সিডনির মেলব্যাগ,অজয় দাশ গুপ্ত
আমাদের মন্ত্রী মিনিস্টাররা কি সিংহাসনে বসলে বেপরোয়া বা উগ্র হয়ে ওঠেন? এই আমল বলে নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বল্পদৈর্ঘ্যরে শাসনকাল ব্যতীত সব সময় এই উদগ্রতা দেখে আসছি। মানুষের মন ও মুখ এক হলে অতিকথনও সামলে নেয়া যায়। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বা গোপন কোন অভিসন্ধিজনিত কারণে মুখ ও মন যখন পৃথক হয়ে পড়ে তখন বিষয় জটিল হয়ে পড়ে। সামাল দেয়াও কষ্টের ও শ্রমসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশ ফিরে পাচ্ছে হৃতগৌরব ও ন্যায্য আসন। সে সুযোগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের চোখে দেখা কানে শোনার অভিজ্ঞতা বাড়লেও বাস্তবে ঘটছে বিপরীত। লতিফ সিদ্দিকীর বেলায় তাই দেখলাম আমরা। অন্যদিকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশীরা অস্তিত্ব, জীবন, চাকরি, ভাত, মাছ, পোশাক ও রসগোল্লার মতো অনিবার্য বিষয়ের পাশাপাশি দেশের রাজনীতিকেও মাথায় তুলে রেখেছে, তাঁদের অপার আগ্রহ উৎসাহ আর আতিশয্যে মাঝে মাঝে মনেই হয় না দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে কোথাও আছি। আওয়ামী লীগ বিএনপিতে বিভক্ত প্রবাসী সমাজেও মন্ত্রী মিনিস্টারদের বড় কদর। তাঁরা আসেন দেখেন শপিং করে ফিরে যান। সঙ্গে দ্রব্যসামগ্রী গেলেও আধুনিকতা, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা চায় কিনা বোঝা মুশকিল। এখন তো উচ্চশিক্ষিত ব্যারিস্টার, ডক্টরেট খেতাবধারীদেরও কমটি নেই। বিজয়ের মাসে দেখি গণজাগরণ মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধ প্রয়াত টকশো ব্যক্তিত্বের রাজাকারী আচরণ নিয়েও এরা প্রগল্ভ। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে দেশহিতৈষী সাধারণ মানুষগুলো। দেশের মতো বিদেশেও তাঁরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকান আর সামাজিক নেটওয়ার্কে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ব্যাপারটা এই, আমি যদি কোন সত্য জানি বা সাক্ষী থাকি সময়মতো তা প্রকাশ করতে অসুবিধে কোথায়? আইনমন্ত্রীর বর্তমান ভূমিকা বা সাম্প্রতিক কথাবার্তার পর ঘাপটি মেরে থাকা কথিত জনপ্রিয় মিডিয়াও খাতা খুলছে। অভিজ্ঞ বয়স্ক একদা ভাসানী ন্যাপের সমর্থক পরে সফেদ কফিন পরিহিত বুদ্ধিজীবী বলেছেন, দেশ নাকি অবমাননার এক উপত্যকা। কথায় বলে আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাবে, নিজের দিকে তাকালেই তিনি এ কথা বলতে পারতেন না। কিছুদিন আগেও তাঁকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আলো করে সামনের চেয়ারে উপবিষ্ট দেখেছি। যোগাযোগমন্ত্রী এই ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়েই ভাঙ্গা রাস্তা মেরামত পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সরকারের কফিনে পেরেক ঠোকার প্রাণান্ত চেষ্টাকারীকে এতটা মর্যাদা দেয়ার পরও বলছেন অবমাননা বা অপমানের উপত্যকা। বলুক বা বলিয়ে নিক এটাই তাঁদের আসল চরিত্র। কোন মানুষের হিউমিলিয়েশন বা অবমাননা সমাজের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। যদি সব কিছু ছাড় দিয়ে তা মানি তাহলে ইয়াহিয়া খান বা হিটলারের বেলায়ও তা মানতে হবে। উপসাগরে বিশেষত গাজায় আক্রমণকারীর মৃত্যু হলে কি আমরা তাকে বা তাদের স্বদেশপ্রেমী বলে সাফাই গাইব? দেশে-বিদেশে পরিচিতির মূল জায়গাটাকে আঘাত করতেও হৃদয় কাঁপে না এদের। এ জাতীয় লেখালেখি ও মন্ত্রীর বক্তব্য যখন সমার্থক হয়ে যায় তখন আমরা আদর্শের গুহায় লুকাব না প্রতিবাদ করব? সত্যি বলতে কি তাঁর জন্য ভয় ও ভালবাসা দুটোই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যে আদর্শ ও ন্যায়ের জন্য তিনি নিজের বিপদ তুচ্ছ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাত দিয়েছেন তাঁর প্রতি এমন কটাক্ষ আর দ্বিচারিতা আসলে তাঁকেই দুর্বল ও সঙ্গীহীন করে তোলে। এর একটা প্রতিকার প্রয়োজন। বাংলাদেশে এখন যে নেগেটিভ রাজনীতি ও প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা মন্ত্রীরা আসলে তার শিকার। খেয়াল করুন, ভোট ও লাভালাভের রাজনীতিই এ জন্য দায়ী। মনযোগানো মনোরঞ্জনের কারণে এরা সত্যকে মিথ্যা মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিতে চায়। প্রবাসে বিশেষত আধুনিক ও গণতান্ত্রিক সমাজে জবাবদিহিতাই মুখ্য বিষয়। দেশ, জাতি ও সমাজকে অন্ধ, ধর্মান্ধ, অনুদার করে শাসক দলের কাছে উদারতা আর গণতন্ত্র প্রত্যাশাকারীরা আসলে আমাদের জাতীয় শত্রু। এই শত্রুতা দীর্ঘমেয়াদে যে সব বিরোধ ও তর্কের দুয়ার খুলে দিচ্ছে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য।
আগেও লিখেছি শুধু অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ হবে না। ফসল ঘরে তুলতে হলে আচরণগত পরিবর্তন জরুরী। দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগের ওপরের মহলে তা নেই। থাকলে বিশিষ্টজনরা এমন আচরণ বা কথাবার্তায় মগ্ন হতে পারতেন না। অস্ট্রেলিয়ার সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে না। তার পেছনে থাকে ইন্ধন, প্রলোভন ও দায়হীনতা। আইনের কঠোরতা সমাজের শৃঙ্খলা আর উদার দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে হয়ত এমন কিছু হতো না। মন্ত্রী থেকে আমলা বা কলামিস্ট সব জায়গায় সর্বক্ষেত্রে এই প্রবণতা ভয়ের।