ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বলী খেলার আসর কাল

লালদীঘির সামনে মেলা চুড়ি, মাটির হাঁড়ি মুড়ি মুড়কি-কী নেই ...

নয়ন চক্রবর্ত্তী

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

লালদীঘির সামনে মেলা চুড়ি, মাটির হাঁড়ি মুড়ি মুড়কি-কী নেই ...

চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলা ঘিরে লালদীঘি সংলগ্ন এলাকাজুড়ে বসেছে বৈশাখী মেলা

টেপা পুতুল, ঝাড়ু, বটি, দা, রেশমি চুড়ি, মাটির হাঁড়ি, টনটনি গাড়ি, ঢোল, কাঁসর, মুড়ি মুড়কি-কী নেই চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলা ঘিরে বৈশাখী  মেলায়? এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারার কথা নয়। কারণ  দেশের শতবর্ষ পার হওয়া এ মেলায় সবই রয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে  ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন হস্তশিল্পীরা তাদের তৈরি পণ্য নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন এ মেলার জন্য। সে অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে এই মেলা শুরু হচ্ছে আজ বুধবার। তিনদিনের শেষ হবে আগামী শুক্রবার। তবে দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার ১১৫তম আসর বলী খেলার। ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠের সামনে ঐতিহ্যের জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে মেলা ইতোমধ্যে বসেছে কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে।
তীব্র তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করে জেলার আশপাশের লোকজন মেলায় আসছেন, করছেন কেনাকাটা। মেলায় বিকেল  থেকে রাত পর্যন্ত শুধু মানুষ আর মানুষ।
দেশের বৃহত্তম এই বৈশাখী মেলার ব্যপ্তি নগরীর কোতোয়ালি, নিউমার্কেট, আমতল, আন্দরকিল্লা, জেল রোড, সিনেমা প্যালেস, হাজারী লেনের সামনেসহ কয়েক কিলোমিটার এলাকায়। রকমারি পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছে দোকানিরা।
গৃহস্থালি পণ্যের এই সমাহার থেকে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসটি কিনে নেবেন এমন আশায় থাকেন নগরবাসী। বিশেষ করে চট্টগ্রাম নগরীর ও আশপাশের উপজেলার গৃহিনীরা বলীখেলার মেলা থেকেই ঝাড়ু, মাটির হাঁড়ি,  পাতিল, বাসনকোসন, ছুরি-বটি, দাসহ বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য সংগ্রহ করে থাকেন।
নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর থেকে বিধান পাল এসেছেন মাটির পুতুল, প্রতিমা, আবহমান বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্যপূর্ণ মাটির পুতুল নিয়ে। তিনি জানান, পেশায় একজন মৃৎশিল্পী। 
প্রতিমা গড়ার কাজ করলেও জব্বারের মেলায় আসেন প্রতিবার। এবার বোনের জামাই অসিতকেও নিয়ে এসেছেন। তারা প্রায় ৮ জনের একটি দল এসেছেন। কোতোয়ালি ও লালদীঘি এলাকায় পৃথকভাবে বসেছেন। বেচা জমে উঠেছে।
বাঁশির গ্রাম হিসেবে পরিচিত কুমিল্লার শ্রীমদ্দি থেকে অনিল মজুমদারসহ গ্রামের আরও বেশ কয়েকজন এসেছেন তার ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলার মেলায় বাঁশি বিক্রি করতে। প্রায় ৩৬ বছর এ মেলার সঙ্গে তার পরিচয়।  চট্টগ্রামে আসেন শুধু মেলায় অংশ নিতে। বংশ পরম্পরায় বাঁশি তৈরির পেশায় জড়িত নন্দলাল জব্বারের বলী খেলার মেলা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত থাকেন। কারণ এখানে বিক্রিবাট্টা খুবই ভালো। ২০ থেকে আড়াইশ’ টাকা দামের বাঁশি নিয়ে তিনি মেলায় এসেছেন। শুরুর দিন থেকেই বিক্রি ভালো বলে জানিয়েছেন শ্রীমদ্দি গ্রােেমর এ বাসিন্দা। 
বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিবছরের ১২ বৈশাখ মঙ্গলবার ঐতিহাসিক জব্বারের বলীখেলা, যেখানে অংশ নিয়ে থাকেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বলীরা।
