ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

একান্ত আলাপচারিতায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ;###;প্রজাতন্ত্রের অন্য কোন বিভাগ নিয়ে অহেতুক চিন্তিত হতে হবে না

বিচারকরা মানসিকভাবে স্বাধীন হলেই বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

বিচারকরা মানসিকভাবে স্বাধীন হলেই বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে

আরাফাত মুন্না ॥ ব্রিটিশ শাসন আমলে সকলেই পরাধীন ছিল, তবে বিচারকরা পরাধীন ছিলেন, এটা কিন্তু কেউ বলে না। কারণ ওই সময়ে কোন সাংবিধানিক রক্ষাকবচ না থাকলেও বিচারকরা মানসিকভাবে স্বাধীন ছিলেন। আর এ কারণেই তারা ন্যায়বিচার কায়েম করতে পেরেছিলেন। তাই আমাদের বিচারকদেরও মানসিকভাবে স্বাধীন হতে হবে, তাহলেই বিচার বিভাগ প্রকৃত স্বাধীন থাকবে, প্রজাতন্ত্রের অন্য কোন বিভাগ নিয়ে অহেতুক চিন্তিত হতে হবে না। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কথাগুলো বলছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। ওই সময় তিনি বলেন, আমাদের সব সময়ে মনে রাখা উচিত, আমরা কিন্তু সবাই জনগণের সেবক। সেই সেবাটা কতটুকু আমরা দিতে পারছি সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জনগণের আইনানুগ স্বার্থ রক্ষা করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আইন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ইতিহাস ॥ আলাপচারিতার সময় সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায় সেই বিষয়ে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। যেহেতু আমাদের বিচার ব্যবস্থা ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছে, সে কারণে ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগ স্বাধীনতা কিভাবে অর্জন করল তা জানা প্রয়োজন। ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরে এবিএম খায়রুল হক বলেন, ১৬০৩ সালে প্রথম জেমস ইংল্যান্ডের রাজা হয়ে আসলেন, তিনি প্রাথমিকভাবে ‘রুল বাই ডিভাইন রাইট’ এবং ঘোষণা দ্বারা আইন তৈরি করতে চাইলেন। ওই সময় উচ্চ আদালতের বিচারকগণ, এমনকি প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড কোককেও যে কোন রাজ কর্মচারী বা প্রজাদের মতো একইভাবে রাজার সামনে উপস্থিত হওয়া মাত্র ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম বা চার হাত পা দিয়ে প্রণাম করতে হতো। এটা ছিল ১৭শ শতাব্দীর প্রথম দিকে উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের অবস্থান। এই ধারা থেকে বের হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ১৬৮৯ সালে এষড়ৎরড়ঁং জবাড়ষঁঃরড়হ সংগঠিত হয়, তাতে রাজার একক সর্বময় ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য ১৭০১ সালে এ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট আইনেই সর্বপ্রথম রাজার ইচ্ছা অনুসারে বিচারক অপসারণ বন্ধ হয়। উচ্চ আদালতের বিচারকদের চাকরির মেয়াদ আমৃত্যুকাল হয়। তবে অসদাচরণের কারণে কোন বিচারককে ইমপিচমেন্ট করা যেত। তিনি বলেন, এ ছাড়া আর কোন কারণেই কোন বিচারককে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না, তাদের বেতন বাড়ানো যাবে, সুবিধা বাড়ানো যাবে, তবে কোনভাবেই তাদের বেতন বা সুবিধাদি কমানো যাবে না, এমন সব নিয়ম করা হয়। ১৭০১ সালের এই আইনের বিধানই কিন্তু আমাদের সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদে আছে বিধায় বাংলাদেশেও প্রাপ্ত কোন সুবিধা থেকে কোন বিচারককে কখনই বঞ্চিত করা যাবে না। বিচারপতি খায়রুল হক জানান, ওই সময় আরও একটা সমস্যা ছিল। রাজার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব রাজ কর্মচারীসহ বিচারকদেরও চাকরির অবসান হয়ে যেত। ১৭৬১ সালের এক আইন বলে তৃতীয় জর্জ রাজার মৃত্যু হলেও বিচারকদের চাকরি অবসান হবে না এই বিধান করা হয়। এভাবে ১৮শ শতকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ॥ বাংলাদেশের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৮শ শতাব্দীতে যে ভাবে ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগে স্বাধীনতা আসে পরে সেই নিয়মটাই গ্রহণ করে আমেরিকা। একই ধরনের রক্ষাকবচ আমেরিকায়ও প্রবর্তন করা হয়। তাদের সংবিধানেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তথা বিচারকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সব বিধান পরবর্তীকালে সারা বিশ্ব তথা ভারত ও বাংলাদেশেও গ্রহণ করা হয়। এভাবে বাংলাদেশেও সংবিধানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের সংবিধানের ১০৮, ১০৯, ১১১, ১১২, ১১৬, ১১৬ (ক) এবং ১৪৭ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে আমাদের সুপ্রীমকোর্টসহ সমগ্র বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের অন্য দুটি বিভাগ থেকে শুধু পৃথক করাই নয়, তাদের বিচারিক স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সংবিধানের বিভিন্ন বিধান মারফত প্রজাতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ বা বিভাগের ক্ষমতার মধ্যে একটি ভারসাম্য নিশ্চিত করা হয়েছে যাতে কোন একক বিভাগ বা ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী না হয়ে উঠতে পারে। প্রতিটি বিভাগে সংবিধান অনুসারে একে অন্যের পরিপূরক হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী হবে না সে সুযোগও যেন না থাকে, সে জন্য সকলকেই সংবিধান অনুসারে কার্যক্রম করতে হবে, দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই প্রসঙ্গে ১৯৪২ সালের খরাবৎংরফমব ঠ. অহফবৎংড় মোকদ্দমায় বিচারকদের সম্পর্কে খড়ৎফ অঃশরহ-এর মন্তব্য ‘আচরণে নয়, মানসিকতায় নির্বাহী হতে হবে’Ñএখানে প্রণিধানযোগ্য। বিচারকদের স্বাধীনতা ॥ সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, একটা বিষয় সব সময় মনে রাখতে হবে, মননের স্বাধীনতা, মানসিক স্বাধীনতাটাই সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা। ব্রিটিশ আমলে সকলেই পরাধীন ছিল, তবে বিচারকরা পরাধীন ছিলেনÑএটা কিন্তু কেউ বলে না। কারণ সে আমলের কোন সাংবিধানিক রক্ষাকবচ না থাকলেও বিচারকরা মানসিকভাবে স্বাধীন ছিলেন। আর এ কারণেই তারা ন্যায়বিচার কায়েম করতে পেরেছিলেন। তাই আমাদের বিচারকদেরও মানসিকভাবে স্বাধীন হতে হবে, যেটা তারা নিশ্চয় থাকেন বলে আমার বিশ্বাস। সংবিধান কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। সাংবিধানিক ও আইনানুগ ক্ষমতা ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, কারণ বিচারকগণই সংবিধান ও আইনের ধারক এবং বাহক। তাহলেই বিচার বিভাগ প্রকৃত স্বাধীন থাকবে, প্রজাতন্ত্রের অন্য কোন বিভাগ নিয়ে অহেতুক চিন্তিত হতে হবে না। তিনটি বিভাগই জনগণের সেবক ॥ বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আরও বলেন, আমাদের প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। এর তিনটি স্তম্ভ এর একটি হচ্ছে জাতীয় সংসদ। এখানে সদস্যগণ সার্বভৌম জনগণের পক্ষে তাদের আশা-আকাক্সক্ষার কথা বলার জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন। তারা জনগণের প্রতিনিধি। তারা শুধু প্রতিনিধিই নন তারা জনগণের সেবকও বটে। নির্বাহী বিভাগও তিন স্তম্ভের একটি, এরও সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক দায়-দায়িত্ব রয়েছে। জাতীয় সংসদ যে আইনগুলো পাস করে, সে আইনগুলো বাস্তবায়ন করা, কার্যকরী করার দায় ও দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াত, অর্থনৈতিক কর্মকা- এই সমস্ত উন্নয়নগুলো আইন অনুসারে বাস্তবায়নের দায় ও দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। এই বিভাগে যারা আছেন তারাও কিন্তু জনগণের সেবক। অন্য বিভাগটি হচ্ছে বিচার বিভাগ। একইভাবে বিচার বিভাগে যারা আছেন তাদের দায়-দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার করা। মূলত তারাও কিন্তু জনগণের সেবক। জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই তাদের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য। সংসদ, নির্বাহী বিভাগ বা বিচার বিভাগ, সব কিছুই জনগণের জন্য। সব কিছুই জনগণকে সেবা দেয়ার জন্য। তিনটি স্তম্ভের যে রয়েছে সেখানে