
ছবি: সংগৃহীত
দারিদ্র্য কেবল আর্থিক সংকট নয়, এটি এক বহুমাত্রিক সামাজিক অভিশাপ, যা মানুষকে বঞ্চিত করে আত্মসম্মান, মর্যাদা ও মানবিক বিকাশের অধিকারের থেকে। এর প্রভাব সীমাবদ্ধ নয় ব্যক্তিপর্যায়েড় এর ছায়া পড়ে একটি পরিবারের ভবিষ্যতের উপর, এমনকি সামগ্রিকভাবে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ধারাও এতে বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে আজও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। দারিদ্র্য থেকে জন্ম নেয় বঞ্চনা, হতাশা, হীনমন্যতাড়্যা শিশুদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক বয়সেই বাধ্য করে কায়িক শ্রমে জড়াতে। অনেকেই মাদকাসক্তি, জুয়া, চুরি বা ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির বিস্তার আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এসব সামাজিক ব্যাধির মূলভিত্তিতে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্য এবং শিক্ষার ঘাটতি। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে- সমাধান কোথায়? উত্তর একটিই: শিক্ষা।
শিক্ষা শুধু অর্থ উপার্জনের পথ নয়, এটি মানুষের মধ্যে নৈতিকতা, যুক্তিবোধ এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। শিক্ষাই একটি শিশুকে শেখায় ভালো-মন্দের পার্থক্য, অধিকার ও কর্তব্যের ভারসাম্য, এবং জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের সামর্থ্য। শিক্ষা থেকে অর্জিত মন-নশীলতা ও মানবিকতা সমাজে সহাবস্থান ও সহমর্মিতার ভিত্তি তৈরি করে।
একটি শিশুর বিকাশে বিদ্যালয় হয় একটি মিনি সমাজ, যেখানে সে শেখে সহপাঠীদের সহযোগিতা করা, মত প্রকাশ করা, দলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাড় যা পরবর্তীকালে এক পরিপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার পথ সুগম করে। শিক্ষক, সহপাঠী ও পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নানা ক্লাব, ক্যাম্পেইন ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গড়ে তোলে নৈতিক সংবেদনশীলতা। যেমন বিদ্যালয়ে পরিচালিত মানবিক সেবামূলক কর্মকাণ্ড, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি কিংবা দুঃস্থদের সহায়তার আয়োজনগুলো শিশুদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতা জাগিয়ে তোলে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেখা যায়, সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও বৈচিত্র্য মেনে চলার চর্চাও শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই গড়ে তোলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরে প্রতিবছর ২১ জুলাই একটি অনন্য জাতিগত "সম্প্রীতি দিবস পালিত হয়", যেখানে শিক্ষার্থীরা একে অপরের ধর্মীয় পোশাক পরে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সমতার শপথ নেয়। ফলে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে শিক্ষার আলো এখনো সবার কাছে সমভাবে পৌঁছায়নি। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর। বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোতে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে এখনো পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অজ্ঞতা বা আর্থিক অক্ষমতার কারণে শিশুরা বিদ্যালয়ে না গিয়ে শ্রমজীবী হয়ে পড়ে। শিক্ষাকে তারা কোনো বিনিয়োগ হিসেবে না দেখে অলাভজনক বোঝা হিসেবেই বিবেচনা করে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন একটি বহুমাত্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শুধু বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো নয়, বরং শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা তৈরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ, বিনামূল্যে পাঠদান, শিক্ষাসামগ্রী প্রদান, এবং বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে নারীশিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে শহরাঞ্চলে ছিন্নমূল ও পথশিশুদের জন্য 'ভাসমান বিদ্যালয়' কিংবা বিকল্প সময়ভিত্তিক শিক্ষাকেন্দ্র চালু রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকার এক্ষেত্রে নানা কর্মসূচি হাতে নিলেও তা অনেক সময়ই কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয় না। বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়, স্কুল অবকাঠামো অনেক জায়গায় দুর্বল, এবং শিক্ষক সংকটও প্রকট। শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বরাদ্দের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, যারা তাদের জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রে শিক্ষা নীতিকে স্থান দিয়েছে, তারাই প্রযুক্তি, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক থেকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছে। তবে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, দরিদ্র্য বিমোচনের আরেকটি কার্যকর উপায় হলো কারিগরি ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা বিস্তার। বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা, যাতে তারা উপার্জনক্ষম হয়ে উঠতে পারে। দেশের উদ্যোক্তারা চাইলে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ছিন্নমূল পরিবার থেকে কিছু কর্মী নিয়োগ দিয়ে সমাজের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। এতে যেমন দারিদ্র্য কমবে, তেমনি উৎপাদন ও মানবসম্পদের মানও বাড়বে।
দারিদ্র্য দূরীকরণে নারীর শিক্ষার প্রসারকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ নারী শিক্ষিত হলে পুরো পরিবার শিক্ষিত হয়, প্রজন্ম পরম্পরায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও কিশোর অপরাধের মতো বিষয়গুলোকেও কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, আর সেই সঙ্গে সচেতনতা বাড়াতে হবে স্থানীয় পর্যায়ে।
অবশ্য, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন শুধু পরিকাঠামোগত নয়, মানগত দিক থেকেও হতে হবে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি যৌথ কার্যক্রম, সমবেত শিক্ষা, এবং শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পাঠক্রমে মানবিক মূল্যবোধ, পরিবেশ সচেতনতা ও প্রযুক্তি জ্ঞান যুক্ত করতে হবে। পাঠশালাকে হতে হবে জীবনের জন্য প্রস্তুতির প্রাঙ্গণ, কেবল পরীক্ষা পাশের কেন্দ্র নয়।
সর্বোপরি, দারিদ্রদ্র্য একদিনে আসেনি, একদিনে যাবে না-তবে শিক্ষা দিয়েই শুরু করা যেতে পারে এক দীর্ঘমেয়াদি কিন্তু টেকসই উত্তরণের পথ। এজন্য দরকার রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার, নাগরিক সচেতনতা, এবং সর্বস্তরের অংশগ্রহণ।
শিক্ষা যেন কেবল ধনীদের বিলাস না হয়ে ওঠে, বরং এটি যেন সকলের অধিকার হয় সেই সমাজ গঠনে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শিক্ষা দিয়েই গড়া যাবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে দারিদ্র্য নয়, সম্ভাবনাই হবে জাতির পরিচয়।
লেখক: কাজী খলিলুর রহমান
আসিফ