ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে জাতীয় খেলা ‘হা-ডু-ডু’

-

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ৯ জুন ২০২৩

বিলুপ্তির পথে জাতীয় খেলা ‘হা-ডু-ডু’

এখন আর সচরাচর হা-ডু-ডু খেলার দৃশ্য চোখে পড়ে না

বিশ্বের প্রতিটি দেশের জাতীয় প্রতীকের পাশাপাশি জাতীয় খেলা রয়েছে। জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য হিসেবে নির্দিষ্ট সেই খেলা একটি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে হ-ডু-ডু জাতীয় খেলা। একসময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষেও ছিল এই খেলাটি। হ-ডু-ডু আমাদের দেশে ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে কাবাডি নামে বেশ পরিচিত। তবে, এ খেলার উৎপত্তিস্থল ভারতের তামিলনাড়ু।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে একবিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে গ্রামীণ পর্যায়ে হ-ডু-ডু ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামের মাঠ-ঘাটে হৈ-হুল্লোড় করে চলত জনপ্রিয় এ খেলাটি। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামে সন্ধ্যাকালীন সময় বড়দের নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। পুরস্কার হিসেবে গরু, ছাগল ও সাদাকালো টেলিভিশন দেওয়া হতো ঘটা করেই। এ খেলা উপভোগ করতে হাজারো মানুষের ভিড় হতো। 
হ-ডু-ডু খেলা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি থাকার পরও পৃষ্ঠপোষকতা, অনুশীলন, প্রাত্যহিক চর্চা ও আয়োজনের অভাবে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার ও বিদেশী খেলার ব্যাপক প্রসার ঘটায় দেশের জনপ্রিয় জাতীয় এ খেলাটি বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে ঘরে ঘরে ভিডিও গেমের প্রচলনে গ্রাম-বাংলার ঐহিত্যবাহী খেলাধুলাগুলো বিলুপ্তির পথে। শৈশবে যেসব খেলাধুলায় দিন কাটিয়েছেন আজকের বয়োবৃদ্ধরা, তারাও এখন ভুলতে বসেছেন সেসব খেলার নাম। সাধারণত হ-ডু-ডু খেলার মাঠের সুনির্দিষ্ট কোনো মাপ থাকে না। খেলায় অংশগ্রহণকারীরা যে জায়গায় খেলা হবে তার আকার বিবেচনায় নিয়ে নিজেরা আলোচনা করে চারদিকে দাগ দিয়ে খেলার মাঠের সীমানা ঠিক করে নেয়। তবে পরিমাণের দিক থেকে মাঠ যত বড়-ছোটই হোক না কেন, এর আকৃতি হয় আয়তাকার। মাঝখানে দাগ দিয়ে মাঠকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিভাগে একেকটি দল অবস্থান নেয়। নিয়ম অনুসারে, একপক্ষের একজন খেলোয়াড় অপর পক্ষের কোর্টে হানা দেয়। এ সময় সে হ-ডু-ডু, হা-ডু- শব্দ করতে করতে অন্য ওইপক্ষের যে কোনো একজন খেলোয়ারকে ছুঁয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করে। ওই পক্ষের চেষ্টা থাকে সবাই মিলে তাকে জাপটে ধরে আটকে রাখা। যদি ওই খেলোয়াড় দম ধরে রেখে নিজ কোর্টে ফিরে আসতে পারে, তাহলে তার দল পয়েন্ট পায়। আর যদি আটকে থাকা সময়ের মধ্যে খেলোয়াড়টির দম ফুরিয়ে যায়, তাহলে বিপক্ষ দল পয়েন্ট পায়। প্রতি দলে থাকে  ১২ জন করে খেলোয়াড়। এ খেলায় একপক্ষের খেলোয়াড় দম ধরে প্রতিপক্ষের কোর্টে হানা দিয়ে দম থাকা অবস্থায় স্পর্শ কিংবা ধস্তাধস্তির পর নিজ কোর্টে ফিরে আসতে পারলে পয়েন্ট অর্জিত হয়। প্রতি দলে ১২ জন করে খেলোয়াড় থাকলেও সাতজন খেলোয়াড় কোর্টে খেলে এবং বাকি পাঁচজন অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে কোর্টের বাইরে থাকে। প্রতিযোগিতার সময় দুই অর্ধ মিলিয়ে মোট ৪০ মিনিট এবং দুই অর্ধের মাঝামাঝি পাঁচ মিনিট বিরতি থাকে। কোনো পক্ষ তার বিপক্ষের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে আউট করার সুবাদে একটি করে পয়েন্ট লাভ করে। বিপক্ষ দলের সব খেলোয়াড়কে আউট করতে পারলে লোনা বাবদ অতিরিক্ত দুই পয়েন্ট পায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে দল বেশি পয়েন্ট অর্জন করবে, খেলায় সে দলই জয়ী হবে।
