ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

থেমে গেছে চুরি হওয়া রিজার্ভ উদ্ধার প্রক্রিয়া-চূড়ান্ত রিপোর্ট শীঘ্রই

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১২ জুলাই ২০১৬

থেমে গেছে চুরি হওয়া রিজার্ভ উদ্ধার প্রক্রিয়া-চূড়ান্ত রিপোর্ট শীঘ্রই

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়া থেমে গেছে। ইতোমধ্যে চলে গেছে পাঁচটি মাস। গত ৩০ জুনের মধ্যে পুরো অর্থ ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও ফিলিপিন্স এখন এ বিষয়ে কিছুই বলছে না। ঘটনার পর থেকে ফিলিপিন্সের সিনেটে নিয়মিত শুনানি হলেও তা এখন অজানা কারণে বন্ধ। অর্থ উদ্ধারের মতোই রিজার্ভ চুরির মামলার অগ্রগতিও থেমে গেছে। দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সিআইডি, পুলিশ, এফবিআইর তদন্ত চলছে ঢিমেতালে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ম্যানিলা, শ্রীলঙ্কা এমনকি ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষের তদন্ত অনেকটা স্থবির হয়ে আছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), এ্যান্টি মানি লন্ডারিং সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) কোন সংস্থাই জোরালো কার্যক্রম পরিচালনা করছে না দোষীদের চিহ্নিত করতে বা অর্থ উদ্ধারে। এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ কর্মকর্তার নাম এলেও তাদের বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে ‘কয়েকদিনের মধ্যে’ এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে সোমবার জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অন্যদিকে চুরি হওয়া উদ্ধারে আগামী ১৫ জুলাই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম হ্যাক করে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে হ্যাকাররা ৯৫১ মিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা করে। পরে বেশ কিছু পেমেন্ট বন্ধ করে দিয়ে বেশিরভাগ অর্থ চুরি ঠেকানো গেলেও ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপিন্সে স্থানান্তরে সক্ষম হন হ্যাকাররা। ওই অর্থ ফিলিপিন্সের আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার ব্রাঞ্চের চারটি এ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। ঘটনাটি তদন্তে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে মার্কিন গোয়েন্দা এফবিআই। যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম হ্যাক অভ্যন্তরীণভাবেই হয়েছে। আর বাংলাদেশের তদন্তকারীরা এ ঘটনার জন্য আংশিকভাবে সুইফট সিস্টেমকে দায়ী করেছেন। সম্প্রতি এফবিআইও জানিয়েছে, দায়ীদের এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তবে দ্রুত শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলেও জানানো হয়। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে চুরি হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যদিও দায়িদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিধিতে মামলা করার সুপারিশ করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, রিজার্ভ চুরির সঙ্গে যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে এলআরে (লিভ রিজার্ভ) নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। অর্থাৎ ওএসডি করা হতে পারে তাদের। সূত্র জানিয়েছে, উপ-পরিচালক জিএম আবদুল্লাহ ছালেহীনকে আরও দুই কর্মকর্তার সঙ্গে একই আদেশে এ্যাকাউন্টস এ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্ট থেকে কমন সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট ১-এ বদলি করা হয়েছে। এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনার একটি মামলা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। সেটিও অজানা কারণে থমকে আছে। এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মির্জা আবদুল্লাহিল বাকী বলেন, রিজার্ভে চুরির সঙ্গে ৩০ বিদেশী নাগরিককে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের অনেকেই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। সিআইডি প্রযুক্তিগত তদন্ত, এফবিআই ও ইন্টারপোলের সহযোগিতায় তাদের প্রকৃত নাম-ঠিকানা উদ্ধার করেছে। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের আলাদা প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। এদের গ্রেফতারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক পুলিশী সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এদিকে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশের ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ইউএস ডলার চুরির ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে ম্যানহাটানে অবস্থিত ইউএস এ্যাটর্নির অফিস। অর্থ লেনদেনের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সুইফট ব্যবহার করে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত এই অর্থ চুরির ঘটনাটির তদন্ত করছেন নিউইয়র্কের দক্ষিণাংশের জেলার ইউএস এ্যাটর্নি প্রিত ভারারা। বাংলাদেশ ব্যাংকে চুরির প্রেক্ষাপটে গেল মাসে দ্য ফেডারেল রিজার্ভ এবং অন্যান্য আর্থিক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলোকে জালিয়াতি করে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা পর্যালোচনা করতে বলে। সাইবার চুরির উদ্যোগ নেয়ার লক্ষণ খুঁজে বের করতে গত মে মাসে এফবিআইয়ের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এফবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংস্থাটি কয়েকটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত কাজ চালাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের অপরাধটি কে করেছে তা এখনও বের করতে পারেনি। এই চুরির বিষয়ে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ব্যবস্থা নিয়েছে বা তাদের ভূমিকা পর্যালোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি কংগ্রেসনাল কমিটি তদন্ত করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফট কর্তৃপক্ষ বলেছিল অর্থ উদ্ধারে আমাদের সহায়তা দেবে। কিন্তু তারা এর কোন দায় নেবে না। এখন পর্যন্ত তারা কোন ধরনের সহায়তা দিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ফিলিপিন্সের যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছেন। তাদের কাউকেই সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করেনি। শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দিয়েছে। সে দেশের মুদ্রা পাচার আইনেও অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া চীনা ব্যবসায়ী উইলিয়াম গোসহ অন্য সন্দেহভাজনরাও এখন আর পুলিশের পর্যবেক্ষণে নেই বলে জানা গেছে। জানা গেছে, ফিলিপিন্সে নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরির ৮১ মিলিয়ন (আট কোটি ১০ লাখ) ডলার ফেরত দেয়ার আশা করেছিলেন ফিলিপিন্সের সিনেটের প্রেসিডেন্ট র‌্যাল্ফ রেক্টো। গেল ৩০ জুন সাবেক প্রেসিডেন্ট এ্যাকুইনো পদত্যাগ করেছেন। আর ওই সময়ের মধ্যে অর্থ ফেরত দেয়ার কথা জানিয়েছিল দেশটির সিনেট। কিন্তু ৩০ জুনের মধ্যে পুরো অর্থ উদ্ধার তো দূরের কথা এই প্রক্রিয়াই এখন থেমে গেছে। এদিকে ঘটনার প্রথম দিকে ফিলিপিন্সের সংসদে এ বিষয়ে শুনানি হলেও এখন আর এ বিষয়ে দেশটি কোন কথা বলছে না। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার উদ্ধারের সুযোগ ‘খুব কম’ বলে জানিয়েছিল ফিলিপিন্সের তদন্তকারী সিনেট কমিটি ব্লু রিবন। ওই কমিটির সদস্য সের্গিও ওসমেনা শুরু থেকেই জানিয়েছেন, তার সন্দেহ, চুরি যাওয়া অর্থ এর মধ্যেই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জিম্মায় থাকা রিজার্ভ চুরির অর্থের মধ্যে কিম ওংয়ের ৪০ লাখ ৬৩ হাজার মার্কিন ডলার এবং ৮৩ হাজার ডলার বাজেয়াফতকরণ করা হয়েছে। তাই যথাসময়ে পুরো অর্থ উদ্ধার সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে ফিলিপিন্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এবং ফিলিপিন্সের মধ্যে মানি লন্ডারিং চুক্তি নেই। ফলে আন্তর্জাতিক চুক্তি পালেরমো কনভেনশনে উভয় দেশই স্বাক্ষরকারী হওয়ায় এর অধীনে ফিলিপিন্স কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় আইনী সহায়তা দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে ফিলিপিন্সের বিচার বিভাগের (ডিওজে) কাছে সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের পালেরমো কনভেনশন অনুযায়ী, পারস্পরিক আইনী সহায়তার আওতায় বাংলাদেশের এ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে ফিলিপিন্সে। সম্প্রতি পাঠানো এই চিঠিতে বাংলাদেশের পক্ষে ফিলিপিন্সের আদালতে প্রতিনিধিত্বের জন্য দেশটির বিচার বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে। এদিকে রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে আগামী ১৫ জুলাই বৈঠকে বসবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর ও ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান মোহাম্মদ রাজী হাসান আগামী ১৫ জুলাই নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
×