ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে শচীন;###;মোঃ মামুন রশীদ

‘আউট হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছিলাম’

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২২ জুন ২০১৬

‘আউট হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছিলাম’

২১ বছর আইসিসির নিষেধাজ্ঞার পর ঘরের মাঠে প্রথম টেস্ট সিরিজ আয়োজন করে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯২ সালের নবেম্বর। ঐতিহাসিক সেই সফরটা আবার ছিল ভারতের লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকরের প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা সফর। এই সফরে প্রথমবারের মতো থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিষয়টি চালু হয়। প্রস্তুতি ম্যাচের আগে অনুশীলনে ইনজুরিতে পড়েছিলেন শচীন। হাসপাতালে ইনজুরি পরীক্ষা করানোর পর শচীনকে জানানো হয় ৪-৫ সপ্তাহ লাগবে পুরোপুরি সেরে উঠতে! কিন্তু হতাশ হননি শচীন, কারণ তখনও প্রথম টেস্ট মাঠে গড়াতে এক সপ্তাহ বাকি। আর সিরিজের শুরু থেকেই খেলার জন্য মুখিয়ে ছিলেন লিটল মাস্টার। কয়েকদিনের মধ্যেই হাঁটতে শুরু করেন শচীন এবং টিম ম্যানেজমেন্টও চাইছিল তাঁকে যেভাবেই হোক খেলাতে। প্রস্তুতি ম্যাচে ব্যাটিং ভাল করেছিলেন বলেই এমন চেয়েছিলেন তারা। সেক্ষেত্রে প্রথম টেস্টে খেলতে হলে স্লিপে ফিল্ডিং করলে সেটা সম্ভব ছিল। কিন্তু কপিল দেব ছাড়াও দলের অন্য সিনিয়র ক্রিকেটার থাকা সত্ত্বেও তরুণ শচীন সিøপে দাঁড়ানোটাকে খুবই অস্বস্তিকর মনে করছিলেন। তবু শেষ পর্যন্ত তিনি ডারবানে ১৩ নবেম্বর প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন। আর সে ম্যাচেই ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে আউট হন শচীন। তার নাম লিপিবদ্ধ হয় ইতিহাসের পাতায়। এ বিষয়টি আত্মজীবনীমূলক বই ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’-তে লিখেছেন পরবর্তীতে সর্বকালের সর্বাধিক রান সংগ্রাহক হিসেবে এখন পর্যন্ত রেকর্ডধারী শচীন। অনুশীলন ম্যাচগুলোয় দুর্দান্ত খেলেছিলেন বলেই শচীন কিছুটা শারীরিক সমস্যা নিয়েও ডারবানে প্রথম টেস্ট খেলতে নামেন তিনি। ভারত ভালই ব্যাটিং করেছিল এবং ম্যাচটি ড্র হয়। প্রাভিন আমরে তার অভিষেকেই দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শচীন এই ম্যাচেই নিজেকে ইতিহাসের পাতায় নাম তোলেন! দুর্ভাগ্যজনক বলেছেন শচীন, কারণ তিনি দ্রুতই আউট হয়ে গিয়েছিলেন এবং থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে শচীন এই আউটের শিকার হন। সবেমাত্র তখন টিভি রিপ্লের সিস্টেমটা চালু করা হয়েছে। পয়েন্টে বল ঠেলে দিয়েছিলেন শচীন। সেখানে ইতিহাসের সেরা ফিল্ডার জন্টি রোডস ছিলেন। তিনি বলটি এতটাই দ্রুত তুলে উইকেটরক্ষকের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন যে বুঝে উঠতে পারেননি শচীন। গোঁড়ালির ইনজুরিতে তখনও কিছুটা সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি, ঘুরে আবার ক্রিজে ফিরে আসতে কিছুটা সময় লেগেছিল। মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্য তিনি রানআউট হয়ে যান। আম্পায়ার সিরিল মিচেলি ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে থার্ড আম্পায়ারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আর টিভি রিপ্লে দেখে থার্ড আম্পায়ার কার্ল লাইবেনবার্গ শচীনকে রান আউট ঘোষণা করেন। জন্টি মাঠে কতটা তৎপর এবং দক্ষতা সম্পন্ন সেটা এদিনই বুঝেছিলেন শচীন। তার বিরুদ্ধেও খেলাটা ছিল প্রথম। জন্টির এই ফিল্ডিং দক্ষতা পুরো সফরেই পরবর্তীতে ভারতীয় দলকে দারুণ ভুগিয়েছে। জন্টি মূলত ওয়ানডে সিরিজে ছিলেন আরও বেশি দুরন্ত এবং শচীন নিঃসন্দেহে উপলব্ধি করেন তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিল্ডারের বিরুদ্ধে প্রথমবার খেলতে নেমেছেন। জন্টি এতটাই দ্রুত যে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে যেসব এক রান হওয়ার কথা সেসবও নিতে পারেনি ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। তিনি একাধারে সামলেছেন পয়েন্ট, কাভার পয়েন্ট এবং থার্ডম্যান। জন্টি ফিল্ডিংয়ে