স্থানীয় ক্রীড়াবিদরা বলছেন, ক্রিকেট, ফুটবলের পাশাপাশি স্মার্ট মুঠোফোনে বিভিন্ন রকমের খেলা  নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করায় আমাদের নিজস্ব গ্রামীণ খেলাগুলো প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠন ও স্কুল, কলেজগুলোর উদাসীনতাও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন তারা। গত একযুগ আগেও দেশের উত্তরের প্রবেশদ্বারখ্যাত জেলা পঞ্চগড়ে স্কুলভিত্তিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে বড়দের হ-ডু-ডু খেলা প্রতিযোগিতার আয়োজন চোখে পড়ত। বর্তমানে সেটা চোখেই পডছে না। বতর্মান নতুন প্রজন্মের অনেকেই হ-ডু-ডু খেলার নিয়ম পর্যন্ত বলতে পারে না। 
মানিকপীর বেংহারী ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক সেলীনা আকতার বলেন, হ-ডু-ডু ও কাবাডি খেলা এক সময় এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে গ্রাম-বাংলায় এ খেলাগুলো না দেখলে ছোট থেকে বড়রা পর্যন্ত যেন আনন্দই পেত না। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও খেলত সমানতালে।
স্কুল শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, মুঠোফোন আর বিদেশী খেলার চাকচিক্যতায় হ-ডু-ডু এখন পাঠ্যপুস্তকের একটি অংশ হিসেবেই কেবল নামটি ধরে রেখেছে। বতর্মান সময়ের  ছেলেমেয়েরা আমাদের  দেশীয় সংস্কৃতির চাইতে বিদেশী খেলার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম দুলাল বলেন, গত দশ বারো বছর আগেও ছেলেদের পাশাপাশি ছোট মেয়েরাও  হ-ডু-ডু খেলত। এতে তাদের শরীরের গঠন যেমন ভালো হতো তেমনি খাবার খেতে বায়না করত না। বর্তমানে  ফাস্ট ফুড আর বিদেশী খেলার প্রতি প্রবল আকর্ষণের কারণে এখনকার শিশু ও তরুণরা দেশীয় খাবার ও খেলাধুলাগুলোকে গেঁও মনে করছে।
পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে দীর্ঘদিন ধরে হ-ডু-ডু খেলার কোনো আয়োজনই কোথাও নেই। স্কুলের শিক্ষার্থীদের আগে গরু খাসি কিংবা টেলিভিশন পুরস্কার দিয়ে হ-ডু-ডু খেলার যে আয়োজন হতো সেটা নতুন প্রজন্মের কাছে যেন রূপকথার গল্প। অথচ দেশীয় আনন্দদায়ক খেলাগুলো ফেলে বিদেশী ক্রিকেট ও ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সারারাত জেগে হৈ-হুল্লোড় করে উপভোগ করার ঘটনা প্রতিনিয়তই চোখে পড়বে যেকারুরই। শুধু তাই নয় এসব খেলাকে কেন্দ্র করে উঠতি বয়সের যুবক ছেলেদের অনেকেই বাজি লাগিয়ে জুয়ায় মেতেছে। এছাড়া বিশ্বকাপ ক্রিকেট ও ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে প্রিয়দলের হারজিত নিয়ে পক্ষ প্রতিপক্ষের মধ্যে ঝগড়া মারামারির মতো ঘটনাও ঘটছে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সালে এ খেলার নামকরণ হয় কাবাডি। সে বছরই কাবাডি জাতীয় খেলার মর্যাদাও পায়। তবে জাতীয় খেলার মর্যাদা পেলেও এ খেলা তখন কেবল গ্রাম-বাংলাতেই হতো। ১৯৭৮ সালে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং বার্মার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশন গঠন করা হয়। ১৯৮০ সালের ফেরুয়ারিতে প্রথম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এশিয়ান কাবাডি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ভারত চ্যাম্পিয়ন এবং বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়। ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে অন্তর্ভুক্ত হয় কাবাডি। এ প্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রৌপ্যপদক গ্রহণ করে বাংলাদেশ।
পঞ্চগড় সদর আধুনিক হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মনসুর আলম বলেন, শরীর গঠনে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। খেলাধুলার বাইরে থাকায় ও মুঠোফোনে আসক্তি বেড়ে যাওয়ায় শিশু থেকে বড়রাও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ছেন। পঞ্চগড়ে জাতীয় এ খেলাটি হারিয়ে যাবার কারণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে পুনরায় ফেরাতে করণীয় সম্পর্কে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত স¤্রাট বলেন, স্কুল ও কলেজভিত্তিক প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিভিন্ন ক্লাব ও ক্রীড়া সংগঠনগুলো উদ্যোগী হলে জাতীয় খেলা হ-ডু-ডু পুনরায় প্রাণ ফিরে পাবে। এক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকলে সম্ভব হবে।

×