ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীকে বেগম জিয়ার কার্যালয়ে ঢুকতে না দেয়ার ঘটনা ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ ;###;কার লাভ, কার ক্ষতি এ নিয়ে মন্তব্য করছেন সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী সকলেই

চলছে হারজিতের হিসাব

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

চলছে হারজিতের হিসাব

শরীফুল ইসলাম ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুত্র শোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গেলে তাঁকে গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না দেয়ার বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে একই প্রশ্ন কেন বিএনপি এই শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজটি করল? খালেদা জিয়াকে কি কেউ ‘মিসগাইড’ করেছে? দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের পথ খুঁজতে সারাদেশের মানুষ যখন উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল ঠিক সেই সময়ে সুযোগ সৃষ্টির পরও দুই নেত্রীর মধ্যে দেখা ও কথা হলো না। এতে কার লাভ কার ক্ষতি হলো- এমন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অভিজ্ঞমহলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে কি হেরে গেলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে খোদ বিএনপির নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়েছেন। দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের বৈরী অবস্থানের কারণে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে যখন সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল ঠিক সেই মুহূর্তে সুযোগ সৃষ্টি হয়েও বিএনপির একঘেয়েমির কারণে তা হাতছাড়া হয়ে গেল বলে এখন দেশবাসী মনে করছেন। রবিবার ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ প্রসঙ্গে জোটের নেতারা বলেছেনÑ ‘লাথি মার সংলাপে’। আর অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিএনপিও ওপরে ওপরে সংলাপের কথা বললেও এখন আর সে পথে না গিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমেই বিজয়ের পথ আবিষ্কারের চেষ্টা করবেন। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিষয়টি সুদূরপরাহত বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। বিএনপি জোটের টানা অবরোধ কর্মসূচীর মধ্যে দেশব্যাপী যখন পেট্রোলবোমা নাশকতার কারণে দেশের হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দগ্ধ মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে তখন সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদদের প্রতি ঘৃণার বিষবাষ্প ছাড়ছে। ঠিক এমন একটি মুহূর্তে খালেদা জিয়ার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পুত্রশোকে কাতর খালেদা জিয়া কথা বলতে না পারলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে হয়ত পরিবেশ কিছুটা ভিন্ন রকম হতো। এ সুযোগে হয়ত স্বল্প সময়ের মধ্যে সংলাপের পরিবেশও সৃষ্টি হতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না দিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন বলে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন বলাবলি করছেন। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপির এ আচরণে সারাদেশে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠেছে। জানা যায়, বিএনপির থিঙ্ক ট্যাংক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক সময় যারা চীনপন্থী কমিউনিস্ট ছিলেন তাঁদের কথাই এখন খালেদা জিয়া শোনেন। প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানাতে গেলেও তাঁকে গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না দেয়ার ঘটনাটিও তাঁদের পরামর্শেই ঘটানো হয়েছে। আর এরাই অতীতে খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছিলেন। আর এ বিষয়টি বুঝতে পেরে উদারপন্থী বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু সংবাদ শুনে তাঁকে সমবেদনা জানাতে যাওয়ার কথা শনিবার সন্ধ্যার আগেই বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জানিয়ে দেয়া হয়। রাত ৮টা ১৯ মিনিটে গণভবন থেকে রওনা দিয়ে ৮টা ৩৫ মিনিটে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে নামেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তার আগেই প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দিয়ে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘সিএসএফ’ টিমের সদস্যরা সেখান থেকে সরে যান। খালেদা জিয়া তখন তাঁর কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় দরজা বন্ধ করে নির্বাক হয়ে বসে আছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারসহ দলের অনেক নেতাকর্মী ও গুলশান অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তখন কার্যালয়ের ভেতরেই ছিলেন। ভেতরে-বাইরে মিলিয়ে শতাধিক মিডিয়াকর্মীও সেখানে ছিলেন। কিন্তু ফটক খুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভেতরে যাওয়ার সুযোগ দিতে কেউ এগিয়ে এলেন না। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের দুই প্রবীণ নেতা শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ প্রধান ফটক খুলে দেয়ার জন্য ভেতরে থাকা বিএনপি নেতাদের অনুরোধ জানান। কিন্তু খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ভেতর থেকে বিএনপির পক্ষে তাঁদের অনুরোধে সাড়া দেয়া হয়নি। তাই ৬ মিনিট সেখানে অবস্থান করে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ভেতরে যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে ফিরে গেলেন। আর সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা ও কথা হওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে পড়ল। এ খবরে সারাদেশের সর্বস্তরের আশাবাদী মানুষের মধ্যে হতাশার ছায়া নেমে এলো। প্রধানমন্ত্রী গুলশান কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে এসে সাংবাদিকদের খালেদা জিয়ার বরাত দিয়ে জানান, কোকোর মৃত্যুর কারণে আন্দোলন কর্মসূচীর হেরফের হবে না, আন্দোলন চলবে। তখন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলামসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী ও আত্মীয়স্বজনরাও শোকার্ত খালেদা জিয়ার সামনে যেতে পেরেছিলেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। একপর্যায়ে খালেদা জিয়া অসুস্থতাবোধ করলে দরজা বন্ধ করে একাকী সেখানে অবস্থান করেন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বলেও জানা যায়। তবে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার আগে সেখানে কোন চিকিৎসক প্রবেশ করতে কেউ দেখেননি বলে তখন সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের খবর পেয়ে রাত ৮টার দিকে গুলশান কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস জানান, পুত্র শোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এ মুহূর্তে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। পুত্র শোকে কাতর খালেদা জিয়া অসুস্থ। সুস্থ হলে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের বিষয়টি জানানো হবে। তাঁর মুখে এ কথা শোনার পর থেকেই সাংবাদিকদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দেয়Ñ তাহলে কি দুই নেত্রীর দেখা হচ্ছে না? অবশেষে সে আশঙ্কাই সত্যি হয়। অপরদিকে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত না পেয়ে শেখ হাসিনা গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে চলে যাওয়ার পর রাত পৌনে ৯টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, কোকোর মৃত্যু সংবাদ শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন। এর মধ্যে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু খালেদা জিয়া দরজা না খোলায় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সমবেদনা জানাতে পারেননি। বিকেলেই বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আসার পরও এভাবে দরজা বন্ধ রাখা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। পরে রাত সাড়ে ৯টায় সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, আমরা আগেই জানিয়েছিলাম খালেদা জিয়াকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী চলে এলেন এবং আমি শোকবই নিয়ে প্রধান ফটকে আসতে না আসতেই তিনি চলে গেলেন। শিমুল বিশ্বাস বলেন, শোকের ঘটনা নিয়ে কেউ যাতে নোংরা রাজনীতি না করেন সে আহ্বান জানাচ্ছি। উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০০৯ সালের মে মাসে দুই নেত্রীর সরাসরি কথা হয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর ধানম-ির বাসভবন সুধাসদনে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমবেদনা জানান এবং দুই নেত্রীর মধ্যে কিছুক্ষণ কথাও হয়। এরপর সশস্ত্রবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে সেনাকুঞ্জে বেশ কয়েকবার দেখা হলেও তাঁরা কথা বলেননি। এছাড়া ২০১৩ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর বঙ্গভবনে দেখা হলেও তাঁরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেননি। তবে ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়াকে ফোন করে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু খালেদা জিয়া সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাঁদের মধ্যে আরও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি হয়। খালেদা জিয়া ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর রোড ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচীর ডাক দিয়ে সারাদেশকে কার্যত ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিএনপির সিনিয়র নেতারা গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে যাওয়া এবং গুলশানের বাসা থেকে খালেদা জিয়া বের হতে না পারায় সে কর্মসূচী ব্যর্থ হয়। এর পর নির্বাচন প্রতিহত করতে সারাদেশে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করে দিলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি বিএনপি জোট। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পর ৫ জানুয়ারিকে কালো দিবস হিসেবে পালন করতে ওই দিন ঢাকায় সমাবেশ কর্মসূচী পালনের ডাক দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু এ কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে বড় ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে বলে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে রিপোর্ট পেয়ে সরকার বিএনপিকে সমাবেশ করতে অনুমতি দেয়নি। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যে কোন মূল্যে সমাবেশ করার ঘোষণা দেন। সমাবেশের প্রস্তুতি জোরদার করতে ৩ জানুয়ারি রাত থেকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করে খালেদা জিয়া ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তবে ৩ জানুয়ারি মধ্য রাত থেকেই খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে পুলিশী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ৫ জানুয়ারি বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে চাইলে পুলিশ খালেদা জিয়াকে বাধা দেয়। আগেই প্রধান ফটকে তালা মেরে দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার গাড়ি ফটকের সামনে গিয়ে হর্ন দিতে থাকে আর তার সঙ্গে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা ফটকে লাথি মেরে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। এ সময় পুলিশ পিপার স্প্রে মেরে মহিলা দলের নেতাকর্মীদের নিস্তেজ করে দেয়। পরে খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে টানা রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। এই অবরোধ কর্মসূচীর সঙ্গে মাঝে মধ্যে হরতালও পালন করা হচ্ছে। কিন্তু এ কর্মসূচী পালনের নামে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় বিশেষ করে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে শতাধিক মানুষ দ্বগ্ধ হওয়ায় সরাদেশে বিএনপি জোটের এ কর্মসূচী নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এ পরিস্থিতিতে নানামহল থেকে দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ কিংবা দেখা সাক্ষাতের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। কিন্তু কে কার সঙ্গে কিভাবে দেখা করবে এ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। অবশেষে কোকোর মৃত্যুর পর এ সুযোগটি সৃষ্টিও হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না দেয়ায় এ সুযোগটি নষ্ট হয়ে যায়। রবিবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টন পিকিং গার্ডেনে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে নেতারা বলেছেনÑ ‘লাথি মার সংলাপে’। তাঁরা জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ১৪ দলের বৈঠকে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘লাথি মার সংলাপকে’। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী সৌভাগ্যবান, আল্লাহ তাঁকে একটা সুযোগ করে দিয়েছেন। না হয়, পরিস্থিতি খারাপ হতো। ত্রাণমন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, পেট্রোলবোমায় মানুষ হত্যা করবেন আর আমরা আপনার সঙ্গে আলোচনা করবÑ এটা চিন্তা করাও আপনার মহাপাপ। আপনার সঙ্গে আলোচনা হবে না। আমরা বলেছি, পাপের শাস্তি আপনি পাবেনই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ হত্যাকারীদের কাছে মাথানত করবে না। প্রধানমন্ত্রী আপনাকে সমবেদনা জানাতে গেলেও অফিসের গেটের তালা খোলেননি, এতেই প্রমাণ পেয়েছে বিএনপি শিষ্টাচারবহির্ভূত রাজনৈতিক দল। খাদ্যমন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ক্রমান্বয়ে আরও ঘুরে দাঁড়াবে। তাদের সঙ্গে কোন আপোস বা আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না, এদের প্রতিরোধ করতে হবে। সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের সরকারী তিতুমীর কলেজে এক অনুষ্ঠানে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দরজা থেকে ফিরিয়ে বিএনপি আবারও একটি সংলাপ ও সমঝোতার সুযোগ হারাল। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার ছেলের মৃত্যুর পর কেউ ভাবেনি শেখ হাসিনা সেখানে যাবেন কিন্তু সেখানে তিনি গেলেন, কারণ তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ মা। ১৫ আগস্ট বিএনপির কেক কাটার অভিজ্ঞতা রয়েছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দেখারও অভিজ্ঞতা আছে তবুও সব কিছু ভুলে প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন মানবতার খাতিরে। কিন্তু বিএনপি যা করেছে তা রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। একই অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দিনের পর দিন আপনি মানুষ পুড়িয়ে কত মায়ের বুক খালি করেছেন আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করেছেনÑ বাংলার ১৬ কোটি মানুষ তার জবাব দেবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক এক অনুষ্ঠানে বলেন, খালেদা জিয়া নিজেই আলোচনা চান না। একদিকে তিনি আলোচনার কথা বলছেন, অন্যদিকে যখন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে শোক জানানোর জন্য তাঁর কার্যালয়ে গেলেন তিনি দেখাই করলেন না। এ থেকে প্রমাণিত হয় তিনি আলোচনা চান না, তাঁর মধ্যে কোন সৌজন্যতাবোধ নেই। মতিঝিলে এক দলীয় অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, শিমুল বিশ্বাসদের মতো বেয়াদব ও মূর্খ লোকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত বলেই বিএনপি নেত্রী আজ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি বলেন, শোকে মুহ্যমান খালেদা জিয়াকে সান্ত¡না দিতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এটা চরম বেয়াদবি। খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে শোক বই নিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কী রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই শোক বইয়ে স্বাক্ষর করতেন? ধানম-ির দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, এ কেমন ইঞ্জেকশন ছিল, যার কারণে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ঘুম ভাঙ্গেনি। আমরা জানি ঘুমের ইঞ্জেকশন দিলে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত এর কার্য়কারিতা থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ফিরে আসার পর খালেদা জিয়া নাকি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শনিবার রাতে বিএনপি নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, তা দেশের রাজনীতি ও সামাজিক-সংস্কৃতিতে কালো দাগ হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না দেয়ার ঘটনায় সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হলে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ কিছুটা হলেও ভাল হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, দুই নেত্রীর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়া শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ হয়েছে। বিএনপিসমর্থক বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, এটা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি কিন্তু আমার মনে হয় এর কারণ হলো ‘ল্যাক অফ কমিউনিকেশন।’ প্রবীণ সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না দেয়া ঠিক হয়নি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে যেভাবে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের জন্য প্লাস পয়েন্ট হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-উর-রশিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী গেট পর্যন্ত গেলেন এবং উনি গেট খুললেন নাÑ এটা জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা মর্মাহত। দেশের মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল, অন্তত দুই নেত্রীর পরস্পরের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ ছিল। খালেদা জিয়া যদি অনুকূল সাড়া দিতেন, সারাদেশের মানুষ খুশি হতো। এ থেকে বোঝা গেল বিএনপি রাস্তার শক্তির ওপর তাদের কর্মকা- চালিয়ে যেতে চায়। বিএনপির এ আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আর কিছু বলার নেই।
×