ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টেকসই বেড়িবাঁধ : উপকূলবাসীর প্রাণের দাবি

আজিজুল হাকিম রাকিব, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০১:৩২, ১২ জুন ২০২৫

টেকসই বেড়িবাঁধ : উপকূলবাসীর প্রাণের দাবি

ছবি: জনকন্ঠ

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি  বছর এখানে ছোট-বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঘূর্ণিঝড় এবং এর ফলে সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে উপকূলীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ছোট-বড় সবমিলিয়ে গড়ে ৫ টি ঘূর্ণিঝড় প্রতিবছর আঘাত হানে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের ফলে হওয়া ক্ষতির অঙ্ক ও নেহায়েত কম নয়।

বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের মানুষের কাছে সব থেকে বড় আতঙ্কের নাম ঘূর্ণিঝড়। প্রতিবছরের ঘূর্ণিঝড় তাদের তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পদের ক্ষতি করে। উপকূলের মানুষ একটি ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে যখনই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে ঠিক তখনই আরেকটি ঘূর্ণিঝড় এসে তাদেরকে নিঃস্ব করে দেয়। এভাবেই বছরের পর বছর প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক অসম লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে উপকূলের মানুষ।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে বিগত বছরগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ এবং এর ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর যথেচ্ছ কার্বন নিঃসরণের মূল্য চোকাতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উপকূলের বাসিন্দাদের। শিল্পোন্নত দেশগুলো যখন নিজেদের দায় এড়াতে ব্যস্ত ঠিক তখন বাংলাদেশ উপকূলের মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত। 

দক্ষিণবঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা সব থেকে বড় সমস্যার কারণ। ঘূর্ণিঝড়ের সময় উক্ত অঞ্চলের দুর্বল বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে লবণ পানি। যা তাদের ফসলের মাঠ, মাছের ঘের এবং রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি প্লাবিত করে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর।

বাংলাদেশের উপকূলের সব থেকে বড় সমস্যা হলো দুর্বল বেড়িবাঁধ এবং তা ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করা। উপকূলের বেশিরভাগ এলাকাই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিবছরই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সরকার তহবিল দিলেও সঠিক তদারকি ও জবাবদিহিতার অভাবে এর সুফল উপকূলের মানুষ পাচ্ছে না। তৈরি হচ্ছেনা টেকসই বেড়িবাঁধ, প্রত্যেক অর্থবছরে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ এই খাত থেকে আত্মসাৎ করে নিচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

এভাবেই বছরের পর বছর বেড়িবাঁধের আশায় থাকছে উপকূলের বাসিন্দারা। লবণ পানি লোকালয়ে ঢুকে স্থানীয়দের সর্বস্ব কেড়ে তো নিয়ে যাচ্ছেই সেই সাথে লবণ পানির কারণে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া কৃষিজমিগুলো লবণাক্ত হয়ে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। যদি চাষ করা সম্ভব হয়ও তবুও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছেনা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে। জীবিকা হারিয়ে অনেকেই জড়িত হয়ে পড়ছে বেআইনি কাজে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অনলাইন জুয়া।

ইন্টারনেট প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে দেশের প্রায় সব অঞ্চল এখন ইন্টারনেটের আওতাভুক্ত। উপকূল অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই উপকূলের বেকার তরুণরা যুক্ত হয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়ায়। এসব অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইটের স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমেই তরুণরা এসব সাইটে যুক্ত হচ্ছে। জুয়া খেলা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও তারা আইনের তোয়াক্কা না করেই এসব ওয়েবসাইটে জুয়া খেলে চলেছে। জুয়া খেলার ফলে এসব তরুণরা একসময় হয়ে যায় ঋণগ্রস্ত এবং নিঃস্ব। তারপর তারা জড়িয়ে পড়ে মাদক ব্যবসা, চুরি এবং খুনের মতো অপরাধের সাথে যা এ অঞ্চলের শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করছে।

এছাড়াও নিজেদেরকে রক্ষা করার মতো টেকসই কোনো উপায় না পেয়ে এ অঞ্চলের মানুষ হয়ে উঠছে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আসা সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু তারা ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না এবং নিজেদের জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম হারাচ্ছে তাই তারা ত্রাণ অথবা সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ত্রাণ এবং বিভিন্ন ধরনের সাহায্যের সঠিক বণ্টন না হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেশ অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্নীতি এবং তালিকা প্রস্তুতকরণের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির কারণে ত্রাণ এবং অন্যান্য সাহায্য এ অঞ্চলের শতভাগ জনগণের নিকট পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের সকলকে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় এবং এর ফলে সৃষ্ট বন্যার পরে সবার টনক নড়তে দেখা যায়। অথচ সারাবছর এই অঞ্চলের মানুষের খোঁজখবর নেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যায় না। এই অঞ্চলের মানুষের সকল ভোগান্তির মূলে রয়েছে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকা। টেকসই বেড়িবাঁধ থাকলে হয়তো এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতো এবং ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।

ত্রাণ এবং সাহায্য দেওয়া কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এ অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। তারা এখন এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান চায় অর্থাৎ স্থায়ী বেড়িবাঁধ চায়। তাই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে যথাযথ তদারকির মাধ্যমে স্থায়ী এবং টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।

Mily

×