ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

কুসুম্বি যুদ্ধে তিন হানাদার সৈন্য নিহত হয়

মো. হারেজুজ্জামান হারেজ, সান্তাহার, বগুড়া

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ২২ মার্চ ২০২৩

কুসুম্বি যুদ্ধে তিন হানাদার সৈন্য নিহত হয়

মো. আবুল হোসেন

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হোসেন (৭৪)। বগুড়ার আদমদীঘি রেলওয়ে স্টেশন বাজার এলাকার বাসিন্দা যুদ্ধকালীন এই কমান্ডার যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন আমি সান্তাহার কলেজের ছাত্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশের মতো আমার জন্মস্থান গ্রামের স্বাধীনতাকামী সবার মাঝে উৎকণ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর চিন্তা করলাম দেশের জন্য কি করা যায়? তখন দেশের অনেকে ভারত যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে। একদিন বিকেলে আমার দুই বন্ধু নবির ও মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলাম আমরাও ট্রেনিং নিতে ভারত যাব। কিন্তু তখন তো যাওয়াও কঠিন, রাস্তা-ঘাট কিছু চিনি না। 
তিন বন্ধু সাহস করে একদিন খুব সকালে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেই। তিনি বলেন, আমরা আদমদীঘি সদরের খাড়ির ব্রিজে প্রধান রাস্তায় যাওয়া মাত্র পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে পড়ি। কিন্তু ভাগ্য ভাল যে তারা আমাদের গুরুত্ব দেয়নি। তখন হাজার হাজার শরণার্থী যাচ্ছিল ভারতে। সেই শরণার্থী দলের সঙ্গে এক দিনেই হেঁটে রাতের বেলা পৌঁছে যাই ভারতের কামারপাড়া। এলাকা থেকে আমরাই প্রথম দল হিসেবে যাই। 
যাওয়ার পরদিন আমরা তিন বন্ধু কামারপাড়া মুক্তিযোদ্ধা ভর্তি ক্যাম্পের লাইনে দাঁড়ালাম। বাছাইয়ে শুধু আমি টিকলাম। নবির আর মোসলেম বাদ পড়ে গেল। এতে তিনজনেরই মন খারাপ হয়ে গেল। তখন আমাদের এলাকার নেতা তৎকালীন এমপি কছিম ভাইকে খুঁজলাম। কিন্তু তাঁকে পেলাম না, কিন্তু হাল ছাড়লাম না। খুঁজতে খুঁজতে দেখা পেলাম রাজশাহীর সাবেক এমপি সরদার আমজাদ হোসেনের। তাকে আমার দুই বন্ধুর বাদ পড়ার কথা জানালাম।

তখন তিনি আমার দুই বন্ধুকে বললেন তোমরা কি সত্যিই ট্রেনিংয়ের জন্য থাকবে-যুদ্ধের মাঠে যাবে? পালিয়ে যাবে নাতো? অনেকে কিন্তু রাজি হলেও পরে পালিয়ে যাচ্ছে। তার প্রশ্নের জবাবে ওই দু’জন দৃঢতার সঙ্গে রাজি হলে তিনি বললেন ঠিক আছে তোমরা আগামীকাল সকাল ৮টার মধ্যে ক্যাম্পে আসো আমি থাকব। পরদিন যথা সময়ে গেলাম। যাওয়ার পরই দেখলাম সরদার আমজাদ সাহেব গাড়ি নিয়ে ঢুকতেছে। তিনি আমাদের দেখে চিনতে পেরে বলেন ভেতরে চলে আসো। যাবার পর ওই দু’জনকে ভর্তি করে নিল। 
ভর্তির পর কামারপাড়া ক্যাম্পে আমাদের ট্রেনিং শুরু হলো। ১৫ দিনের মতো ট্রেনিং চলার পর প্রচ- বৃষ্টি ও বন্যা দেখা দিল। তখন আমাদের ভারতের রায়গঞ্জ পাঠাল। কিন্তু সেখানেও বন্যা, এজন্য পাঠায় কালিয়াগঞ্জ। কালিয়াগঞ্জ থেকে পাঠায় শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়িতে মাসখানেক ট্রেনিং দেওয়া হলো। ট্রেনিং শেষে ফের কামারপাড়া নিয়ে আসা হলো। এবার পালা যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশে (সে সময় পূর্ব পাকিস্তান) পাঠানো। কিন্তু গিয়ে কোথায় ও কোন বা কার শেল্টারে মুক্তিযোদ্ধারা থাকবে সেটা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। শেল্টার খুঁজতে ভয়ে কেউ আসতে চায় না।

