ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এবার কোরবানির হাট কাঁপাচ্ছে ‘তুফান’

গিয়াসউদ্দিনফরহাদ, নোয়াখালী

প্রকাশিত: ২১:১৫, ২৪ মে ২০২৫

এবার কোরবানির হাট কাঁপাচ্ছে ‘তুফান’

এবার কোরবানির ঈদে হাট কাঁপাচ্ছে নোয়াখালীর ‘তুফান’। কোরবানির হাটে তোলার আগেই নোয়াখালীতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান জাতের এক বিশালদেহী ষাঁড় ‘তুফান’। বয়স মাত্র ২৫ মাস, আর ওজনও ২৫ মণ! অসংখ্য ক্রেতা সাধারণের কৌতূহল আর আগ্রহে দিন দিন ভিড় বাড়ছে ‘ডাক্তার অ্যাগ্রো ফার্মে’। কারণ, শুধু আকারে নয়, আচরণ আর খাদ্যতালিকায়ও এই ষাঁড় যেন একেবারে রাজকীয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, আসন্ন ঈদুল আজহায় তুফান হতে যাচ্ছে জেলার সবচেয়ে বড় কোরবানির গরু। তুফানের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকাও বেশ রাজকীয়। অন্যান্য প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি খায় আপেল, কমলা, মাল্টাসহ নানা জাতীয় পুষ্টিকর ফল। লম্বায় সাড়ে ৯ ফুট ও ৬ ফুট উঁচু হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের এই গরুটি ইতিমধ্যে নজর কেড়েছে পুরো জেলার ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ ভিড় করছে তাকে দেখতে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরুটির দাম ১২ লাখ টাকা হাঁকছেন মালিক আবুল কালাম আজাদ।

জানা যায়, প্রায় ২৪ বছর ধরে নোয়াখালীর এওজবালিয়া ইউনিয়নের করমূল্যা এলাকায় ডাক্তার অ্যাগ্রো নামের খামার পরিচালনা করে আসছেন আবুল কালাম আজাদ। এই খামারেই নোয়াখালীর তুফানের বসবাস। শখের বশে তিনি ৫ মাস আগে চট্টগ্রাম থেকে হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান ষাড়টি কিনে এনেছেন। বর্তমানে ষাঁড়টির বয়স ২৫ মাস হলেও তার ওজনও দাঁড়িয়েছে ২৫ মণে। প্রতিমাসে এক মণের বেশি ওজন বাড়ে তুফানের।

প্রতিবেশী সোহরাব উদ্দিন বলেন, বিশাল আকৃতির গরু তেমন আমাদের গ্রামে দেখা যায় না। তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এই তুফানকে দেখতে আসছে। দর-দামে এখনও মিলছে না। তবে ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসবে ক্রেতারা তুফানকে দেখতে ভিড় করবে। আমরাও চাই মালিক যেন ন্যায্য দামে গরুটিকে বিক্রি করতে পারেন।

খামারের মালিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি একজন ডাক্তার। প্রায় ২৪ বছর আগে এখানে আমি খামার স্থাপন করি। খামারটি সবাই ডাক্তার এগ্রো নামেই চিনে। আমার এখানে এবার আলোচিত গরু হলো তুফান। তার আচরণের কারণেই আমার ছেলে তুফান নাম রেখেছে। শখ করে মাত্র পাঁচ মাস আগে চট্টগ্রাম থেকে গরুটিকে কিনে এনেছি। তখনই বুঝেছিলাম, এটি সাধারণ গরু নয়। প্রতিমাসে ১ মণের বেশি ওজন সে লাভ করে। বর্তমানে তার স্বভাব পূর্বের তুলনায় অনেক ঠান্ডা হয়েছে। প্রতিনিয়ত এক নজর তুফানকে দেখতে মানুষ ভিড় করে এগ্রো ফার্ম। 

তিনি আরও বলেন, তুফানকে আমরা প্রাকৃতিক উপায়ে বড় করেছি। খাবার হিসেবে প্রতিদিন দেওয়া হয় ঘাস, কলাইয়ের ডাল, খৈল, গাজর, ভুসি এবং ফলমূলের মধ্যে আপেল, কমলা ও মাল্টা। তার পেছনে প্রতিমাসে ৫০-৫৫ হাজার টাকার খাবার যায়। আমি সব প্রাকৃতিক খাবার দিই। তার পরিচর্যায় আছে আলাদা লোক, নিয়মিত গোসল করানো হয় ও পরিচ্ছন্ন রাখা হয় পরিবেশ। একজন ক্রেতা ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম বলেছেন। তবে এখনও বিক্রির সিদ্ধান্ত নিইনি। সামনে কোরবানির হাটে তুললে দাম আরও বেশি হতে পারে বলেও অনেকে বলছেন। তবে ষাড়টি যদি প্রজননের জন্য রাখা যায় তাহলে আমাদের দেশ অনেক উপকৃত হবে।

