ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাসপাতালের বেডে শত নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে শুয়ে আছে হ্যাপি

দু’মুঠো ভাতের জন্য ঢাকায় আসার আগে কে জানত এ নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা করছে

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

দু’মুঠো ভাতের জন্য ঢাকায় আসার আগে কে জানত এ নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা করছে

শর্মী চক্রবর্তী ॥ ছোট্ট মুখে স্পষ্ট আঘাতের চিহ্ন। পুরো মুখখানা নির্যাতনে ফুলে কালচে হয়ে গেছে। মেয়েটির মাথা ও পায়ে আঘাত রয়েছে। তার সিটিস্ক্যান করা হয়েছে। মারের চোটে শিশুটির দুই চোখ প্রায় বুজে এসেছে। হাত-পাসহ সারা শরীরে অসংখ্য দাগ। বাম পায়ে প্লাস্টার। প্রচ- ব্যথায় হাতও নড়াচড়া করতে পারছে না গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপি (১১)। কাজে একটু এদিক ওদিক হলেই অমানবিকভাবে তার ওপর নির্যাতন করত জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী। তাদের নির্যাতন সইতে না পেরে রবিবার সকালে ভয়ে শাহাদাতের বাসা থেকে পালানোর পর এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি (ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার) চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় মিরপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন শাহাদাত ও তার স্ত্রী। পুলিশ তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগেও একবার ওই শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণে শাহাদাতকে থানায় ডাকা হয়। তখন হ্যাপির ওপর আর নির্যাতন চালাবেন না বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। পরে ৩০ হাজার টাকার মুচলেকা দিয়ে থানা থেকে ছাড়া পান তিনি। প্রায় এক বছর আগে নানি মনোয়ারার মাধ্যমে ক্রিকেটার শাহাদাতের বাসায় গৃহকর্মীর কাজে যোগ দেয় হ্যাপি। হ্যাপির বাবার নাম আরব আলী ও মা পেয়ারা বেগম। গ্রামের বাড়ি জামালপুর। তার মা ও বাবা দু’জনের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেলে তারা দুজন অন্যত্র বিয়ে করে। তখন থেকে মামা সোহাগ ও নানি মনোয়ারার কাছে বড় হয় হ্যাপি। অভাব অনটনের সংসার। খাবার জোটে না। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের আশায় বাসার কাজে আসে হ্যাপি। কিন্তু সেখানে ভাতের বদলে প্রতিদিন নির্যাতনের শিকার হতে হতো তাকে। ঢাকায় আসার আগে গ্রামের এই নাম গোত্রহীন বনপুষ্পটি জানত কি তার জন্য এ নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা করছে বিশাল এই শহরে। শুরুতে শাহাদাতের সন্তানকে দেখাশুনার কাজে যোগ দিলেও তাকে দিয়ে বাসার সব ধরনের কাজ করান হতো। হাসপাতালে হ্যাপির সঙ্গে কথা হলে অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে সে বলে, একটা-দুইটা কাজে ভুল হলে হ্যাঙ্গার ও লাঠি দিয়ে পেটাত শাহাদাত ভাইয়া এবং তার স্ত্রী নিতু আপু। রবিবার বাচ্চার সুজি জ্বাল দিয়ে ফ্রিজে রেখে দেয়ার পর বের করলে হলুদ হলুদ দেখায়। সেটা দেখে শাহাদাত ভাইয়া আমার পেটে লাত্থি দিয়ে বলে, ‘তুই সুজিতে হলুদ-মরিচ দিছিস? এই কথা বলেই ভাইয়া আমার পেটে লাথি মারে। পরে ভাইয়া যখন বাসা থেকে বের হয়ে যান তখন আপু (তার স্ত্রী) বলে আসার সময় যেন একটা বেত নিয়ে আসে। আমাকে মারার জন্য। এ সময় আরেক বুয়া বাসায় আসলে আমাকে দরজা খুলে দিতে বলে। আমি দরজা খুলে দিয়ে বুয়াকে বাসায় ঢুকিয়ে দিয়ে মারপিটের ভয়ে সুযোগ বুঝে বাসা থেকে পালিয়ে যাই। হ্যাপি বাসা থেকে পালিয়ে গেলে গত রবিবার দুপুরে কাজের মেয়ে হারিয়েছে দাবি করে মিরপুর থানায় জিডি করেন ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন। হ্যাপি বলে, সব সময়ই মারত তারা দুইজনে। কিছু হলেই হাতের কাছে যা পেত চামুচ-খুন্তি দিয়াই মারত। এমনকি ছ্যাঁকাও দিত। কত কাকুতি-মিনতি করি তারপরও তাদের একটু দয়া হয়নি। বাসায় সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকতাম। বিশেষ করে ভাইয়াকে দেখলেই খুব ভয় লাগত। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসির সমন্বয়ক বিলকিস বেগম বলেন, হ্যাপির সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। তার মুখের বাঁ পাশ ফুলে গেছে। এক চোখে গুরুতর জখম ও মাথার বাঁ পাশে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া বাঁ পায়ের পাতার একটি হাড় ভেঙে সে জায়গা ফুলে গেছে। রবিবার রাত সাড়ে তিনটায় ওসিসিতে হ্যাপিকে আনার পর থেকে তার চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, অর্থপেডিক, নিউরোসার্জারি ও চক্ষু বিভাগের তত্ত্বাবধানে হ্যাপির চিকিৎসা চলছে। তার বাম পায়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। এছাড়া ওসিসি’র মাধ্যমে কাউন্সিলেংও করা হয়েছে বলে জানান ডা. বিলকিস। এদিকে হ্যাপির মামা ও নানি এই খবর পেয়ে ছুটে আসে ঢাকায়। তারা এখন হাসপাতালে হ্যাপির পাশে আছেন। তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, আমাদের মেয়েকে এখানে দিয়েছিলাম শাহাদাতের বাচ্চাকে দেখাশুনা করার জন্য। যখন তাকে দিয়ে গিয়েছিলাম তখন তারা বলেছিল হ্যাপি তাদের কাছে ভাল থাকবে। এই বুঝি ভালর ধরন? একটা শিশুকে তারা এইভাবে মারতে পারল? তারা মানুষ না, আমরা তাদের বিচার চাই। রবিবার হ্যাপির ওপর নির্যাতনের পর সে মিরপুরের সেকশন-২ এর এইচ ব্লকের ৫ নম্বর রোডের ৬ নম্বরে শাহাদাতের বাসা থেকে পালিয়ে সাংবাদিক কলোনির পাশে আসে। সেইসময় তাকে দেখতে পায় ওই এলাকার খন্দকার মোজ্জাম্মেল হোসেন, তরু আহমেদ ও মিরাজ মাহবুব। তাকে দেখে তারা তার কাছে গিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে। পল্লবী এলাকার বাসিন্দা মিরাজ মাহবুব বলেন, অনেকক্ষণ ধরে সাংবাদিক প্লটের রাস্তায় মেয়েটিকে (হ্যাপি) ঘোরাফেরা করতে দেখেন তিনি। মেয়েটির চোখে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়ে তারা এগিয়ে যান। তখন মেয়েটি তাদের জানিয়েছে, সে ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেনের বাসায় কাজ করে। শাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রী নিত্য দু’জনেই তাকে (হ্যাপি) নির্যাতন করে। এরপর মেয়েটিকে থানায় নিয়ে যান। তিনি বলেন, হ্যাপিকে উদ্ধার করার পর সমঝোতার প্রস্তাব দেয় শাহাদাত। এ ধরনের ছোট ঘটনা নিয়ে পুলিশী ঝামেলায় না যাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ জানিয়েছেন শাহাদাত। ওইদিন রাতেই গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ এনে ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মিরপুরের বাসিন্দা খন্দকার মোজাম্মেল হোসেন বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলাটি করেন। মিরপুর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, শিশু গৃহকর্মীটিকে নিয়মিত নির্যাতন করা হতো। তার শরীরে বিভিন্ন ধরনের আঘাতের চিহ্নও রয়েছে। পুলিশের কাছেও শিশুটি তাকে নির্যাতানের কাহিনী বিস্তারিত বলেছে। প্রাথমিক তদন্তে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, এই ঘটনা মামলা হয়েছে। তবে ঘটনার দিন থেকেই শাহাদাতের বাসায় তালা ঝুলছে। স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে পালিয়ে আছেন তিনি। তাকে গেফতারে পুলিশী অভিযান চলছে। আমরা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি সে এবং তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করতে আমরা সক্ষম হবো। নির্যাতনের এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে বেশি। এই ঘটনার পর সবার একটাই মন্তব্য, হ্যাপিকে নির্যাতনের ঘটনা বর্বর যুগকেও হার মানিয়েছে।
×