
বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের গাঢ় সবুজে ঘেরা গ্রাম মাসকাট। এ গ্রামে চলতি বোরো মৌসুমে ‘পাকিস্তানি লং বাসমতি-১১২১’ জাতের ধানের চাষ হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে এই প্রথম বিদেশি জাতের বাসমতি ধানের আবাদ। আর এ আবাদ করেছেন এ গ্রামের আইন পড়–য়া তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান সোহেল। উচ্চমূল্যের এ ধান চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়ে তিনি মহাখুশী। প্রত্যাশা করছেন অধিক মুনাফার। তার সফলতার হাসি ছড়িয়ে দিতে চান আগ্রহী কৃষকদের মাঝে।
কামরুজ্জামান সোহেল নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের খুলনা ক্যাম্পাসের এলএলবি শেষ বর্ষের ছাত্র। সফলতার হাসি ছড়িয়ে দিতে চান অন্য কৃষকদের মাঝেও। তার আশা ইরি, বোরো, আমনের আবাদ করে সীমিত লাভ পাওয়া চাষিরাও এই ধানের চাষ করে বেশি লাভবান হতে পারেন।
লং বাসমতি ধান ঘ্রান ও স্বাদের জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। অভিজাত পরিবারসহ বিশ্বের থ্রি-স্টার বা’ ফাইভ-স্টার হোটেলে বিরিয়ানী ও পোলাউ ভাতের জন্য এ চালের ভাত খুবই জনপ্রিয়। প্রতি কেজী চালের দাম ৪’শ থেকে সাড়ে চার শত টাকা পর্যন্ত দর রয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম খরচে অধিক লাভবান হওয়ায় উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান সোহেল-এর দেখাদেখি এই এলাকার সর্বত্র কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। অন্য জেলা থেকেও আগ্রহীরা ছুটে আসছেন।
কয়েকবছর ধরে কৃষিভিত্তিক নানা উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত তরুণ কামরুজ্জামান সোহেল বলেন, “এই ধানের সঙ্গে হাইব্রিডের পার্থক্য হলো হাইব্রিড বিঘাপ্রতি ৩৫-৪০ মণ উৎপাদন হয়, তবে তার বাজারমূল্য ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। পাকিস্তানি লং বাসমতিতে বিঘা প্রতি উৎপাদন হবে ২৫ থেকে ৩০ মণ, কিন্তু এর বাজারমূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা।”
এই সুগন্ধি জাতের ধান চাষে সোহেলের সফলতায় এখানে গোটা এলাকার কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। আগামীতে এই জাতের ধান আবাদ করতে তারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাগেরহাটে বিভিন্ন এলাকার কৃষক ছাড়াও খুলনা ও যশোর থেকে ইতোমধ্যে অনেক চাষি ও কৃষি বিভাগের লোকজন এ জাতের ধান সংগ্রহ করতে তার কাছে ছুটে আসছেন।কৃষি বিভাগও বলছে, বর্তমানে বাসমতি চাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, ফলে বাজারে এই চাল উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। স্থানীয় কৃষকরা এই ধানের আবাদ করলে লাভবান হবেন। বিদেশ থেকে এ চালের আমদানী হ্রাস পাবে। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রার।
সরেজমিনে মাসকাটা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সোহেলের বাড়ির সামনের এক একর জমিতে চাষ করা ধান কেটে ঘরে তোলার অপেক্ষায় স্তুপ করে রেখেছেন।
কামরুজ্জামান সোহেল জনকণ্ঠকে বলেন, “এই জমিতে পাকিস্তানি লং বাসমতি-১১২১ জাতের ধান রোপন করেছি। একর প্রতি প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি সফল হয়েছি। ভাল ফলন হয়েছে। এখন ধান ঘরে তোলার শেষ পর্যায়ে।”
তিনি আরও বলেন, “কয়েক বছর ধরে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেদের জমিতে ধানের আবাদ করছি। কিন্তু হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ করতে যে পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয় সেই তুলনায় মুনাফা আসে না। তখন মাথায় আসল- পোলাও-বিরানীতে বাসমতি চাল ব্যবহার করা হয়। এসব সুগন্ধি চালের দাম কেজিপ্রতি চারশ টাকা পর্যন্ত। তাই পাকিস্তানের লং বাসমতি-১১২১ জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করে বীজতলা তৈরি করে পরীক্ষামূলকভাবে এক একর জমিতে আবাদ করি।”
একক প্রচেষ্টায় এই ধানের আবাদ করতে হয়েছে উল্লেখ করে সোহেল বলেন, “শুরুতে এই ধান নিয়ে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। এই ধানের আবাদ এ অঞ্চলে কেউ আগে করেনি, অন্য কারও থেকে সেভাবে সহযোগিতাও আমি পাইনি।“আবাদের বিষয়টি আমি কৃষি বিভাগকে জানালে একবার তারা পরিদর্শনে এসে বলেন, এই জাতের বিষয়ে তারা খুব একটা কিছু জানেন না।”
দেশের বাইরে থেকে এই ধানের বীজ সংগ্রহ করেছেন জানিয়ে সোহেল বলেন,“বড় ভাইয়ের চাকরির সুবাদে দেশের বাইরে থেকে পাকিস্তানের লং বাসমতি-১১২১ জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করেছি। তবে এখন আমার মাধ্যমে অন্য কৃষকরাও এ বীজ পেয়ে যাবেন।”
