ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে শিহাবউদ্দিন

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২৩ এপ্রিল ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধে শিহাবউদ্দিন

মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিক, রাষ্ট্রদূত কেএম শিহাবউদ্দিন ১৫ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন জাতীয় দৈনিকে এই বরেণ্য কূটনীতিকের মৃত্যুর খবর জানতে পারি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতের দিল্লীতে তৎকালীন পাকিস্তান হাইকমিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একাত্তরে রক্তস্তাত ও অগ্নিঝরা মার্চের শেষ সপ্তাহে এই অকুতোভয় কূটনীতিকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রিয় মাতৃভূমিতে পাকিস্তানী হায়েনাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। প্রাণ বাঁচাতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহর থেকে নারী-পুরুষ-শিশুসহ সব বয়সের মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার মানুষ পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নেয়। এসব ঘটনার পাশাপাশি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বান কেএম শিহাবউদ্দিনের রক্তে শিহরণ জাগায়। তাঁর মনে শক্তি যোগায়। প্রবল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অকুতোভয় এই যুবক কূটনীতিক দেশ মাতৃকার ডাকে এবং গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই মহাবীর মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিক নিজের ভবিষ্যত ও প্রিয়তমা স্ত্রী এবং প্রাণপ্রিয় দুই শিশুসন্তানসহ পুরো পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়ে কোনরূপ ভ্রƒক্ষেপ না করে ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সঙ্গে ছিলেন আরেক বিপ্লবী বীর পাকিস্তান দূতাবাসের এ্যাসিস্টেন্ট সহকারী প্রেস এ্যাটাশে আমজাদুল হক। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত অবস্থায় মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতি জীবনবাজি রেখে আনুগত্য প্রকাশ যে কতটা ভয়ঙ্কর ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জন্মভূমির পক্ষে শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হকের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বিদেশে বাঙালী জাতির শুধু ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল করেনি, সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মুক্তিকামী বাঙালীদের মনেও প্রভূত প্রেরণা জাগায়। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বহু দেশী-বিদেশী সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। নতুন সরকার শপথ গ্রহণের পরের দিন ১৮ এপ্রিল কলকাতায় পাকিস্তানী ডেপুটি হাইকমিশনের প্রধান হোসেন আলী তাঁর সব সহকর্মীকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি দূতাবাস ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। কয়েকদিন পর ২৬ এপ্রিল আরেক বঙ্গ-শার্দূল নিউইয়র্কের পাকিস্তানী মিশনের দ্বিতীয় প্রধান বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তখনকার বিরাজমান প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ এক চরম বৈরী পরিবেশে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ ছিল একটি দুর্দান্ত সিদ্ধান্ত। রিচার্ড নিক্সনের তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী নিধনযজ্ঞের ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে তারা আদাজল খেয়ে পাকিস্তানের অখ-তা টিকিয়ে রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। সেরকম একটি সময়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে তাদের প্রকাশ্য ভূমিকার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিল কঠিন বিষয়। মাহমুদ আলী সেই অসাধ্যটিই সাধন করে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ অন্য আরও কিছু দেশের তৎকালীন পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত বাঙালী কূটনীতিক ও কর্মচারীদের মধ্যে অনেকে দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পরে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেছেন। কূটনৈতিক ফ্রন্টে দেশের মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিকদের সাহসী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বে জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশাল হৃদয়ের এই কূটনীতিক মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস মিনিস্টার হিসেবে আমার প্রায় সোয়া তিন বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগ হয়েছিল। আমার কার্যকাল ছিল ১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০০ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত। অবশ্য চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০০ সালের ২৮ জানুয়ারি। রাষ্ট্রদূত শিহাবউদ্দিন তাতে ব্যত্যয় ঘটান। তিনি আমাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আপনার মতো একজন দক্ষ ও সফল প্রেস মিনিস্টারের এই দূতাবাসে কমপক্ষে আরও একটি বছর থাকার প্রয়োজন রয়েছে।’ চাকরির মেয়াদ শেষে একটি মিনিট বেশি থাকার বিষয়ে আমার প্রবল আপত্তি থাকার পরও তিনি তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। বাংলাদেশ থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যারাই ওয়াশিংটনে যেতেন তাদের প্রত্যেককেই তিনি বলতেন, শাহজাহান মিয়া গত দুই-আড়াই বছরে যে কাজ করেছেন, তা গত বিশ বছরেও কেউ করতে পারেনি। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আমি ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ এবং ‘ইউএসএ টুডে’ পত্রিকায় বাংলাদেশের ওপর ২৩টি রিপোর্ট ছাপাতে সমর্থ হয়েছিলাম। ২০০০ সালের ২৮ জানুয়ারি আমি আমার বড় ছেলেকে নিয়ে দূতাবাসে যাই। রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে আমার রুমে গিয়ে প্রেস মিনিস্টার হিসেবে আমি ‘চার্জ রেলিনকুইশ’ চিঠিটি লেখা শুরু করতেই ৫-৬ জন অফিসার ও স্টাফ এসে আমাকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে ফোন। রাষ্ট্রদূত স্যার, আপনাকে ডাকছেন।’ আমি দ্রুত রাষ্ট্রদূত সাহেবের রুমে ঢুকতেই তিনি ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধরেন, ফরেন সেক্রেটারি শফি সামি সাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’ এ্যাম্বাসেডর সাহেবের রুমে তখন কম করে হলেও প্রায় একডজন অফিসার ও স্টাফ। সবারই হাসিমুখ। বিষয়টি আঁচ করতে আমার কষ্ট হলো না। ফোন ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে ফরেন সেক্রেটারি সাহেব বললেন, ‘শাহজাহান সাহেব, আপনি ‘এ্যান্ড এপ্রিল’ পর্যন্ত দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করেন। আপনি আমার ‘মিনিস্ট্রির আন্ডারে’ হলে আপনাকে আমি একটা ফুলটার্ম দিয়ে খুশি হতাম।’ তাৎক্ষণিকভাবে শফি সামি সাহেবের কথার উত্তর আমি দিতে পারিনি। কারণ, পরিবার পরিজন নিয়ে দেশে ফিরে আসাই তখন ছিল আমার একমাত্র চিন্তা। আমার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য কয়েকজনের নামও জানতে পেরেছিলাম। ঐ মুহূর্তে রাষ্ট্রদূতের রুমে উপস্থিত সবাই আমাকে বিভিন্নভাবে আকারে ইঙ্গিতে সম্মতি প্রদানের কথা বলতে থাকেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে ফেলেন, স্যার, আপনি এখন সম্মতি প্রদান না করলে বিষয়টি রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।’ আমি নিজেও অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায় দূতাবাসে আমার প্রিয় কলিগদের বলার চেষ্টা করেছিলাম এখন ওয়াশিংটনে আরও পৌনে তিন মাস থাকা মানে মেয়ের কলেজের সেমিস্টার শেষ হওয়া পর্যন্ত আরও কমপক্ষে দুই মাস ওয়াশিংটনে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজ খরচে থাকতে হবে, যা একটি অসম্ভব ব্যাপার। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে পররাষ্ট্র সচিব মহোদয়কে বিষয়টি সম্পর্কে পরে জানাব বলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দেই। ফরেন সার্ভিসের অত্যন্ত মেধাবী এ অফিসার ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন। তাঁর মেধা ও যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। আবারও ফিরে আসছি শিহাব ভাইয়ের কথায়। দূতাবাসে যোগ দেয়ার প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্রদূত শিহাবউদ্দিন আমাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান। ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে স্যার সম্বোধন করতেই তিনি বলেন, ‘শাহজাহান সাহেব আপনি একজন সিনিয়র সাংবাদিক এবং একজন সাংবাদিক নেতা। আমাকে স্যার বলবেন না। ভাই বললেই হবে।’ সঙ্গে সঙ্গেই আমি বললাম, ‘না স্যার, এটা হয় না। দূতাবাসের প্রধানকে স্যার বলতেই হবে। বাইরে ভাই সম্পর্কটিই থাকবে।’ দূতাবাসে যোগ দেয়ার পর আমার কাজের প্রতি তার আগ্রহ ও আস্থা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমার চিন্তা-চেতনায় শুধু একটি বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, বিশ্বের প্রচ- প্রতিপত্তিশালী দেশটির সাংবাদিকদের দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু লেখানো। তাদের কাছে প্রিয় মাতৃভূমিকে সুন্দর করে তুলে ধরার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছার প্রথম মাসেই ‘বাংলাদেশ ইন প্রোফাইল’ নামে ২১-পৃষ্ঠার একটি বুকলেট তৈরি করলাম। রাষ্ট্রদূত সাহেব বেশ প্রশংসা করলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার প্রগাঢ় শ্রদ্ধার প্রমাণ আবারও পাওয়া গেল। বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক অনেক সময় বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন। আমার লেখা সম্পর্কে দূতাবাসের সিনিয়র কর্মকর্তাদের জানালেন। রাষ্ট্রদূত সাহেব কমপক্ষে দু’বার আমাকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে নিয়ে গেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ম্যাকন কলেজ প্রদত্ত ‘পার্ল এস বাক’ এ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় গিয়েছিলেন। আমার ওপর রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের আস্থা এতটাই ছিল যে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি অনুষ্ঠানের আগের দিন কলেজের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রী-স্টাফদের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য আমাকেই মনোনীত করেছিলেন। বাংলাদেশের ওপর আমার লেখা ওই ২১ পৃষ্ঠাই ছিল ভিত্তি। দীর্ঘ ১৮ বছর পর গত বইমেলায় ‘বিলাভড বাংলাদেশ’ নামে আমার অনেক কষ্টের প্রয়াসটিকে বই আকারে প্রকাশ করতে পেরেছি। টাকা অনেক খরচ হয়েছে ঠিক, কিন্তু আমার মন তৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু দুঃখ এই যে, যে মানুষটি আমার এই বইটি হাতে পেলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন, তার হাতে একটি কপি আমি পৌঁছাতে পারিনি। সবাইকে ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। নয়াদিল্লীস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে কেএম শিহাবউদ্দিন বড় পদে কর্মরত না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ছিল একটি অনেক বড় কাজ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি অনন্য ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পক্ষে কূটনৈতিক ফ্রন্টে বিপ্লব ঘটানোর পথপ্রদর্শক। অনেক আগেই বাঙালী জাতির তাকে যথাযথ সম্মান জানানো উচিত ছিল। দেরি হয়ে গিয়ে থাকলেও আগামী বছর এই মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিককে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা পদক প্রদান করেও সম্মান জানানো যেতে পারে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষ গুরুত্বসহকারে বিষয়টি ভাববেন এটা আশা করা যায়। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইল আমার সমবেদনা। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×