যারা আছেন তারা প্রত্যেকেই জনগণের সেবক। জনগণই হচ্ছে সার্বভৌম। সংসদ সদস্য যে সুযোগ-সুবিধা পান, নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাগণ যে সুযোগ-সুবিধা পান, বিচার বিভাগের বিচারকরা যে সুযোগ-সুবিধা পান, তা কিন্তু জনগণের টাকাতেই দেয়া হয়ে থাকে। তারা যে সংসদ সদস্য হবেন, সচিব হবেন বা বিচারক হবেন কেবল সে কারণে কিন্তু তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলো দেয়া দেয়া হয় না। তাদের এই সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় শুধু এই কারণে যে তারা যেন ভালভাবে সেবা দিতে পারেন। তাদের বেতন, গাড়ি-বাড়ি দেয়া হয়, অন্য কোন কারণে নয়। বিচারপ্রার্থীদের অধিকার ॥ আদালতে বিচারপ্রার্থীদের অধিকারের বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, মনে রাখতে হবে, বিচারকদের জন্য কিন্তু বিচার বিভাগ নয়। সাধারণ জনগনের জন্যই কিন্তু বিচার বিভাগ। জনগণ যাতে ন্যায়বিচার পায় সেই জন্যই কিন্তু বিচার বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আমাদের বিচার প্রার্থীদের প্রার্থনাটা কি, নিবেদনটা কি, তারা কি আশা করে? তা শুনতে হবে। তিনি বলেন, খুব বেশি কিন্তু তারা আশা করে না, তারা শুধু ন্যায় বিচারটাই কিন্তু প্রার্থনা করে। এ জন্য তাদের অনেক টাকা খরচ করতে হয়, আইনজীবী নিয়োগ করে, নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে তারা আদালতে আসে। শুধু একটাই তাদের আশা ন্যায়বিচার পাবে। তিনি আরও বলেন, সেই জন্যই বিচার বিভাগ তথা বিচারকদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত যে তারা জনগনের জন্য ন্যায় বিচারটি নিশ্চিত করতে পারছেন কি না? সে বিষয়টা জানা। মামলায় এক পক্ষ জয়ী হবে আরেক পক্ষ হারবে, এটা সবাই জানে, বিচারপ্রার্থীরাও জানে। কিন্তু তাদের কথা হচ্ছে হারুক বা জিতুক, তাদের পক্ষে যুক্তি-তর্ক তাদের প্রার্থনা, তাদের যে মামলাটা বিচারক ভালভাবে শুনেছেন, চিন্তা করেছেন, বিচার বিবেচনা করেছেন, এটুকুই বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশা। বিচারকদের উদ্দেশে সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, মামলায় যে পক্ষ হারবেন তিনিও যাতে মনে মনে এটা উপলব্ধি করেন, অন্তত তার বক্তব্যটা বিচারক ভালভাবে শুনেছেন এবং বিবেচনা করেছেন। তাহলে হেরে গিয়েও তাদের এই সান্ত¡না থাকবে, অন্তত বিচারক তাদের প্রার্থনাটা শুনেছেন। এই বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শুধু বিচার করলেই হবে না, বিচারপ্রার্থী যাতে বুঝতে পারে যে তাদের প্রতি দৃশ্যমান ন্যায়বিচার করা হয়েছে। সেখানেই যদি কোন ঘাটতি থাকে তাহলে কিন্তু ন্যায়বিচার হয়েছে এটা বলা যাবে না। দ্রুত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি ॥ দ্রুত মামলা নিষ্পতির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা নিশ্চয়ই দ্রুততম সময়ে মোকদ্দমার নিষ্পত্তি চাই, কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা ন্যায় বিচারটাও চাই। এই জন্যই বিচার বিভাগে যারা আছেন তারা নিশ্চিত করবেন, বিচারপ্রার্থীর আর্তি পুরোপুরিভাবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। আরও দুটি বিষয় আমাদের বিচারকগণকে মনে রাখতে হবে, প্রথমত তারা যেন স্পর্শকাতর বা অপ্রিয় বিষয় হোক না কেন আবেগতাড়িত না হন; দ্বিতীয়ত, অনুরাগ, বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ না করেন। জনগণের স্বার্থ রক্ষাই বড় আইন ॥ আরেকটা জিনিস আমাদের খেয়াল রাখা দরকার, আমরা যেন নার্সিজমে (আত্মপ্রেম) আক্রান্ত হয়ে না যাই। তাহলে কিন্তু মহা সমস্যা সকলের জন্যই সৃষ্টি হতে পারে। আর আমাদের সব সময়ে মনে রাখা উচিত যে, আমরা কিন্তু সবাই জনগণের সেবক। সেই সেবাটা কতটুকু আমরা দিতে পারছি সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জনগণের আইনানুগ স্বার্থ রক্ষা করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আইন। উল্লেখ্য, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের এই সাক্ষাতকারটি গত ১২ জানুয়ারি গ্রহণ করা হয়েছে।
×