মঙ্গলবার লালদীঘি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে মাটির তৈজসপত্র, ঝাড়ু, টনটনি গাড়ি, মাটির শো পিস, টব নিয়ে আসা দোকানিরা ব্যস্ত স্টল সাজানোর কাজে। স্টল বলতে পলিথিনের ছাউনি আর বাঁশ দিয়ে ঘেরা।
চট্টগ্রামের কৃষ্টি সংস্কৃতি ঐতিহ্য বজায় রাখতে বলী খেলার ১১৫তম আয়োজনে দম ফেলার ফুসরত নেই কারও। সাজ সাজ রব লালদীঘি এলাকাজুড়ে।
লালদীঘির পশ্চিমপাশে এবং সিনেমা প্যালেস এলাকায় মাটির তৈজসপত্র, পুতুল, অন্যদিকে, পেট্রোল পাম্পের সামনে বসেছে মাটির শৌখিন জিনিসপত্র, ফুলের টব ও টনটনি গাড়ি। অপরদিকে কোর্ট বিল্ডিং এলাকা থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ মার্কেট এবং লালদীঘি এলাকায় বেত-কাঠ ও বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, হাতপাখা, মাছ ধরার বিভিন্ন ফাঁদ, মুড়ি মুড়কি, গৃহস্থালি বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসিয়েছেন দোকানিরা।  
সাতকানিয়া থেকে আসা ঝাড়ু বিক্রেতা মো. রফিক জানান, ৩০ বছর ধরে এখানে ঝাড়ু বিক্রি করতে আসেন। এর আগে তার বাবাও এ মেলায় আসতেন। 
লালদীঘির সামনেই মাটির বিভিন্ন পুতুল বিক্রি করছেন রনধীর পাল। মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত এই দোকানি জানান, এই ব্যবসার সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ৩০ বছর। ২০ বছর আগে এ মেলায় প্রথম আসেন। 
কোতোয়ালি এলাকার বাসিন্দা পার্থ চৌধুরী জানান, টনটনি গাড়ি হল এ মেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশেষায়িত এ  খেলনা অল্পদামী ও ঐতিহ্যবাহী।
মেলা উপলক্ষে নগরবাসীর পরিকল্পনা থাকে বেশ। বাসার জন্য গৃহস্থালি পণ্য, শৌখিন জিনিসপত্র, ঘর সাজানোর জিনিস, বেতের কুলা, মোড়া, বলীর হাটের খাট পালং, ছোটদের গাড়ি, ও মাটির পুতুলের দোকানে ঠাঁসা মেলা। তবে মেলায় বরাবরের মতো ফুল ঝাড়ুর চাহিদা শীর্ষে। 
চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি থেকে ফুল ঝাড়ু নিয়ে এসেছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। বিক্রিও তুঙ্গে। মেলায় নিমকি, জিলেপি, মিঠাই ও শুকনা মিষ্টির দোকানও রয়েছে। ঢাকা, ভৈরব ও কুমিল্লাা থেকে এসব মুখরোচক মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বিক্রির জন্য এসেছেন সেখানকার উদ্যোক্তারা।
আব্দুল জব্বার স্মৃতি বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা আয়োজকেরা জানান, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ১২ বৈশাখ বলী খেলা হবে এটা মনে রাখেন। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা নিয়ে চলে আসেন। আর নগরবাসী এ মেলা থেকে ঝাড়ু, বটি, দা এবং বিভিন্ন মাটির জিনিসপাতি কেনার অপেক্ষায় থাকেন।
উল্লেখ্য, ১৯০৯ সালে স্থানীয় আব্দুল জব্বার সওদাগর লালদীঘি মাঠে কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে। পরবর্তীতে তা সারাদেশের মানুষের কাছে জব্বারের  বলীখেলা নামে পরিচিত পায়। করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ থাকলেও ২০২২ সাল থেকে আবারও শুরু হয়।
এদিকে, জব্বারের বলীখেলা উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগরীতে যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে মেট্রোপলিটন পুলিশ।

বৈশাখী মেলা ও মেলার কারণে এ কয়েক কিলোমিটার এলাকায় যানবাহন চলাচল করতে পারবে না বিধায় বিকল্প সড়ক ব্যবহারের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। যে সকল এলাকায় যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে আন্দরকিল্লা মোড়, পুরাতন টেলিগ্রাম রোড, বোস ব্রাদার্স মোড়, রাইফেল ক্লাব, কোতোয়ালি মোড়, শাহ আমানত রোডের মুখ, টেরিবাজার ফুলের দোকান এবং সংলগ্ন এলাকা।

×