ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সংবাদ সম্মেলনে কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা;###;সঙ্কটের সম্মানজনক সুরাহা চায় বিএমএ

চট্টগ্রামে চিকিৎসকদের লাগাতার কর্মসূচীতে রোগীরা জিম্মি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

চট্টগ্রামে চিকিৎসকদের লাগাতার কর্মসূচীতে রোগীরা জিম্মি

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ‘চিকিৎসকরা পরিবহন শ্রমিক নন। কিন্তু আন্দোলনের ধরন একই। মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে পরিবহন শ্রমিকরা বাস-ট্রাক চালানো বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করে। আর একই কৌশলে চিকিৎসকরা জিম্মি করেছেন রোগীদের। পরিবহন শ্রমিকরাও বলেন, আমরা তো ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটাইনি। চিকিৎসকরাও বলছেন, আমরা ইচ্ছা করে রোগী মারি না।’ চট্টগ্রামে তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে চিকিৎসকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য যে কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন সে প্রেক্ষিতে এই ক্ষুব্ধ অভিমত সাধারণ মানুষের। প্রাইভেট প্র্যাকটিস ও বেসরকারী হাসপাতালে সকল ধরনের সেবা বন্ধ থাকায় রোগী নিয়ে এখন বেশ বিপাকে স্বজনরা। টানা চার দিন একই অবস্থা। ফলে সরকারী হাসপাতালগুলোতে অসম্ভব চাপ। একসঙ্গে এত রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদান কঠিন হয়ে পড়েছে। শনিবার দুপুরে চিকিৎসকরা মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেন বিভিন্ন হাসপাতালসংলগ্ন সড়কগুলোতে। তারা ব্যানার ধারণ করে তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদ জানান। বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচী ছিল। অনেকেই আশা করেছিলেন সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচী প্রত্যাহারের বিষয়ে বক্তব্য আসবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা বন্ধ রাখার কর্মসূচী অনির্দিষ্টকাল চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আসে। তবে আইসিইউ ও সিসিইউতে জরুরী সেবা দেয়া হবে বলে জানান তারা। সংবাদ সম্মেলন থেকে একটি সম্মানজনক সুরাহার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নেতৃবৃন্দ। চট্টগ্রামে বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসাসেবা বন্ধের চতুর্থ দিন অতিবাহিত হয় শনিবার। কর্মসূচী একটানা চলতে থাকায় পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এখন সকল বেসরকারী হাসপাতালে এক ধরনের নীরবতা। সেখানে ডাক্তার নেই, তাই রোগীও নেই। বিকেলে চিকিৎসকদের চেম্বারে রোগীদের যে দীর্ঘ লাইন সাধারণত পরিলক্ষিত হয়ে থাকে সে চিত্র এখন দৃশ্যমান নয়। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া রোগীরা। অনেকেই তাদের রোগ নির্ণয়ের টেস্ট করাতে পারছেন না। আবার এমনও অনেকে রয়েছেন যারা টেস্ট করিয়েও রিপোর্ট ডেলিভারি পাচ্ছেন না। গত বুধবার থেকে চট্টগ্রামে চলছে চিকিৎসকদের এ কর্মসূচী। লাগাতার অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এতে করে রোগীদের দুর্ভোগ এবং স্বজনদের ক্ষোভ দুটোই বাড়ছে। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমরা চিকিৎসকদের কখনই পরিবহন শ্রমিকের ভূমিকায় দেখতে চাই না। কিন্তু এটাই সত্য যে, পরিবহন শ্রমিকরা যেভাবে যাত্রীদের জিম্মি করে দাবি আদায় করেন, ঠিক একই কৌশল গ্রহণ করেছেন ডাক্তাররাও। তারা তো দাবি আদায়ের জন্য বিকল্প কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। চট্টগ্রামে চিকিৎসকদের এহেন কর্মসূচীতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, চিকিৎসকরা দাবি আদায়ের জন্য যে কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন তা অনৈতিক এবং অত্যন্ত অমানবিক। এ ধরনের কর্মসূচী তাদের প্রত্যাহার করা উচিত। চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের নাগরিক অধিকার। কিন্তু তারা সম্ভবত সেবা ও পণ্য এ দুটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলেছেন। অবিলম্বে এ কর্মসূচী প্রত্যাহার করা না হলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে তীব্র সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আভাসও দেন তিনি। শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত বিএমএ’র সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডাঃ মোঃ শরীফ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সভাপতি ডাঃ মুজিবুল হক খান ও নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, আমরা চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখতে চাই না। তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে তারা বলেন, আমরা চাই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হোক। যদি অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে আইনগত ব্যবস্থায় আপত্তি নেই। তবে তারা বিষয়টির একটি সম্মানজনক সুরাহাও প্রত্যাশা করেন। চট্টগ্রামে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির চতুর্থ দিনে বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতালের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে যোগ দেন চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এতে সরকারী হাসপাতালেও সেবা কার্যক্রমে বিঘœ ঘটে। অনেক রোগীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ওয়ার্ডে চিকিৎসক না থাকায় সেবা ব্যাহত হয়। এদিকে, রোগীর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। বেড সঙ্কুলান না হওয়ায় ওয়ার্ডের মেঝেতে এমনকি বাইরে বারান্দায়ও বেড ফেলতে হয়। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারী সার্জিস্কোপ হাসপাতালে গত ৯ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন মেহেরুন্নেসা নামের এক প্রসূতি। সিজার করে সন্তান প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। তিনি প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছোট ভাই খায়রুল বশরের কন্যা। চিকিৎসকের অবহেলায় এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ মৃতের পরিবারের। এর জন্য প্রধানত হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ মাহবুবুল আলম ও ডাঃ শামীমা রোজীকে দায়ী করেন মৃতের স্বজনরা। ক্ষুব্ধ স্বজনরা সেদিন ওই হাসপাতালে ভাংচুরও করেন। সিএমপির পাঁচলাইশ থানায় এ বিষয়ে সার্জিস্কোপ হাসপাতালের ডাঃ মাহবুবুল আলম, ডাঃ শামীমা রোজী ও ডাঃ রানা চৌধুরীকে আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এতে ডাঃ রানার বিরুদ্ধে অপারেশনের পর রোগীর পেটে ব্যান্ডেজ রেখে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। আর এই মামলা দায়েরের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় চিকিৎসক মহলে। এর জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের।
×