
ছবি: জনকণ্ঠ
কথিত আছে "হাওর-বাওর মাছে ভরা, কিশোরগঞ্জের পনির সেরা।" কিশোরগঞ্জের পনিরের স্বীকৃতি এখন শুধু জাতীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, এটি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত এক অনন্য উপজেলা অষ্টগ্রাম , যেখানে গরু ও মহিষের দুধ থেকে তৈরি হয় পুষ্টিগুণে ভরপুর, সুস্বাদু ও মুখরোচক এক বিশেষ পনির।
এ পনিরের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ—ষোড়শ শতকে এটি প্রথমবারের মতো স্থান পায় মোগল সম্রাটের রাজদরবারের রাজকীয় খাদ্য তালিকায়। সেই ঐতিহ্য আজও বহমান; বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানদের পছন্দের তালিকায় এ পনির আজও জায়গা করে নিয়েছে, বহন করে চলেছে একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা।
তবে, এই ঐতিহ্যবাহী দুগ্ধজাত শিল্পের যথাযথ বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারায় তা আজও অনেকাংশে অননুষ্ঠানিকভাবে টিকে আছে। স্থানীয়দের মতে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কারিগরি সহায়তা পেলে এ শিল্প শুধু ঐতিহ্য রক্ষা করেই নয়, বরং অগণিত নারী-পুরুষের আত্মকর্মসংস্থানের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে। এক সময় শতাধিক পরিবার জড়িত থাকলেও বর্তমানে মাত্র ২০টি পরিবার পনির উৎপাদন করে।
এখানে পনির তৈরিতে কোনো রাসায়নিক বা প্যাকেটজাত উপাদান ব্যবহার করা হয় না। পুরানো ছানা বা ‘মেওয়া’ দিয়ে সম্পূর্ণ ঘরোয়া পদ্ধতিতে প্রস্তুত হয় ছানা, যা পরবর্তীতে পনিরে রূপ নেয়। বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত বাওর ও প্রাকৃতিক খামারঘেরা পরিবেশে উৎপাদিত দুধ পনিরকে করে তোলে আরও সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। পনির তৈরির প্রক্রিয়াও বেশ নিপুণ—কাঁচা দুধ জমিয়ে ছানা তৈরি, ফর্মায় তুলে পানি ঝরানো, এরপর ছিদ্র করে লবণ ঢোকানো হয় যাতে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। এক কেজি পনির তৈরিতে লাগে প্রায় দশ কেজি দুধ।
গত ৩০ এপ্রিল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের উদ্যোগে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস ২০২৫ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পনিরকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের সনদ প্রদান করা হয়। সম্প্রতি অষ্টগ্রামের পনির জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) সনদপ্রাপ্ত হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে।
জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) সনদপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে অষ্টগ্রামের পনির এখন একটি মর্যাদাপূর্ণ ও স্বীকৃত ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই স্বীকৃতির ফলে পণ্যের বাজারজাতকরণ সহজ হবে, বাড়বে মূল্য এবং গ্রাহকদের আস্থা। স্বাদ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও অষ্টগ্রামের পনিরের চাহিদা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পনির তৈরির অভিজ্ঞ কারিগর রিকা আক্তার জানান, এক কেজি পনির তৈরিতে প্রয়োজন হয় প্রায় ১০ কেজি গরুর দুধ অথবা ৯ কেজি মহিষের দুধ। এভাবে তৈরি করা পনির বাজারে ৯০০ থেকে ১,০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। যারা একবার আমাদের পনির খেয়েছেন, তারা সবাই এর স্বাদ ও গুণগত মানের প্রশংসা করেছেন। শুনেছি, সরকার অষ্টগ্রামের পনিরকে জিআই সনদ দিয়েছে। এখন আশা করছি সরকারিভাবে পনির তৈরির এই শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করা হবে।”
অষ্টগ্রাম সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ ফায়াজ হাসান বাবু জানান, ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাটের এক বিশেষ বাহিনী অষ্টগ্রামে অবস্থান নেয়। ওই বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন দেলোয়ার খানের পুত্র, পনির খান। হাওড় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বাথানে অসংখ্য গরু-মহিষ দেখে তিনি বিস্মিত হন এবং একসময় নিজ হাতে দুধ দিয়ে তৈরি করেন এক বিশেষ দুগ্ধজাত খাবার—পনির। এই পনির মোগল দরবারে প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে, এবং পনির খান নিয়মিত তা সম্রাটের জন্য পাঠাতে শুরু করেন। ইতিহাসের মতে, তার নামানুসারেই এই খাবারটির নাম হয় ‘পনির’। পরবর্তীতে স্থানীয় মানুষরা তাঁর কাছ থেকে পনির তৈরির কৌশল শিখে ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিকভাবে এ শিল্পে জড়িত হয়ে পড়েন।
অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা: দিলশাদ জাহান জানান, অষ্টগ্রামের পনির এখন একটি স্বীকৃত জিআই পণ্য, তাই সরকারিভাবে এটিকে আরও ব্যাপকভাবে ব্র্যান্ডিং ও প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরা জাইকা প্রকল্পের আওতায় একটি সেলস সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা করেছি, যাতে পনিরের সহজ বাজার সৃষ্টি হয় এবং পর্যটকরাও সহজেই এটি কিনতে পারেন।
তিনি আরও জানান, বর্ষা মৌসুমে অষ্টগ্রামে প্রচুর পর্যটক ভিড় করেন। এ সময়টিকে পনির প্রচারে কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনাও রয়েছে। বর্তমানে অষ্টগ্রামে সরকারিভুক্ত ১৪ জন পনির কারিগর আছেন, যারা নিজেরাই তৈরি করে নিজেরাই বিক্রি করেন। তাদেরকে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় দক্ষতা উন্নয়নের জন্য। আমরা চেষ্টা করবো এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের স্বল্প সুদে ঋণের আওতায় আনার। পাশাপাশি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও সমবায় অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থাও করা হবে।
সাব্বির