ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

শেরপুরের ‘পৌনে তিন আনি’ জমিদারবাড়ি: হারাতে বসেছে ইতিহাস

মারুফুর রহমান, শেরপুর

প্রকাশিত: ১৮:২৪, ৩১ জুলাই ২০২৫

শেরপুরের ‘পৌনে তিন আনি’ জমিদারবাড়ি: হারাতে বসেছে ইতিহাস

শেরপুর শহরের বুকজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘পৌনে তিন আনি’ জমিদারবাড়িটি একসময়ের ঐশ্বর্যপূর্ণ জমিদার ইতিহাসের জীবন্ত নিদর্শন। উনিশ শতকে নির্মিত এই স্থাপত্যটি আজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমেই জীর্ণ হয়ে পড়ছে। স্থানীয়দের ভাষায়, এটি শুধু একটি বাড়ি নয়, বরং একটি কালের দলিল, যা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, কিশোরী মোহন চৌধুরীর সময়কালে রাজবাড়ির নির্মাণ শুরু হয়। পরবর্তীতে সত্যেন্দ্র মোহন ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী—এই দুই ভাই এ বাড়ির পূর্ণতা দেন। দুই ভাইয়ের একাধারে ছিল শিক্ষাগ্রহণ, রুচিশীলতা ও সৌন্দর্যপ্রেম। তাদের হাতে গড়া বাগান, মন্দির, রংমহল, শীষমহল ও বিশাল পুকুরগুলোর স্থাপত্যরীতি ও কারুকাজ আজও দর্শকদের মুগ্ধ করে।

জমিদারবাড়ির স্থাপত্যে গ্রিক শৈলীর প্রভাব লক্ষণীয়। চুন-সুড়কির নিপুণ ব্যবহার, স্তম্ভে খোদাই করা কারুকাজ, মার্বেল টাইলসে মোড়ানো সিঁড়ি—সবকিছুতেই ফুটে উঠেছে ইতিহাস ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধন। বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত রংমহল ছিল নাচ-গানের প্রধান কেন্দ্র। আর মূল ফটকের বিশাল প্রবেশপথ, শানবাঁধানো ঘাট এবং পাশের পুকুরটি এই স্থাপনাটিকে পরিণত করেছে একটি আকর্ষণীয় ও পূর্ণাঙ্গ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে।

শেরপুর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের অফিস সহায়ক মো. ফজলুল করিম জানান, “আমরা চেষ্টা করছি এই পুরাতন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে। কিন্তু বাইরে থেকে কিছু লোকজন প্রবেশ করে স্মৃতিচিহ্নগুলো নষ্ট করছে, এমনকি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।”

ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কৃষিবিদ মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা বহুবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জানিয়েছি। কিন্তু যেহেতু এটি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের আওতায় রয়েছে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সরাসরি সংস্কারে এগোতে পারছে না। এ জটিলতা দূর না হলে কার্যকর সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, বাড়িটির ডিজিটাল নথিভুক্তি, জরিপ এবং সংস্কার এখনই শুরু করা জরুরি। স্থাপত্যের মূল্যায়ন করে কাঠামোগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে একে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া সম্ভব। বাড়ির একাংশ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করাও একটি বাস্তবসম্মত প্রস্তাব।

স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা চাইলে এটি শেরপুরের অন্যতম পর্যটন স্পট হতে পারে। বাড়িটির চারপাশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, নিরাপত্তা এবং ইতিহাসভিত্তিক তথ্যচিত্র সংযোজন করলে দর্শনার্থীরা আরও আগ্রহী হবেন। শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগে সম্পৃক্ত করাও সময়ের দাবি।

  

শেরপুরবাসীর প্রাণের এই জমিদারবাড়ি এখন নিঃশব্দে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। এর সৌন্দর্য, কারুকার্য ও অতীত জৌলুশ এক অনন্য সম্পদ, যা হারিয়ে গেলে তা হবে শুধু শেরপুর নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি। 

সানজানা

×