ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন করে জঙ্গীদের সংগঠিত করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

নতুন করে জঙ্গীদের  সংগঠিত করা  হচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নতুন করে দেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর অপচেষ্টা চলছে। নেপথ্যে রয়েছে দেশী-বিদেশী চক্র। হালে বেশি তৎপরতা চালাচ্ছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। তারাই একের পর এক হত্যাকা- চালাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জেলায় জঙ্গীরা সংগঠিত হচ্ছে। ছোট ছোট দলে সংগঠিত জঙ্গীরা মাঝে মধ্যেই হত্যাকা-ের ঘটনা সংঘটিত করছে। আর হত্যার দায় স্বীকার করে কখনও আইএস আবার কখনও আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার নামে বিবৃতি প্রকাশ করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রাখার চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আত্মগোপনে থাকা জঙ্গী প্রশিক্ষকদের প্রত্যক্ষ মদদ আর নির্দেশনায় নতুন করে জঙ্গীরা সংগঠিত হয়ে হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। প্রশিক্ষকদের গ্রেফতার করতে পারলেই হত্যাকা-সহ প্রপাগান্ডার মতো নানা অতৎপরতা কমে যাবে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি আইএস আলোচনায় আসে। এরপর থেকে যত অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটি হত্যাকা-ের পরেই হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস বা আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি সর্বশেষ ঢাকায় অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নাজিম উদ্দিন সামাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আ ফ ম রেজাউল করিম সিদ্দিক ও গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই, বাংলাদেশস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যার পরও হত্যার দায় স্বীকার করে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা ও আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। জুলহাস মান্নান ইউএসএআইডিইডে কর্মরত ছিলেন অথচ ২০১৩ সালে উত্তরায় আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা, ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যা, বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা ও অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট আরিফ রায়হান দ্বীপ হত্যার ঘটনায় দায় স্বীকার করে আইএস বা আল কায়েদার নামে কোন বিবৃতি প্রকাশিত হয়নি। আলোচিত এসব হত্যাকা-ের তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, দেশে আইএস বা আল কায়েদার তৎপরতা থাকার বিষয়টি জঙ্গী সংগঠন দুইটির নামে নিছক প্রপাগান্ডা। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এবং মূল হত্যাকারীরা নিজেদের আড়াল করতেই এসব প্রচার প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। কারণ এখন পর্যন্ত তদন্তে আলোচিত এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে আইএস বা আল কায়েদার কোন শাখার যোগসূত্র থাকার তথ্য মেলেনি। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। অনেকে গ্রেফতারও হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। হত্যার ধরন অনুযায়ী, নাজিম উদ্দিন সামাদ হত্যায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত থাকার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত বলে মনে করেন মামলাটির ছায়া তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পূর্ব বিভাগের উপ-কমিশনার মাহবুব আলম। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যায় জেএমবি জড়িত বলে তদন্তে বেরিয়ে আসছে। কলাবাগানের জোড়া খুনের সঙ্গেও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের কারাগারে অন্তত হাজারখানেক জঙ্গী বন্দী রয়েছে। বন্দী জঙ্গীদের মধ্যে জেএমবির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বন্দী জঙ্গীর সংখ্যার দিক থেকে জেএমবির পর হিযবুত তাহ্রীর ও তারপরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অবস্থান। এখনও অনেক জঙ্গী গ্রেফতারের বাইরে রয়েছে। বাইরে থাকাদের মধ্যে বেশকিছু প্রশিক্ষক রয়েছে। এদের মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রশিক্ষকরা অবস্থান নিয়েছে ঢাকা ও এর আশপাশের কিছু এলাকায় এবং সিলেটে। আর জেএমবি অবস্থান নিয়েছে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলায়। প্রশিক্ষকদের বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। এসব প্রশিক্ষকরাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় গোপনে জঙ্গী সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এসব প্রশিক্ষিত সদস্যদের দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে ছোট ছোট জঙ্গী টিম বা সিøপার সেল। সেই সব সিøপার সেলগুলোই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রশিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু বাংলাদেশী জঙ্গীর। এসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গী ও ভারতীয় মুজাহিদীনদের মাধ্যমে সীমান্ত পথে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক আসছে। এসব বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হচ্ছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হ্যান্ডগ্রেনেড। আর হালে সিøপার সেলের সদস্যরা চাপাতির পাশাপাশি পিস্তল ও রিভলভারের মতো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। এসব আগ্নেয়াস্ত্রের সিংহভাগের যোগান আসছে সীমান্ত ও বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। বর্তমানে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহ্রীর ও হামজা ব্রিগেডের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে গেছে। দীর্ঘদিন ধরেই কক্সবাজারের গহিন জঙ্গলে রোহিঙ্গাদের তত্ত্বাবধায়নে দেশের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা ট্রেনিং করে আসছে। বিস্ফোরক অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া মধ্যপাড়া কয়লা খনি, বাপেক্স, শ্যাভরণ, হার্ডডগ কোল মাইনিং, গ্রানাইড মাইনিং ইন্টারন্যাশনাল, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিরাশরে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড ও অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি তাল্লু (বর্তমানে শেয়ার বিক্রি করে দেয়ায় কার্যক্রম নেই) দেশে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক আমদানি করে থাকে। এসব কোম্পানিতে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা কর্মরত রয়েছে। তাদের মাধ্যমে জঙ্গীদের উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক পাওয়া বিচিত্র নয়। কারণ ভাউচারে বিস্ফোরক মিস ফায়ার দেখিয়ে তা বাইরে বিক্রি করা অসম্ভব নয়। বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম জানিয়েছেন, গত বছর সারাদেশে বিভিন্ন ঘটনায় বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে উদ্ধার হওয়া হ্যান্ডগ্রেনেড ও বিস্ফোরক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। তার মধ্যে ৭টি ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক খুবই উচ্চমাত্রার বলে পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। এ ধরনের বিস্ফোরক বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ছাড়াও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে একমাত্র জেএমবিরই এ ধরনের উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে শক্তিশালী হ্যান্ডগ্রেনেড তৈরি করার প্রমাণ মিলেছে। এসব হ্যান্ডগ্রেনেড তৈরির সঙ্গে জড়িত জেএমবি সদস্যদের অধিকাংশই পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বা কোন আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠী কর্তৃক প্রশিক্ষিত। সীমান্ত পথ ছাড়াও দেশীয় বা আন্তর্জাতিক কোন কোম্পানির কাছ থেকেও জেএমবির এ ধরনের উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক সংগ্রহ করা বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, দেশের আইএসের তৎপরতা থাকার অপপ্রচার শুরুর পর থেকে হালনাগাদ অন্তত ৫০ জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। তারা জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযুবত তাহ্রীরসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য। গ্রেফতারকৃতরা নিজেদের আইএসের অনুসারী বলে দাবি করলেও তাদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ থাকার কোন প্রমাণ মেলেনি। মূলত হত্যার পর অপরাধীদের গ্রেফতারের বাইরে রাখতে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে আইএস বা আল কায়েদার নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশ করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল ও সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরেই একটি গোষ্ঠী এসব হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটিয়ে দেশে আইএস ও আল কায়েদার তৎপরতা রয়েছে বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ঘটনার তদন্তে বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়েদার কোন তৎপরতার থাকার প্রমাণ মেলেনি।
×