ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাব্বির খান

এপিসোড ॥ গুলশান-২; ‘আড়ালে কে হাসে’

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১৩ জুলাই ২০১৬

এপিসোড ॥ গুলশান-২; ‘আড়ালে কে হাসে’

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঢাকার গুলশান-২ এর জঙ্গী হামলা সারা বিশ্বকেই নাড়া দিয়ে গেছে। এর আগে বছর দেড়েক ধরে বিচ্ছিন্নভাবে ঘটেছে জঙ্গী তৎপরতা। খুন হয়েছে ব্লগারসহ বিভিন পেশাজীবীর মানুষ, বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা। ইতোপূর্বে ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেখেছি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিভিন্ন রায় ঘোষণার পরে দেশজুড়ে হরতাল-অবরোধের নামে দিনের পর দিন দানবীয় হত্যাকা-, বোমাবাজি, তা-ব। খালেদার টানা ৯২ দিনের অবরোধের কথা বোধকরি বাংলাদেশের মানুষ আজও ভুলেনি। মানুষ পুড়িয়ে মারার যেন উৎসব তখন শুরু হয়েছিল। দেখেছি খোলা রাস্তায় পুলিশের মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দেয়া, যাত্রীভর্তি বাসে পেট্রোল ঢেলে মানুষকে কয়লা বানিয়ে ফেলা, চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে বগিকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষ হত্যা, সরকারী, আধাসরকারী ও বেসরকারী অফিস, আদালত, দোকানপাট ভাংচুর করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া। তারও আগে দেখেছি বাংলা ভাইয়ের নৃশংসতা, দেশজুড়ে সন্ত্রাস, একই সঙ্গে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ। এক এক করে সন্ত্রাসবাদের প্রায় সব ধরনই অনুশীলন হতে দেখেছি এই বাংলাদেশে। শেষে যোগ হলো আরও একটি ধরন, যা ১ জুলাই ঘটল রাজধানীর বুকে। এই ঘটনায় শুধু বাংলাদেশ নয়, কাঁপিয়ে দিল সারা বিশ্বকে। দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকজনকে একটা পাবলিক প্লেসে জিম্মি করে একের পর এক হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বরাবরই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গী মৌলবাদের তৎপরতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। এই নীতির প্রয়োগে সরকারের বিবিধ ভুল যে নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু আন্তরিকতার প্রশ্নে আমি এই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই না। এই সরকারকে একই সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে বিভিন্ন ফ্রন্টে। একাধারে দেশকে আধুনিকীকরণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, অর্থনীতির ভিতকে অধিকতর মজবুত করা, ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার কাজগুলো অনুন্নত একটা দেশের সরকারের জন্য কতটা কঠিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাশাপাশি সবচেয়ে কঠিন কাজটি এই সরকার ২০১০ সাল থেকে করে আসছে, তা হলো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। এই বিচার করতে গিয়ে সরকারকে অনেক মাসুল দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং বাধা মোকাবেলা করে সরকারকে এগোতে হচ্ছে। দেশের ভেতরে গড়ে ওঠা একটা সিন্ডিকেট বিভিন্ন পরিচয়ের আড়ালে সরকারের উন্নয়নে শুধু বাধাই দিচ্ছে না, একই সঙ্গে দেশকে ঠেলে দিচ্ছে এক অন্ধকারে। যে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও লিবিয়া। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের এক ও অভিন্ন দর্শন হচ্ছে, ‘ধর্মের নামে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে কোন ধরনের হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাস ইসলামসম্মত।’ মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি জঙ্গী সংগঠন, যার বলয় মিসর পেরিয়ে সারাবিশ্বেই বিস্তৃত। নামে ভিন্নতা থাকলেও আদর্শগত মিলের কারণে বিশ্বের সব জঙ্গী মৌলবাদী দলের সঙ্গেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ক বিদ্যমান। সেই অর্থে জামায়াতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সব ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনের সৌহর্দ্যপূর্ণ যোগাযোগ স্বাভাবিকই শুধু নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা প্রমাণিতও। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াল এমন যে, ব্রাদারহুডের জ্ঞাতিভাই যদি হয় আল কায়েদা, তাহলে বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ যে আল কায়েদার বাংলাদেশী অপারেটর, তা না বোঝার কোন কারণ নেই। অন্যদিকে যেহেতু ব্রাদারহুডের দর্শন এবং ভাবধারা জামায়াত ধারণ ও লালন করে সেহেতু বাংলাদেশের আনসারুল্লাহর পৃষ্ঠপোষক অবশ্যই জামায়াত হতে বাধ্য। অর্থাৎ জামায়াতের সঙ্গে আল কায়েদার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হচ্ছে আদর্শিক। জামায়াত বিশ্বাস করে, ‘ধর্মের নামে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার জন্য যে কোন ধরনের হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাস ইসলামসম্মত’, যা একই সঙ্গে আল কায়েদা, ব্রাদারহুড এবং আনসারুল্লাহও বিশ্বাস করে। ঠিক একইভাবে আল কায়েদার সঙ্গে পথের বিভেদ থাকলেও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক হওয়াতে ইসলামিক স্টেটও (আইএস) ভাড়ায় খাটা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জ্ঞাতিভাই। জামায়াতে ইসলামী কখনও আইএস, কখনও আনসারুল্লাহ, কখনও আল কায়েদা, আবার কখনও জেএমবি নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে থাকে। নামে ভিন্নতা থাকলেও তারা যে জামায়াতেরই কৌশলগত যোদ্ধা, একই আদর্শিক দলের সদস্য এবং একই কমান্ডের অধীনে তারা অখ-, গুলশান-২ এর ঘটনা থেকে তা স্পস্ট বোঝা যায়। ভিন্ন ভিন্ন নামের জন্য জামায়াতকে শুধু ভিন্ন ভিন্ন বিশেষজ্ঞ ব্রিগেড তৈরি করতে হয়েছে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের হত্যার স্টাইল, আচার-আচরণ এবং বিশেষ শব্দের প্রয়োগবিধি রপ্ত করার জন্য। এটা নিশ্চয়ই কোন কঠিন কাজ নয়। আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, জামায়াত তাদের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডের যোদ্ধাদের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ট্রেনিং দেয়ার জন্য দলের খরচে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে থাকে। একাত্তরেও জামায়াতের বিভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন ব্রিগেড ছিল এবং রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তি কমিটি মধ্যে উল্লেখযোগ্য। গুলশানের ঘটনা থেকে জানা যায়, জঙ্গীদের প্রায় সবাই উচ্চবিত্তসম্পন্ন, শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। মাদ্রাসাকেন্দ্রিক যে উগ্রবাদের কথা আমরা এতদিন জানতাম, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় চালিত হওয়া এই জঙ্গীবাদ দেখে বাংলার মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। ’৭৫ পরবর্তীতে বাংলাদেশে একটা নব্য ধনিক শ্রেণী তৈরি হয়েছে। তাদের অর্থের উৎস এবং ক্ষমতার বলয় সম্পর্কে পরিষ্কার কোন ধারণা পাওয়া যায় না। চাকরিতে, ব্যবসায়, রাজনীতিতে, সাহিত্যে, মিডিয়াতে প্রায় সবখানেই এসব নব্য দাড়ি গজানো ধনিক শ্রেণীর উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। এ ছাড়াও খুব সুচিন্তিত ও সূক্ষ্মভাবে এই নব্যদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে সমবণ্টন আকারে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে জামায়াতে ইসলাম। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত জামায়াত ও তার সহযোগী বিএনপির যে তা-ব দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ, তা কোন এক দৈব কারণে ইতোমধ্যেই সবাই ভুলতে বসেছে। ভুলিয়ে দেয়ার এই শৈলীটিও জামায়াতের কূটকৌশলেরই অংশ মাত্র। বর্তমানে বাংলাদেশের কোথাও জামায়াতের কোন কার্যক্রম নেই। এমনকি জামায়াতী নেতাদের ফাঁসিতেও এখন আর হরতাল বা অবরোধ হয় না। কোথাও নেই জামায়াত। যেন হাওয়া থেকে মিলিয়ে গেল একটা মহাপরাক্রমশালী দৈত্য! প্রশ্ন করা যেতে পারে, তাহলে এই আইএস, আল কায়েদা, আনসারুল্লাহ, জেএমবি এলো কোত্থেকে! জামায়াতের অনুকরণে কেন এসব সংগঠন ধারাবাহিকভাবে সেই একই কাজ করে যাচ্ছে, যা জামায়াত-বিএনপি এত বছর ধরে করেছে! এসব কাজের বেনিফিশিয়ারি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি জামায়াত-বিএনপি ছাড়া আর কেউ হতে পারে? এই তো মাত্র সেদিনের কথা, যেদিন জামায়াতের হরতাল, অবরোধ আর হত্যার ভয়ে মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারত না। অথচ জামায়াত-বিএনপির সব অপকর্মই আজ ধামাচাপা পড়ে গেল। ভাসুরের মতো জামায়াতের নাম আজ কেউ মুখে নেয় না। গুলশান-২ এর মতো জামায়াত-বিএনপির হত্যাগুলোও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ছিল। দুইয়ের মাঝে কোন পার্থক্যই করা যাবে না। পার্থক্য এক জায়গাতেই, ইদানীংকার হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির নাম আজ কেউ আর উচ্চারণ করে না। মাত্র বছর দেড়েকের মাথায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একেবারে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেল। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের নামগন্ধও পাওয়া যায় না কোথাও। ওহাবী-খোয়াবী-হেফাজতীরাও আর মঞ্চে নেই। সবাই উধাও! মাঠে প্রবেশ করল বিশ্ব কাঁপানো ভয়ঙ্কর সব রোমান্টিক জঙ্গীবাদের নাম-আনসারুল্লাহ, আল কায়েদা, আইএস, ব্রাদারহুড, জেএমবি, আরও কত কি! জঙ্গীবাদে এক ধরনের হিরোইক স্টাইল আছে, সিনেমার মতো সাসপেন্স আছে, বিভিন্ন চরিত্রের সংমিশ্রণে হাসি-কান্না আছে, ধর্মের সুড়সুড়ি আছে, হিজাব-কিতাবের বয়ান আছে। সবই আছে এই জঙ্গীবাদে! পাশাপাশি হরতাল-অবরোধের রাজনৈতিক হত্যাকা-গুলো খুব সেকেলে। তাতে জঙ্গীদের মতো কিছুই নেই। বাঙালীরা সাসপেন্স পছন্দ করে। হিরোকে ভালবাসে, ভিলেনকে ইচ্ছেমতো বকা দেয়! এর চেয়ে উত্তম খোরাক বাঙালীদের জন্য আর কি হতে পারে। এসব খোরাকের কারণে জামায়াত-বিএনপির ইতোপূর্বে ঘটানো কুকীর্তিগুলো ঢেকে যায়। গুলশান-২ এর ঘটনার পর বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক মিডিয়াগুলো তার সাক্ষী। আমরা যে রোমান্টিক জ্বরে ভোগা একটা জাতি, তা জামায়াতও বোঝে, শুধু আমরাই বুঝি না! বাঙালীদের বড় ভুলো মন। সবাই সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। আইএস, আল কায়েদা, আনসারুল্লাহ, জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর যা কিছু করছে, কোন কিছুর সঙ্গেই জামায়াত বা বিএনপির কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। গুলশান-২ এপিসোডের মঞ্চায়নটা খুব মর্মান্তিক হলেও ‘আড়ালে তার জামায়াত হাসে নাকি অন্য কেউ!’ [email protected]
×