রে পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত বৈষম্যের যে চিত্র উপস্থাপিত হয় তা প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে তুলে আনেন। পাকিস্তান সরকারে সচিবদের পদ ছিল ২২। যার সবক’টির পদাধিকারী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা। যুগ্ম-সচিব পদে পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৪২ এবং বাঙালীদের ৮। উপ-সচিব ৬৯টি পদে আসীন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীরা, অন্যদিকে ২৩ ছিলেন বাঙালী। সেকশন অফিসার- পশ্চিম পাকিস্তানীরা ছিল ৩২৫ আর বাঙালীরা ৫০। প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার-পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৩ হাজার ৭৬৯ এবং বাঙালী ৮১১। সিনিয়র গেজেটেড অফিসার-পশ্চিম পাকিস্তানী ৬৯২ আর বাঙালী ৪২। ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে- পশ্চিম পাকিস্তানী ১৬২ আর বাঙালী ৩। রেডিওতে- পশ্চিম পাকিস্তানী ৯৮ আর বাঙালী ১৪। সাপ্লাই এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিভিশন- পশ্চিম পাকিস্তানী ১৬৪ আর বাঙালী ১৫। রেলওয়েতে- পশ্চিম পাকিস্তানী ১৫৮ আর বাঙালী কর্মকর্তা ৫০। ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগে- পশ্চিম পাকিস্তানী ২৭১ আর বাঙালী ৫০। এগ্রিকালচার ইকোনমি কর্পোরেশনে- পশ্চিম পাকিস্তানী ৩৮ আর বাঙালী ১০। বিমানে-পশ্চিম পাকিস্তানী ১ হাজার ৭৫ আর বাঙালী ৭৫। সার্ভে অফিসার পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ৬৪ আর বাঙালী মাত্র ২ কর্মরত ছিলেন। সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও ভয়াবহ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানীদের চোখে বাঙালীরা ছিল, খর্বকায়, হালকা-পাতলা-রুগ্ন এবং সাহসী নয়। শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি জেনারেল পদ, ২০ মেজর জেনারেলের পদ এবং ৩৪ ব্রিগেডিয়ারের পদের সবক’টিতেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা আসীন ছিলেন। কর্নেল পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ছিল ৪৯ এবং বাঙালী মাত্র একজন। লে. কর্নেল পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ১৯৮ আর বাঙালী ২। মেজর পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ৫৯০ আর বাঙালী ছিলেন ১০। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৌবাহিনীর ৬শ’ পদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী ৫৯৩ এবং বাঙালী ছিলেন ৭। অন্যদিকে বিমান বাহিনীর ৬৪০টি পদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ৬শ’ পদে আর বাঙালীরা ৪০ পদে আসীন ছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভয়াবহ বৈষম্য ছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ছিল ৬ আর পূর্ববাংলায় একটি। প্রকৌশল কলেজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৩ আর পূর্ব বাংলায় একটি। বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৪ আর পূর্ববাংলায় দুটি। কলেজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৭৬ আর পূর্ববাংলায় ৫৬। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাইমারী স্কুল ছিল ৬ হাজার ২৪৬ আর পূর্ববাংলায় ২ হাজার ২১৭। হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ১৭ হাজার ৬১৪ আর পূর্ব বাংলায় ৫ হাজার ৫১৫টি। চিকিৎসক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৫ হাজার ৫শ’ আর পূর্ববাংলায় ৩ হাজার ৩৯৩। পশ্চিম পাকিস্তানে মাতৃসদন ছিল ১১৮ আর পূর্ব বাংলায় ২২। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানের সর্বক্ষেত্রে যে এই বৈষম্য তার কিছুটা লাঘব হয়, পাকিস্তানীদের কিছুটা টনক নড়ে ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফা ঘোষণার পরে। তবে, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ‘মার্শাল ল’ জারি করলে অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে যায়।
×