ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২ জানুয়ারি ২০১৫

অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে অর্থনীতিতে শীর্ষস্থান দখলে নিয়েছে চীন। প্রায় দেড় শ’ বছর পর মার্কিন অর্থনীতি এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, চীনের অর্থনীতির আকার এখন ১১ ট্রিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড। আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ১০ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন পাউন্ডের। ব্যাপক শিল্পায়নের ফলেই চীন শীর্ষস্থানে আসতে পেরেছে বলে অনুমান করছে আন্তর্জাতিক মহলবিশেষ। চীন এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ রফতানিকারক, সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী এবং বিশ্বের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় সঞ্চয়কারী দেশ। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের তথ্যমতে, এক দশক ধরে চীনের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৭.৭৫ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির গড় হার মাত্র আড়াই শতাংশ। চীনের মুদ্রা ইয়ান প্রতিবছর ৩ শতাংশ হারে শক্তিশালী হচ্ছে। গত এক দশকে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান নজর কাড়ার মতো। ২০০৫ সালে চীনের অর্থনীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৪৩ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ সালেই চীনের অর্থনীতির আকার দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ৮৭ শতাংশের সমান। জানা যায়, দেশটির এই উত্থানের পেছনে কাজ করেছে মাত্র কয়েক দশকের শিল্পায়ন। ১৯৭৮ সালে নেয়া অর্থনৈতিক সংস্কারনীতির পর থেকেই চীনের অবস্থা দ্রুত পাল্টাতে থাকে। ওই নীতির মাধ্যমে চীন সরকার মুক্তবাজার অর্থনীতি চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। বৈদেশিক বাণিজ্যেও বরাদ্দ রেখেছিল প্রচুর। এ ছাড়া কৃষকদের জন্য জমির মালিকানা দেয়া ও ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেয় সরকার। ফলে কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ সরাসরি বাজারে বিক্রি করার সুযোগ পায়। দেশটির উপকূলবর্তী চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা হয় অর্থনৈতিক জোন। এর উদ্দেশ্য ছিল বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ, রফতানি বাড়ানো ও প্রযুক্তি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি। সংস্কারের অংশ হিসেবে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয় স্থানীয় সরকারের কাছে। স্থানীয় সরকার মুক্তবাজার নীতি এবং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার নির্দেশনা অনুযায়ী সেগুলো পরিচালনা করে। সাধারণ নাগরিকদের নিজ নিজ ব্যবসা পরিচালনার জন্য দেয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের প্রণোদনা। চীনের অর্থনীতির সুফল পেতে বাংলাদেশকে রফতানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা মনে করেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে রূপ নেয়া চীন স্বল্পমানের পণ্য উৎপাদন থেকে সরে যাবে। চীনের এ সব বিনিয়োগ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঠেলে দেয়া হবে। বাংলাদেশকে এ বিনিয়োগ নিয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশ চীন থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোন সুফল আসবে কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও সরকারের নীতিনির্ধারণীরা মনে করছেন, আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবে চীন। চীনের বড় অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক দিক হিসেবেও দেখছেন তাঁরা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, চীন সহসাই উচ্চমানের পণ্য উৎপাদনের দিকে যাবে। ফলে স্বল্পমানের পণ্য উৎপাদনগুলো ঠেলে দেয়া হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে। সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে সুযোগ নিতে হবে। চীন থেকে বেরিয়ে যাওয়া স্বল্পমানের উৎপাদনের বিনিয়োগগুলো দেশে আনতে পারলে অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আসবে। চীন গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৯ থেকে ১০ শতাংশ ধরে রেখেছে। এতে চীনের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। চীনের অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনার বিষয়টি নির্ভর করছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে আমাদের রফতানির আকার বেড়েছে। চীন কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। এখন আমাদের রফতানি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। চীন বিশ্বের বড় অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। বাংলাদেশে এক বছরে ৫০ ভাগ রফতানি বাড়লে চীন থেকে বছরে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করতে হয়। এ জন্য বিনিয়োগ ও রফতানির সক্ষমতা আরও বাড়িয়ে বাংলাদেশ সেখানে প্রবেশ করতে পারলে ভাল সুবিধা নিতে পারবে। এদিকে চীনের উদ্যোগে গঠিত হতে যাওয়া এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট (এআইআই) ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করল বাংলাদেশ। নতুন এ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার আরও ২০টি দেশের প্রতিনিধি নতুন এ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সমঝোতা স্মারকে সই করেছেন। দেশগুলো হলো- ভারত, চীন, ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, কাজাখস্তান, কুয়েত, লাওস, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, ওমান, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কাতার, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, উজবেকিস্তান ও ভিয়েতনাম। অর্থনীতির দিক থেকে চ্যাম্পিয়ন হওয়া চীন কিভাবে তাদের সফলতা অর্জন করতে পারল, সেদিকে নজর দিতে হবে বাংলাদেশকে। তাদের অর্জনের পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। এ দেশের ছোট ও মাঝারি শিল্প কলকারখানা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশটি তার অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আরেক ধাপ এগিবে যাবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে বাংলাদেশ চীনের মতোই অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে নতুনরূপে আবির্ভূত হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। লেখক : সংবাদকর্মী
×