ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

রাজশাহী নগরীর অন্ধকার দূর করলেন মাহাফুজ মানিক: এক তরুণের আলোকিত উদ্যোগ

ইব্রাহীম হোসেন সম্রাট, কন্ট্রিবিউিটিং রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ২০:২৩, ৩১ জুলাই ২০২৫

রাজশাহী নগরীর অন্ধকার দূর করলেন মাহাফুজ মানিক: এক তরুণের আলোকিত উদ্যোগ

রাজশাহী মহানগরী যেখানে ‘আলোর শহর’ নামে পরিচিত, তার পাড়া-মহল্লাগুলো দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে নিমজ্জিত। গত ২৯ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত “রাজশাহী নগরীর সড়কে ঝলমলে আলো, পাড়া-মহল্লা অন্ধকার!” শিরোনামের সংবাদে উল্লেখ করা হয়, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ল্যাম্পপোস্টের লাইটের অভাব ও অকার্যকর অবস্থার কারণে সন্ধ্যার পর পথচারীদের চলাচল দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের শিরোইল কলোনির মেডিকেল মোড় থেকে হাজরাপুকুর মোড় পর্যন্ত সড়কটি অন্ধকারে ডুবে থাকায় চুরি, ছিনতাই ও ইভটিজিংয়ের ঘটনা বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মোঃ মাহাফুজ মানিক, আরাফাত রহমান কোকো ক্রীড়া পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং চন্দ্রিমা থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি নিজ অর্থায়নে ১০টি ল্যাম্পপোস্টে এনার্জি-সাশ্রয়ী এলইডি লাইট স্থাপন করে এলাকাবাসীর প্রশংসায় ভাসছেন।

গত আগস্ট ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। পাড়া-মহল্লায় ড্রেনে পচা দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা, জঙ্গল ও ঝোপঝাড়ের সৃষ্টি হয়েছে, যা মশার উপদ্রবকে চরমে তুলেছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া, বৈদ্যুতিক পোলগুলোর বেশিরভাগই বাল্ববিহীন বা অকেজো। মতিহার থানার কাজলা, অক্ট্রয়মোড়, বাজেকাজলা, ধরমপুর, মৃধাপাড়া, জাহাটঘাট এবং শাহমখদুম থানার বড়-বনগ্রামের মতো এলাকাগুলো সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ডুবে থাকে। ফলে চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং এবং মাদকসংক্রান্ত অপরাধ বেড়ে চলেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা বিশাল (রাসিক ২৪ নম্বর ওয়ার্ড) জানান, “গত ছয় মাস ধরে আমাদের এলাকার বৈদ্যুতিক পোলের বাল্ব নষ্ট। অন্ধকারের সুযোগে মাদক কারবারিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মা-বোনদের ইভটিজিংয়ের ঘটনা বেড়েছে। গত শনিবার আমাদের এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে সাবমার্সিবল পানির মেশিন চুরি হয়েছে।” টিকাপাড়ার বাসিন্দা আরিফুজ্জামান বলেন, “গত রবিবার আমাদের পাশের বাড়ির তিনতলা থেকে এসির কনডেন্সার ইউনিট চুরি হয়েছে। পুলিশের টহল নেই বললেই চলে।” বোয়ালিয়া থানার পাঁচনিমাঠের বাসিন্দা রুবেল জানান, “তিন দিন আগে মধ্যরাতে আমাদের এলাকায় বৈদ্যুতিক তার চুরি হয়েছে। ওয়ার্ড সচিবকে বারবার বলেও কোনো সমাধান পাইনি।”

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) বৈদ্যুতিক পোলের লাইট সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে বিদ্যুৎ শাখার প্রধান কর্মকর্তা এবিএম আসাদুজ্জামান সুইট জানান, “বর্তমানে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত লাইটের মজুদ নেই। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাড়ে সাত হাজার লাইটের টেন্ডার হয়েছিল, যা শেষ হয়ে গেছে। আগামী ৪ আগস্ট টেন্ডার ওপেন হবে এবং ১০ আগস্টের মধ্যে লাইটের মজুদ নিশ্চিত করা হবে।” তবে, স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, প্রশাসনিক জটিলতা ও সমন্বয়ের অভাবে এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত রয়েছে।