এই জাতটি দেশের কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমানে সুগন্ধি চাল ভারত ও পাকিস্তান থেকে আসে। আমি দক্ষিণাঞ্চলে প্রথম আবাদ করলাম। আমি চাই আমার মাধ্যমে সব কৃষক এই ধানের আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠুক এবং ভাল মুনাফা করুক। আমরা উৎপাদন করলে দেশের মুনাফা দেশেই থাকবে। তাঁর ভাষায়, “আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর দেশ, নতুন উদ্যোগকে কাজে লাগালে দ্রুত উন্নতি হবে।” তিনি আরও বলেন, এই ধানের আবাদ কম লবণাক্ত এলাকায় হবে, তবে মাত্রাতিরিক্ত লবনযুক্ত এলাকার জমিতে হবে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখছে কৃষি বিভাগ। ইতোমধ্যে তারা নমুনা সংহ্রহ করেছেন।
এই সুগন্ধি ধান জাতের আবাদে সোহেলের সফলতা স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে আশা জাগাচ্ছে। তারাও আগামীতে এই জাতের ধান আবাদ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
সোহেলের প্রতিবেশি কৃষক মামুন শেখ, সোলাইমান শেখ ও হালিম শেখ বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে ইরি, বোরো, আমন ধানের আবাদ করছেন। কিন্তু তাতে তাদের লাভ হয় সীমিত। তরুণ কৃষক সোহেল যে ধানের আবাদ করেছে এই ধানের জাত-আগে পরে কখনো দেখিনি।’
মামুন শেখ জনকণ্ঠকে বলেন, “বাসমতি ধানের আবাদ করে সোহেল আমাদের অবাক করে দিয়েছে। এই ধানের বিশেষত্ব হচ্ছে সুগন্ধ। আবাদ ভাল হলে এই ধানে লাভ হাইব্রিডের থেকে কয়েকগুণ বেশি হবে। তাই আগামীতে আমরাও বাসমতি ধানের আবাদ করব।”
ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলেই পাকিস্তানি লং বাসমতি (সুগন্ধি চাল) ১১২১ ধানের আবাদ এই প্রথম। যা বাগেরহাটের ফকিরহাটেই আবাদ হয়েছে।
তিনি জানান, পাকিস্তান আর্কাইভের তথ্যমতে লংগেজ বাসমতি সুগন্ধি ধান। সুগন্ধ ও স্বাদের জন্য বিশ্বব্যাপি লং বাসমতির প্রচুর চাহিদা আছে। আমাদের দেশেও বাসমতি চালের বিরিয়ানি-পোলাও ভাত খুব জনপ্রিয়। মূলত পাকিস্তানে ও ভারতে উৎপাদন হওয়ায় আমদানি করা চালেই দেশের চাহিদা মেটানো হয়। দেশের বাজারে এ চাল কেজিপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাখাওয়াত আরও বলেন, মাসকাটা গ্রামের কামরুজ্জামান সোহেল প্রথমবারের মতো পরীক্ষমূলকভাবে এ ধানের আবাদ করেছেন, ভাল ফলন পেয়েছেন। তার সফলতায় এই ধান চাষে অন্য কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন। ধান যে একটি উচ্চমূল্যের ফসল হতে পারে বাসমতি তার উদাহরণ। আগামীদিনে এ ধান চাষীদের জন্য রঙ্গিন স্বপ্ন বয়ে আনবে।
বাসমতি ধানের জাতটির বিষয়ে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অবহিত করা হলে ইতোমধ্যে সরেজমিনে ধানের মাঠ পরিদর্শন করেছেন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা। তারা ধানের জাতটির বিশুদ্ধতা ঠিক আছে কিনা, তা পরীক্ষা করছেন। এই ধানের জাতের সার্টিফিকেশন দিলে দক্ষিণাঞ্চলের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে বলে এই কৃষি কর্মকর্তা আশা করেন।
এই ধানের আবাদ করলে কৃষক লাভবান হবেন উল্লেখ করে কৃষিবিদ শেখ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই ধানের আবাদ সম্প্রসারিত ও কৃষক পর্যায়ে আগ্রহী করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। সফল হওয়া চাষীকে ধানের বীজ সংরক্ষণের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নবাগত উপ-পরিচালক মো: মোতাহার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে ‘পাকিস্তানি লং বাসমতি-১১২১’ জাতের ধানর চাষ করে ভাল ফলন পেয়ে শিক্ষিত যুবক কামরুজ্জামান সোহেল নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন। তার সফলতা অন্যান্য কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, এবার বাগেরহাট জেলায় ৬২ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্য মাত্রা ছিল। কিন্তু চাষ হয়েছে ৬৫ হাজার ৭’শ ৭৬ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ অর্থাৎ ১০৪%। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩৬৭৯০ মেট্রিক টন চাউল। বাম্পর ফলন হওয়ায় অতিরিক্ত উৎপাদন হয়েছে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, “বাগেরহাট লবণাক্তপ্রবণ এলাকা। এ জাতটি কতটা লবণসহিষ্ণু, তা পরীক্ষা করার জন্য কৃষক সোহেলের আবাদকৃত ক্ষেতের মাটি কৃষি বিভাগ সংগ্রহ করেছে। লবনাক্ত ও দুর্যোগপ্ররণ এই এলাকায় এ ধানের আবাদ ছড়িয়ে দিতে পারলে এ অঞ্চলের কৃষিতে সোনালী স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করছি।’ তিনি আইন পড়ুয়া তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান সোহেলকে অভিনন্দন জানান।
রাজু