
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেকের যোগাযোগ ব্যবস্থা হলেও সেটি খাগড়াছড়ি জেলা দিয়ে পরিচালিত। খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৬৯ কিলোমিটার। পথিমধ্যে চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি নদী কাচালং-মাচালং এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার অনুপম দৃশ্য।
সাজেকের সুউচ্চ পাহাড়ে দাঁড়ালে মনে হয় যেন আকাশের কাছাকাছি চলে এসেছেন। অনেক সময় কল্পনাবিলাসী মনের অজান্তেই হাত চলে যায় আকাশ ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষায়। আর নিচের দিকে তাকালে মনে হয়, “এত উপরে উঠলাম কীভাবে!”
সাজেকের আবহাওয়ার বৈচিত্র্যও কম নয়—কখনো নীল আকাশ, কখনো কালো মেঘের ভেলা, কোথাও ঝুম বৃষ্টি আবার কোথাও প্রচণ্ড রোদ। সাজেকের শেষ প্রান্ত কংলাক, যা রুইলুই থেকে দেড় ঘণ্টার হাঁটার পথ। কংলাক পেরোলেই ভারতের মিজোরাম।
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদসহ বহু মন্ত্রী, এমপি, বিশিষ্ট নাগরিক ও শীর্ষ পর্যটক ‘বাংলার দার্জিলিং’ খ্যাত সাজেকে ছুটে এসেছেন।
সাজেক একসময় ছিল দুর্গম জনপদ। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষের কাছে সাজেকে যাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। তবে, সৃষ্টিকর্তার নিপুণ সৃষ্টি ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতের ছোঁয়ায় সাজেক আজ বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
২০১৪ সালের প্রথম সপ্তাহে খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের আওতাধীন রুইলুই পাড়ায় শুরু হয় রুইলুই জুনিয়র হাই স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর একটি স্কুল পেয়ে ২০টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ যেন হাতে পেয়েছে সোনার হরিণ।
এর আগেই নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সেনাবাহিনী নির্মাণ করে ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাগড়াছড়ি-দিঘীনালা-সাজেক সড়ক। এই সড়ক ও সাজেক পর্যটন কেন্দ্রের নির্মাণ স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে।
সাজেকের রাস্তার পাশে তৈরি হয়েছে ফুটপাত, বসানো হয়েছে সোলার স্ট্রিট লাইট, সন্ধ্যা নামতেই যা আলোকিত করে পুরো এলাকা। রাস্তার দু’পাশে নির্মাণ করা হয়েছে অর্ধ-শতাধিক পুনর্বাসন ঘর, যেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবারগুলো পুনর্বাসিত হয়েছে।
পোর্টেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটানো হয়েছে। তাছাড়া সরকারিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ক্লাব হাউজ, গির্জা, মন্দিরসহ অনেক প্রকল্প।
এসব উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি মেজর জেনারেল সাব্বিরুল ইসলাম। সাজেকবাসীর প্রতি তাঁর অবদানের জন্য রয়েছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সাজেকে তৈরি হয়েছে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্র। সেনাবাহিনী পরিচালিত দুটি রিসোর্ট—সাজেক রিসোর্ট ও রুন্ময় রিসোর্ট ছাড়াও বেসামরিক রিসোর্টগুলোর মধ্যে হ্যারিজন গার্ডেন, ছায়াবীথি, রংধনু ব্রিজ, পাথরের বাগান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে একাধিক বিশ্রামাগার ও ক্লাবঘর। বর্তমানে সাজেকের পর্যটন খাতে প্রায় ৩০০ জন সরাসরি কর্মরত। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর রুইলুই প্রকল্পে কাজ করছেন ২৪ জন। তারা আগে বেকার ছিলেন বা জুমচাষে যুক্ত ছিলেন।
পরোক্ষভাবে আরও শতাধিক লোক এই পর্যটন খাতের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সেনাবাহিনীর সহায়তায় সাজেকের পাংখোয়া, লুসাই ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী উন্নত জীবনমানের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছেন। কর্মসংস্থান ও আর্থিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে বদলে যাচ্ছে তাঁদের জীবন।
এক কথায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতের ছোঁয়ায় সাজেক আজ দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
মিমিয়া