এছাড়া, গণঅভ্যুত্থানের পর রাসিকের ওয়ার্ডগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সাবেক কাউন্সিলর মোঃ আশরাফুল হাসান বাচ্চু (২৮ নম্বর ওয়ার্ড) বলেন, “একজন কাউন্সিলর স্থানীয় সমস্যা সমাধানে যেভাবে কাজ করেন, সরকারি কর্মকর্তারা তা পারেন না। নাগরিকরা এখন সামান্য সনদপত্র নিতেও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।” উদাহরণস্বরূপ, শাহমখদুম থানার বড়-বনগ্রামের বাসিন্দা মোঃ আবির শেখ জানান, রুয়েটে চাকরির আবেদনের জন্য নাগরিক সনদপত্র নিতে তাকে ১০ দিন ধরে ওয়ার্ড কার্যালয়ে ঘুরতে হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঢাকায় থাকায় তিনি সনদপত্র পাননি এবং চাকরির আবেদন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মোঃ মাহাফুজ মানিক নিজ উদ্যোগে শিরোইল কলোনির মেডিকেল মোড় থেকে হাজরাপুকুর মোড় পর্যন্ত সড়কে ১০টি ল্যাম্পপোস্টে এনার্জি-সাশ্রয়ী এলইডি লাইট স্থাপন করেছেন। তিনি ওয়ার্ড সচিবের সঙ্গে আলোচনার পর জানতে পারেন, সীমিত বাজেটের কারণে লাইট স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। তখনই তিনি নিজ খরচে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন চন্দ্রিমা থানা যুবদলের সিয়াম, রানা, ফরহাদ, সোহান; ১৯ নম্বর দক্ষিণ ছাত্রদলের সভাপতি নয়ন; বরেন্দ্র কলেজ ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জিম; ছাত্রদল নেতা খালেদ, সিফাত; এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য রমজান, রাসেল, রাব্বি। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এই উদ্যোগে উপস্থিত ছিলেন।

মানিক জানান, “জনসাধারণের নিরাপত্তা ও সুবিধার জন্য আমি মানবিকতার জায়গা থেকে কাজ করেছি। দলমত নির্বিশেষে যুবসমাজকে সমাজসেবায় এগিয়ে আসতে হবে। মাদক ও সামাজিক অপরাধ রোধে আমরা সবসময় সচেষ্ট থাকব।” তিনি প্রায় ৫০,০০০ টাকা ব্যয়ে এই লাইটগুলো স্থাপন করেছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ খরচ কমাবে।

মানিকের এই উদ্যোগে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা উচ্ছ্বসিত। স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বলেন, “এই আলোর কারণে আমাদের দোকান বন্ধ করতে এখন আর ভয় লাগে না। নিরাপত্তার অনুভূতি বেড়েছে।” গৃহিণী সাবিনা খাতুন বলেন, “বাচ্চারা এখন সন্ধ্যায় নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারছে। এমন উদ্যোগ আরও দরকার।” স্থানীয় শিক্ষক মো. আব্দুল হাকিম বলেন, “মানিকের এই কাজ দেখিয়েছে, তরুণরা চাইলে সমাজে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।”

এই উদ্যোগ কেবল শিরোইল কলোনিকে আলোকিত করেনি, বরং রাজশাহীর অন্যান্য ওয়ার্ডের জন্যও একটি উদাহরণ স্থাপন করেছে। স্থানীয়রা দাবি জানিয়েছেন, রাসিকের উচিত এই ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় করে টেকসই আলোক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। মানিক জানান, তিনি ভবিষ্যতে আরও ল্যাম্পপোস্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় এই প্রকল্পকে বড় পরিসরে নিয়ে যেতে চান।

মোঃ মাহাফুজ মানিকের উদ্যোগ রাজশাহী নগরীর অন্ধকারাচ্ছন্ন পাড়া-মহল্লায় আলোর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিনি প্রমাণ করেছেন, তরুণরা সমাজের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। এই উদ্যোগ অন্যান্য তরুণদের সমাজসেবায় এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করবে এবং রাজশাহীকে সত্যিকারের ‘আলোর শহর’ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হবে।

Mily

×