![চট্টগ্রামে বন্ধ হচ্ছে না পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন চট্টগ্রামে বন্ধ হচ্ছে না পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023May/5-2308291755.jpg)
চট্টগ্রামে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসতি
পাহাড়খেকোরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে গড়ে তুলেছে আলাদা সা¤্রাজ্য। জনপ্রতিনিধি, সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর আশ্রয় প্রশ্রয় এবং নজরদারির অভাবে চট্টগ্রামের পাহাড়কাটা অব্যাহত রয়েছে ফলে প্রতিবছরই ঘটছে প্রাণহানি। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানির পরও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ঠেকাতে না পারা এবং পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ায় এ পর্যন্ত ১৬ বছরে ২৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে সরানো যায়নি।
চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা ও দখলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে বায়েজিদ ও আকবরশাহ থানায়।
সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর যোগসাজশে থাকায় পাহাড়ে বসতি ঠেকানো যাচ্ছে না। একইভাবে রেলওয়ের পাহাড়ে রক্ষণাবেক্ষণের উদাসীনতার কারণে থামানো যাচ্ছে না দখল। আশঙ্কাজনক হলো, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভার প্রতিবেদনে রেলওয়ের পাহাড়ে অবৈধ বসতির পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই পাহাড় কাটা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরকে তোয়াক্কা না করার তথ্য উঠে এসেছে।
চট্টগ্রামে সর্বশেষ গত রবিবার আই ডব্লিউ কলোনিতে পাহাড় ধসে বাবা-মেয়ের মৃত্যু হয়। ৭ মাস বয়সী শিশুটি বাঁচতে বাবার বুকে আশ্রয় নিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। অকালে ঝরে গেছে শিশুটি। রেলওয়ের মালিকানাধীন ওই পাহাড়ে তাদের কর্মচারী খালেক দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে বাসাভাড়া দেয়। খালেক নামের ওই রেল কর্মচারীকে রেলওয়ে বরখাস্ত করলেও সংস্থাটির অবহেলায় পাহাড়ে অবৈধ বসতি ঠেকানো যে যাচ্ছে না, এ বিষয়ে তারা উদ্যোগী নয়। বর্ষণের মধ্যেও খালেক তার সহযোগীদের দিয়ে পাহাড়টি কেটেছিল গত সপ্তাহে। অথচ এ বিষয়ে কিছুই জানত না রেলওয়েসহ সংশ্লিষ্টরা। পরে রবিবার ধসের পর অভিযান পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন। উচ্ছেদ করে ৪০টি স্থাপনা, যেখানে ২৫০ জনের বাস ছিল।
সেদিন অভিযানের পর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মাসুদ কামাল জানান, অভিযানে ৪০টি ঘর ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ের চৌকিদার আব্দুল খালেক পাহাড়টি কাটার সঙ্গে জড়িত ছিল। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও জেলা প্রশাসনের কাছেও রয়েছে। তাই তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অপরদিকে খালেকের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেছেন নিহত আব্দুল আউয়ালের বড় ভাই মহরম আলী।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আব্দুল খালেক ও তার সহযোগীরা নিহত আব্দুল আউয়ালের ঘরের পেছনের দিকে পাহাড় কেটে ইটের দেয়াল নির্মাণ করে। ওই দেয়ালের কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রাখায় ইটের দেয়ালটি ধসে পড়েই আউয়াল ও তার মেয়ের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আউয়ালের স্ত্রী শরীফা ও বড় মেয়ে বিবি কুলসুম মীমও আহত হন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এজাহারে উল্লেখ করা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায় ৪০ থেকে ৫০ ফুট উঁচু পাহাড় কেটে ঢালে বেশ কয়েকটি স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। আব্দুল খালেক এই পাহাড় কাটার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কলোনিতে ৫০টি ঘর নির্মাণ করে আব্দুল খালেক ভাড়া দিয়েছিল।
এদিকে পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেখা গেলেও এ বিষয়ে নিশ্চুপ সংস্থাটি। শুধু ষোলশহরের আইডব্লিউ কলোনি নয়, নগরীর মতিঝর্ণা, আকবর শাহ এলাকার ১ নম্বর ঝিল, ২ নম্বর ঝিল, ৩ নম্বর ঝিল, বিজয়নগর, টাংকির পাহাড়, শান্তি নগর, বায়েজিদ লিংক রোড, বেলতলী ঘোনা পাড়ে বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে। অনেক এলাকায় ওয়াসা ও গ্যাসের সংযোগও আছে। চলতি বছর জেলা প্রশাসন বিভিন্ন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা করলেও বিভিন্ন সেবা সংস্থার অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না পাহাড় দখল।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর সরকারি পর্যায়ে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হলেও পুনর্বাসন সংক্রান্ত কারণে ঝুলে যায় কার্যক্রম। এছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই সংস্থাগুলোর। যার ফলে ১৬ বছরে চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৭তম সভায় বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধিরা পাহাড় দখল ও কর্তনে কারা জড়িত এ বিষয়ে তুলে ধরেন। তখন বিভাগীয় কমিশনার জানিয়েছিল, প্রভাবশালী বলতে কিছুই নেই। সরকারের চেয়ে বড় কেউ নয়। যারাই পাহাড় দখলে জড়িত এবং পাহাড় কাটতে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে ২৬তম সভার কার্যবিবরণীতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত ও আলোচনা পাঠানো হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ে।
২৬ পাহাড়ে ৬ হাজার ৫৫৮ পরিবার ॥ চট্টগ্রামে ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে ১৬টি সরকারি সংস্থার এবং ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন। এরমধ্যে রেলওয়ের ৭টি পাহাড়ের মধ্যে ৩টি পাহাড় নিয়ে মামলা রয়েছে। যারমধ্যে ফয়েসলেক এলাকার ১, ২, ও ৩ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড় নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলমান। যার ফলে দখলকারীরা বিভিন্নভাবে মামলা দিয়ে উচ্ছেদ কার্যক্রম ঝুলিয়ে দেয়। এছাড়া মতিঝর্ণায় ৫ থেকে ৬ তলা বহুতল ভবন রয়েছে যাতে সেবা সংস্থাগুলোর সংযোগ রয়েছে। এমনকি ফয়েসলেকে পাশের পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীরা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেও তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো যাচ্ছে না সেবা সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশ্রয়ে।
তোয়াক্কা করে না সেবা সংস্থাগুলো ॥ সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো ২৬তম সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, পাহাড়ে অবৈধভাবে যারা বসবাস করেন তাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ রয়েছে। অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সেবা সংযোগ বন্ধ করা গেলে পাহাড়ে বসবাস করবে না তারা। এমনকি রাতের অন্ধকারে যে পাহাড় কেটে উজাড় করে ফেলা হচ্ছে বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সভায় জেলা প্রশাসক আলোচনায় বলেছিলেন, সহকারী কমিশনাররা অনেক অভিযান পরিচালনা করেছেন। রাতে ও সকালে অভিযান করেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিচ্ছে।