ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যক্ষ্মায় বছরে মারা যায় ৮০ হাজার ॥ স্টপ টিবি স্ট্র্যাটেজি

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২০ জুন ২০১৫

যক্ষ্মায় বছরে মারা যায় ৮০ হাজার ॥ স্টপ টিবি স্ট্র্যাটেজি

সমুদ্র হক ॥ দেশে সাধারণ যক্ষ্মা রোগে নিরাময়ের হার সন্তোষজনক, তবে ওষুধ সেবন অনিয়মিত হওয়ায় মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (এমডিআর) যক্ষ্মায় মৃত্যুর হার কমেনি। এই অবস্থার দ্রুত নিরসনে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যক্ষ্মা বন্ধ (স্টপ টিউবারকুলসিস) কৌশল (স্ট্রাটেজি) গ্রহণ করেছে। দেশজুড়ে ডাইরেক্ট অবজার্ভ ট্রিটমেন্ট (ডট) আরও গতিশীল করে তুলে জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যেই যক্ষ্মার কারণে মৃত্যু হার অর্ধেকে কমিয়ে আনা হবে। যক্ষ্মায় প্রতিবছর মারা যায় ৮০ হাজার লোক। বর্তমানে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে। যার ১৫ শতাংশ (পনের লাখ) মারা যায়। বিশ্বে মোট যক্ষ্মা রোগীর ৮০ শতাংশের বাস ২২টি দেশে। এই দেশগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ। তার মধ্যে প্রথম অবস্থানে ভারত, দ্বিতীয় অবস্থানে চীন, এভাবে ৬ষ্ঠ অবস্থানে বাংলাদেশে। যদিও বাংলাদেশের অবস্থান অপেক্ষাকৃত ভাল তারপরও একেবারে সন্তোষজনক নয়। দেশে প্রতিবছর অন্তত ৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষ (শিশু ও নারীসহ) নতুন করে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। প্রতিবছর মারা যায় ৮০ হাজার লোক। অথচ যক্ষ্মা রোগ ভাল হয় নিয়মিত ওষুধ সেবনে। সূত্র জানায় যক্ষ্মা আক্রান্তদের একটা অংশ দুই সপ্তাহ নিয়মিত ওষুধ সেবনের পর অনেকটা সেরে উঠলে আর ওষুধ সেবন করতে চান না এবং নিয়মিত ওষুধ সেবনও করেন না। ফলে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যান, কোন ওষুধ আর কাজ করে না। যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথ জানালেন, এমডিআর টিবি হলে প্রধান দুই ওষুধ (রিফামপিসিন ও আইসোনিয়াজাইড) জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে না। টিবির এই অবস্থা সহজে নিরাময় হয় না। তবে সাধারণ যক্ষ্মা শনাক্ত হওয়ার সঙ্গেই নিয়মিত ওষুধ সেবনে সম্পূর্ণ আরোগ্যের হার ৯৩ শতাংশ। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে, ১২টি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ৪৪টি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, আরবান ক্লিনিক, ইপিজেড, বিজিএমইএ এলাকাসহ ব্র্যাকের সকল স্বাস্থ্য সেবা ইউনিটে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর আওতায় যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় তাতে বর্তমানে প্রতি এক লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৭০ জন যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত হয়। তবে এর বাইরেও যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী আছে বলে ধরে নেয়া হয়, যাদের এই কর্মসূচীর আওতায় আনা যায়নি। এই অবস্থার উত্তরণে সরকার এবং ব্র্যাকসহ ৪৩টি বেসরকারী সহযোগী সংস্থা একযোগে কাজ করছে। একটা সময় ধরে নেয়া হতো যক্ষ্মা শুধু ফুসফুসেই হয়। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রসরতার এই ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। যক্ষ্মা শরীরের যে কোন স্থানে হতে পার। সাধারণভাবে যক্ষ্মা দুই ধরনের ১. ফুসফুসে যক্ষ্মা (পালমোনারি টিউবারকুলসিস) ২. ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষ্মা (এক্সট্রা পালমোনারি টিউবারকুলসিস)। এই যক্ষ্মা মস্তিষ্ক, মস্তিষ্কের পর্দা, শ্বাসনালী, গ্রন্থি, ফুসফুসের পর্দা, মেরুদ-, কিডনি, হাড় অস্থি মজ্জাসহ যে কোন স্থানে হতে পারে। তবে ফুসফুসে আক্রান্ত যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বেশি। ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষ্মা দেহের যে কোন স্থানে নানা উপসর্গে ধরা দেয়। যেমন কাঁধে গলার কাছে বগলে গুটি আকারে ব্যথাবিহীন কিছু দেখা দেয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া নেয়া দরকার। সাধারণত কাশি ও রক্ত পরীক্ষা করেই যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় করা হয়। কফে (কাশি) যক্ষ্মা জীবাণুযুক্ত রোগীর ৭০ শতাংশ শনাক্ত করা যায়। শনাক্তের পর নিয়মিত সেবনে ৯৩ শতাংশ আরোগ্য লাভ করে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে ২ হাজার ১৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মার কারণে মৃত্যুহার অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এই লক্ষ্যেই ডটসকে আরও কার্যকরী করা হচ্ছে। এমডিআর রোগী শনাক্তকরণের জন্য কফ কালচার, ড্রাগ সেনসিটিভিটি টেস্ট (ডিএসটি) জিন এক্সপার্ট পরীক্ষার বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। জিন এক্সপার্ট স্থাপিত হয়েছে ঢাকায় মহাখালী শ্যামলী, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, যশোর, রংপুর, বরিশাল, খুলনা, পাবনা সিলেট বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং টাঙ্গাইল ও নেত্রকোনায় টিবি এ্যান্ড লেপ্রসি হাসপাতাল। স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, বড়দের মতো শিশুদেরও ফুসফুস ও ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষ্মা রোগ হতে পারে। শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তকরণ খুবই কঠিন। কাশি পরীক্ষায় রোগ নির্ণয় নাও হতে পারে। আবার হাম অপুষ্টি হুপিং কাশি এইচআইভি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে যক্ষ্মাকে ত্বরান্বিত করে। চিকিৎসকদের মতে শিশুদের ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষ্মা বেশি হয়। শিশু বা বড় যেই হোক যক্ষ্মা শনাক্তকরণের সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করলে ৬ থেকে ৮ মাসের মধ্যে রোগীর যক্ষ্মা নির্মূল হয়ে যায়। ব্যত্যয় ঘটে তখনই যখন রোগী নিয়মিত ওষুধ সেবন না করে বন্ধ করে দেয়। নিয়মিত ওষুধ সেবনের নিয়ম হলো- প্রতিদিন সকালে রোগী খালি পেটে নিকটস্থ স্বাস্থ্য সেবিকার বাড়িতে গেলে বিধি অনুযায়ী ওষুধ খাইয়ে দেবে। নির্দিষ্ট দিনে রোগী সেবিকার বাড়িতে না গেলে সেবিকা রোগীর বাড়িতে গিয়ে ওষুধ সেবন করিয়ে আসবে। এই পদ্ধতিতেই যক্ষ্মা নিরাময়ের হার শত ভাগ। এই ব্যবস্থায় যেন কোন ধরনের ব্যত্যয় না ঘটে সেই দিকে দৃষ্টি দিয়েছে সরকার।
×