ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চালিতাবুনিয়ায় ভিটেবাড়ি হারা মানুষের নীরব আর্তনাদ

গাজী সালাহ উদ্দীন আবিদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, (পটুয়াখালী)

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ২৩ মে ২০২৫

চালিতাবুনিয়ায় ভিটেবাড়ি হারা মানুষের নীরব আর্তনাদ

ছবি: জনকণ্ঠ

“কোথায় যামু, কুম্মে যামু, কি করমু এহন আল্লাহ-ই ভালো জানেন, জাগা-জমি তো সবই নদীতে। আর কিচ্ছু নাই আমাগো।” — নদীর তীরে দাঁড়িয়ে চিরচেনা ভিটেমাটি হারিয়ে ফেলা রেনু বেগমের চোখে ছিল এক শূন্য দৃষ্টি। হারানোর বেদনা তাকে বারবার টেনে আনে আগুনমুখা নদীর তীরে, যেখানে আজ শুধুই স্মৃতি। গত এক দশকে তিনবার হারিয়েছেন নিজের ভিটেবাড়ি, হারিয়েছেন স্বপ্ন, হারিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়।

চালিতাবুনিয়া—উপকূলীয় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ইউনিয়ন। এক সময় যেখানে ছিল হাজারো পরিবারের ঘরবাড়ি, জমিজমা, এখন সেখানে ভয়ংকর এক বাস্তবতা। আগুনমুখা নদীর রাক্ষুসে ভাঙনে শত শত পরিবার তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। নদী কেড়ে নিয়েছে মানুষের ঘর, জমি, এমনকি স্বজনের কবর। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই ভাঙন আজ মানুষের জীবনযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।

নেছার হাওলাদার, আরেকজন ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা বলেন, “আমার প্রায় দুই কানি জমি আছিলো, সবই এই আগুনমুখার প্যাডে চলে গেছে। এখন যে একটা ঘর উঠামু সেই জায়গাটুকুও নাই।” কয়েকবার বাড়ি পাল্টেছেন, কিন্তু শান্তি মেলেনি। একবার পুকুর-ঘের করে স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করেছিলেন, তাও লবণ পানির ঢেউয়ে ভেসে গেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ১৫ হাজার মানুষের বাস এই ইউনিয়নে। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া নদীভাঙনে ইউনিয়নের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ড বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন অন্যত্র, কেউ আবার বেড়িবাঁধের ধারে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও নেই নিরাপত্তা, নেই স্থায়িত্ব।

প্রতিশ্রুতি আসে, বাস্তবতা বদলায় না

প্রতি বছর ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু আশ্বাস এলেও কার্যকর কোনো স্থায়ী উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি নদীর গর্জনের সাথে মিলিয়ে হারিয়ে যায়।
চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান বিপ্লব হাওলাদার বলেন, “১, ২, ৭, ৮, ৯—এই পাঁচটি ওয়ার্ড সম্পূর্ণ ভাঙন কবলিত। লিখিতভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে পুরো ইউনিয়নই বিলীন হয়ে যাবে।”

জীবনযুদ্ধের অন্য নাম: চালিতাবুনিয়া

চালিতাবুনিয়ায় মানুষের জীবনের আরেক নাম—অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা আর শোক। নদীর তীব্র স্রোত আর দুর্বল বেড়িবাঁধের মাঝে নিঃশব্দ যুদ্ধ করে যাচ্ছে মানুষগুলো। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে নতুন ভয়ের সাথে—আজকের দিনটা বাঁচতে পারবো তো?

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান বলেন, “ভাঙন কবলিত চালিতাবুনিয়া রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে স্থায়ী ব্লক বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে অবহিত করা হবে।”

মানুষের আকুতি: টেকসই বাঁধ ও নিরাপদ বাসস্থান

চালিতাবুনিয়ার মানুষ আজ শুধু একটি জিনিস চায়—নিরাপত্তা। তারা চায় টেকসই, স্থায়ী বেড়িবাঁধ। চায় কার্যকর উদ্যোগ, যেন আর কেউ হারাতে না হয় স্মৃতি, স্বপ্ন, কিংবা প্রিয়জনকে। সময় এসেছে কথার বাইরেও কিছু করার। নইলে আগুনমুখার নদীতে গিলে যাবে শুধু জমি নয়, হারিয়ে যাবে একটি জনপদের অস্তিত্ব।

চালিতাবুনিয়া এখন শুধুই এক জনপদ নয়, এটি এক সংগ্রামী আত্মার নাম। নদীভাঙনের বিরুদ্ধে মানুষের যে অদম্য প্রতিরোধ, সেটিই চালিতাবুনিয়ার প্রতিচ্ছবি।

সাব্বির

×