নোয়াখালী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. তাসলীমা ফেরদৌসী বলেন, সম্ভবত এটাই জেলার সবচেয়ে বড় গরু। তার ভ্যাকসিন থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। তুফান প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠলেও তার সঠিক পরিবেশ এখানে নেই। যদি সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা যায় তাহলে আবুল কালাম আজাদ সফল খামারি হবেন। আমরা তাকে সব সময় পরামর্শ দিয়ে থাকি।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রাণিসম্পদ বিভাগ ছোট-বড় সব আকারের গরু পালনকারীদের পাশে থেকে সার্বিক সহযোগিতা করছে। এবছর জেলায় চাহিদার বেশি কোরবানির পশু রয়েছে। আমরা আশা করি খামারিরা লাভবান হবেন। হাটে গরু কেনার পাশাপাশি খামারে গরু কেনায় মানুষের আগ্রহ রয়েছে।

এদিকে বৃহত্তর নোয়াখালীর ঐতিহ্যবাহী পশুর হাট হাতিয়া বাজার। এটি নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার হরণী ইউনিয়নে অবস্থিত। হাটটি এখন স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিতে রূপ নিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে দুইবার বসা এই পশুর হাটে গরু-মহিষের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। প্রতিহাটেই বেচাকেনা হয় লক্ষ লক্ষ টাকার গরু।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার বসা এই হাটে গড়ে প্রায় চার হাজারের অধিক গরু-মহিষ-ভেড়া-ছাগল তোলা হয়। যার মধ্যে প্রায় দুই হাজারেরও অধিক গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া বিক্রি হয়ে যায় মাত্র একদিনেই। প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে ওঠা স্থানীয় প্রান্তিক খামারিদের লালন-পালন করা দেশি জাতের স্বাস্থ্যবান গরু ও মহিষ এই হাটে তোলা হয়। এসব গরুর সুনাম ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। ফলে চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা নিয়মিত এই হাটে আসেন গরু কিনতে। গরুর গুণগত মান, সাশ্রয়ী দাম ও পরিবেশ— সব মিলিয়ে ক্রেতাদের জন্য এই হাট একটি নির্ভরযোগ্য গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

এই হাট ঘিরে হাজারো খামারির জীবনে এসেছে অর্থনৈতিক স্বস্তি। তারা এখন স্বপ্ন দেখেন উন্নত জীবনযাপনের, সন্তানদের পড়াশোনা করানোর, বাড়ি নির্মাণের। অনেক খামারি এখন পারিবারিকভাবে গরু পালনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পশুপালনের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও।

হরণী ইউনিয়নের এই পশুর হাট শুধু অর্থনীতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি এলাকার হাজারো খামারির জীবন ও জীবিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে গবাদিপশু বিক্রির মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে এই হাট। বিশেষ করে কোরবানির মৌসুম এলে এই হাটে বেচাকেনার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।

স্থানীয়দের দাবি, সরকারি সহায়তা এবং ভেটেরিনারি সেবার আরও উন্নয়ন হলে এই হাট বড় পরিসরে বিস্তার লাভ করতে পারে। পাশাপাশি পশু পরিবহনের জন্য একটি আধুনিক ঘাট নির্মাণ, পর্যাপ্ত শেড ও পানির ব্যবস্থা থাকলে হাটটি দেশের অন্যতম মডেল হাটে পরিণত হতে পারে।

দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারা জানান, হাতিয়ার গরু স্বাস্থ্যবান ও তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায়। এখানকার গরুতে ওষুধ বা কৃত্রিম মোটাতাজাকরণ থাকে না, এজন্য চাহিদাও বেশি। এখান থেকে নিয়ে আমরা পাশ্ববর্তি জেলার বিভিন্ন হাটে বেশি দামে বিক্রি করি। আমরা এতে ভালোই লাভবান হই।

হরণী ইউনিয়নের এক বাসিন্দা বলেন, চরের অনেক পরিবার আছে যারা সারা বছর ২/৩ টা গরু লালনপালন করে কোরবানির জন্য হাতিয়া বাজার পশুর হাটে বিক্রি করেন। সেই বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে পারিবারিক চাহিদা পূরণ করেন। তবে পশুগুলো বিক্রির সময় তাদের অনেকে কান্না করতেও দেখা যায়। 

হাটের ইজারাদার আমিরুল ইসলাম মতিন বলেন, আমরা হাটে আগত ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য যথাসম্ভব নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা নিয়মিত মনিটরিং করি, যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে।

মুমু

×