ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গাইবান্ধার স্বাদ: রসমঞ্জুরি আর পোড়া চায় সুখের গল্প

মোঃ মাসুম পারভেজ, কন্ট্রিবিউটর রিপোর্টার, গাইবান্ধা

প্রকাশিত: ০১:৩৪, ২৪ মে ২০২৫

গাইবান্ধার স্বাদ: রসমঞ্জুরি আর পোড়া চায় সুখের গল্প

গাইবান্ধা শুধু ভৌগোলিক পরিচয় নয়—এখন এটি দেশের অন্যতম স্বাদের কেন্দ্রও। এখানকার দুইটি পণ্য এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। একদিকে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন রসমঞ্জুরি, অন্যদিকে স্বাদে আলাদা বৈচিত্র্য আনা পোড়া চা। এই দুই পণ্য গাইবান্ধার সংস্কৃতি ও সাধের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

রসমঞ্জুরির ঘ্রাণে গাইবান্ধার প্রাণ

রসমঞ্জুরি—নামেই যেন এক মধুরতা। দুধ, ছানা, এলাচি ও ময়দার সংমিশ্রণে তৈরি হয় এই অনন্য মিষ্টান্ন। প্রতিটি রসমঞ্জুরির পেছনে থাকে দীর্ঘ প্রক্রিয়া: আড়াই কেজি দুধ, ১০০ গ্রাম চিনি, ২৫ গ্রাম ময়দা, আর ২০০ গ্রাম ছানা মিশিয়ে ছোট ছোট রসগোল্লার মতো বল তৈরি করে সেগুলো দুধে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় ঘন ক্ষীর—যার মাঝে ভেসে থাকে সাদা-ময়লা ছোট ছোট স্বাদের মার্বেল।

১৯৪০ সালে রাম মোহন দে প্রথম গাইবান্ধায় বানিয়েছিলেন এই মিষ্টি। এরপর থেকেই এটি জেলার গর্ব হয়ে ওঠে। এখন শুধু গাইবান্ধার দোকানে নয়—অনলাইনের স্মার্ট বাজারের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে বিক্রি হচ্ছে এই রসমঞ্জুরি। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্তে ক্রেতারা নিজ উদ্যোগেই নিচ্ছেন এই মিষ্টি।

চাহিদা বেড়েছে এতটাই যে ‘গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডার’-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন বাড়তি বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হচ্ছে। যদিও উৎপাদন খরচ বেড়েছে দুধ ও চিনির মূল্য বৃদ্ধির কারণে, তবু এই মিষ্টির প্রতি মানুষের ভালোবাসা কমেনি একটুও।

পোড়া চা ছড়িয়ে পড়েছে আরেক গন্ধ, জীবনের গল্পে লেগেছে সাফল্যের স্বাদ

গাইবান্ধার আরেক বিস্ময়—পোড়া চা। মধ্য রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের ফয়জার রহমান ২০২০ সালে এই বিশেষ চায়ের শুরু করেন। তাঁর বিশেষত্ব ছিল চায়ের কাপে। মাটির তৈরি কাপকে আগুনে পুড়িয়ে নেওয়ার পর, সেখানে ঢালা হতো দুধ, চিনি ও চাপাতি দিয়ে তৈরি ঘন চা। সেই পোড়া কাপ থেকে উঠে আসা ধোঁয়া আর স্বাদের আলাদা ঘ্রাণ আজ গাইবান্ধাবাসীর অহংকার।

ফয়জারের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সাদেকুল ইসলাম বাবার সেই দোকান ‘ফয়জার টি স্টল’ চালিয়ে যাচ্ছেন আরও বৃহৎ পরিসরে। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে ১০ মণ দুধের চা, যার প্রতি কাপের দাম এখন ৩০ টাকা। ছোট ভাই, স্ত্রী, মা ও সন্তানদের নিয়ে গড়ে উঠেছে তার সুখের সংসার।

এই দোকানে শুধু চা নয়, জড়ো হয় গল্প, মুখরোচক আলাপ আর গন্ধে-ভরা সন্ধ্যা। চায়ের কাপের ধোঁয়ার মতোই ছড়িয়ে পড়ছে ফয়জারের চায়ের গল্প। এখন প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে, আর দিনভর ভিড় লেগেই থাকে।

স্বাদে ভরা নতুন সম্ভাবনার পথ

গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি, পোড়া চা ও মরিচ-ভুট্টার মতো পণ্যের চাহিদা ও গুণমান ধরে রাখতে স্থানীয় উদ্যোক্তারা স্মার্ট বাজার তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এখন দেশ–বিদেশের ক্রেতারাও সহজেই এসব পণ্য কিনতে পারবেন। স্লোগানও তৈরি হয়েছে নতুনভাবে—
“স্বাদে ভরা রসমঞ্জুরির ঘ্রাণ, চরাঞ্চলের ভুট্টা-মরিচ গাইবান্ধার প্রাণ।”

এই স্লোগান শুধু পণ্যের পরিচয় নয়—এটি গাইবান্ধার আত্মপরিচয়।

 

রাজু

×