থাকলে রান নেয়া ব্যাটসম্যানদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা সেটাও পরিষ্কার বুঝে যান শচীন। যেসব উইকেটে রান তোলা কঠিন, সেসব ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানরা সাধারণত জোর দেন ২-১ রান নেয়ার দিকে। কিন্তু জন্টি সেটাও হতে দেননি, বাগড়া দিয়েছেন। দ্রুতগতি, দুর্দান্ত তৎপরতা দিয়ে তিনি পুরো সফরে বেশ কয়েকটি অস্বাভাবিক রানআউট সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। জন্টি নিশ্চিতভাবেই স্বাগতিকদের সঙ্গে সফরকারী ভারতের মধ্যে একটা পার্থক্য গড়ে দিয়েছিলেন। শুধু ফিল্ডিংয়ের সময়ই জন্টি ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ঘাবড়ে দিয়েছিলেন এমন নয়। তিনি ব্যাটিংয়ের সময়ও ভারতীয় ফিল্ডারদের ওপর স্নায়ুচাপ বাড়িয়েছেন। কারণ ব্যাটিংয়ের সময় উইকেটে দ্রুতবেগে দৌড়ানোর ক্ষেত্রেও দারুণ দক্ষ ছিলেন জন্টি। ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে ভারতীয় দল জয় পায়। কিন্তু ওই ম্যাচে জন্টি নিজেকে চিনিয়েছিলেন ভিন্নরূপে। এ্যান্ড্রু হাডসনের সঙ্গে ব্যাটিং করছিলেন সে সময় তিনি। জন্টি একটি সুইপ শট খেলে বল পাঠিয়েছিলেন স্কয়ার লেগে, সেখানে কপিল দেব ক্যাচ ফেলে দেন। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত ব্যাটসম্যানরা আউট হয়ে যাওয়ার আক্ষেপে বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন এবং হয়ত একটা রানই নিতে পারেন। কিন্তু জন্টি দাঁড়াননি। এক রানের পর তিনি দ্বিতীয় রানটাও প্রায় করে ফেলেছিলেন, যদিও হাডসন একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলেন দ্বিতীয় রান নেয়ার ক্ষেত্রে। সে কারণেই হয়া শেষ মুহূর্তে রানআউটের শিকার হন জন্টি। তিনি প্রায় তিন রান নিয়ে ফেলেন যখন নন-স্ট্রাইকার মাত্র এক রান সম্পন্ন করেছেন সবেমাত্র! ডারবান টেস্ট ড্র করে জোহানেসবার্গে পাড়ি জমায় ভারতীয় দল। সেখানে দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হয় ২৬ নবেম্বর। এই ম্যাচে শচীন একটি সেঞ্চুরি হাঁকান। সেটি ছিল টেস্টে তার ক্যারিয়ারের চতুর্থ শতক। তবে এই সেঞ্চুরি করে দারুণ আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলেন শচীন। ম্যাচের দ্বিতীয় দিন শেষে তিনি অপরাজিত ছিলেন ৭৫ রানে। কিন্তু তৃতীয় দিনের শুরুতে সকালের কঠিন উইকেটে দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন তিনি। ‘সাদা বিদ্যুত’ এলান ডোনাল্ড দুরন্ত বোলিং করছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে টিকে থাকার একমাত্র উপায় ছিল অসীম মনোযোগ ও ধৈর্য। শচীন অফস্টাম্পের বাইরের বলগুলো ছেড়ে দিচ্ছিলেন এবং তিনি ভাল করেই জানতেন ডোনাল্ডের বিরুদ্ধে ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে ফলাফল সুখকর হবে না। মধ্যাহ্ন বিরতির আগে ডোনাল্ডের বলে একটিই মাত্র কাভার ড্রাইভ খেলতে পেরেছিলেন শচীন। সেটা না করতে পারলে ধৈর্যের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যাটিংয়ের একটা দ্বান্দ্বিক অবস্থান প্রমাণ করত। ডোনাল্ডের সঙ্গে সেই যুদ্ধটাই শচীনকে প্রমাণ দিয়েছিল যে টেস্ট ক্রিকেট আসলে কতটা কঠিন। এটাকেই সেদিন শচীন যে কোন ক্রিকেটারের জন্য অন্যান্য ফরমেটের চেয়ে অন্যতম সেরা হিসেবে নিশ্চিতভাবে জেনে ফেলেছিলেন। বোলারদের জন্য দারুণ সহায়ক উইকেটে যখন ১৫০ কিলোমিটার বেগে বল আসে সেটা একজন ব্যাটসম্যানের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জের। ঘরোয়া ক্রিকেটে এ ধরনের কোন বোলিং স্পেল মোকাবেলার সুযোগ ঘটে না। এ কারণে টিকে থাকতে পারাটাই প্রমাণ করে কোন ব্যাটসম্যান আসলে কতটা উচ্চ মানের। শেষ পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতির পর শচীন তার কাক্সিক্ষত শতকটি পেয়ে যান। সেজন্য তার খেলতে হয়েছিল ২৭০ বল এবং প্রায় ৬ ঘণ্টা ৩০ মিনিট সময় নিয়েছিলেন তিনি। পরে বোলিংয়ে অনিল কুম্বলে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংসে এবং এই টেস্টেও ড্র করতে সক্ষম হয় ভারত। (চলবে...) তথ্যসূত্র : শচীন টেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ অবলম্বনে।
×