শেষে আমি একজনকে সঙ্গে নিয়ে আদমদীঘি চলে আসলাম। এসে আমার জন্মস্থান গ্রাম ম-বপুরাসহ দুই গ্রামে শেল্টার ঠিক করে ফের চলে গেলাম ভারতের কামারপাড়া ক্যাম্পে। আগস্ট মাসে আমাকে যুদ্ধকালীন কমান্ডার নিযুক্ত করে ৬০ মুক্তিযোদ্ধাকে যুদ্ধের মাঠে পাঠাল। আদমদীঘি এসে আমরা দু’ভাগ হয়ে ওই দুই শেল্টারে থেকে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করি। 
প্রথমে হানা দিলাম আদমদীঘি থানায়। আমাদের ফায়ারে শব্দ পেয়ে থানায় কর্মরত পুলিশ অফিসার, ফোর্স ও রাজাকাররা পালাতে শুরু করে। আমরা কয়েক রাজাকারকে ধরে ফেলি। পরে তাদের বোঝাই যে, আমাদের স্বাধীনতা অর্জন অনিবার্য। তোমরা ভুল স্বীকার কর, এখনো সময় আছে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধ কর। এর মধ্যে একজন ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে (কিছুদিন আগে বাবু নামের ওই সহযোদ্ধা মারা গেছেন)। অন্যরা মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও রাজাকারদের সঙ্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। 
কমান্ডার আবুল হোসেন তার স্মৃতিচারণ করে আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আমরা খবর পাই যে, আদমদীঘি থেকে রাজাকাররা হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে পাশের রানীনগরের আবাদপুকুর গেছে। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে তাদের ফেরার পথে আক্রমণ করব। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা পজিশন নিলাম আদমদীঘি-আবাদপুকুর রাস্তার কুসুম্বি স্কুলে দক্ষিণ দিকে। সেখানে রাস্তার পূর্ব ও পশ্চিমে দু’ভাগে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম।

দুপুরের পরে রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যদের ফিরে আসার আওয়াজ পেলাম। কাছাকাছি আসতেই শুরু করে দিলাম ফায়ার। কিন্তু পুকুর পাড়ে আমাদের সেট করা মেশিনগান একটু উঁচুতে ছিল। ফলে গুলির বেশির ভাগ ওদের মাথার ওপর দিয়ে যায়। তবে কিছু গুলি ওদের অবস্থানে গিয়ে লাগে। ওরাও তখন পাল্টা পজিশনে যায়। 
এদিকে গুলির শব্দ শুনে আদমদীঘি রেল স্টেশন থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শেলিং শুরু করে। একটা শেল এসে পড়ে আমাদের পজিশন নেওয়া পুকুরের পানিতে, আমরা ভয় পেয়ে যাই। তখন চিন্তুা করলাম শেল এসে যদি পাড়ে পড়ে তাহলে কারও বাঁচার উপায় নেই। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে মুখোমুখি যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমাদের গোলাও শেষ পর্যায়ে। তখন কৌশল পাল্টে পিছু হটে যাই ওদের পথ ক্লিয়ার করার জন্য। আমরা পিছু হটে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাই ওরা যেখানে আমাদের আক্রমণের মুখে পড়েছিল সেখানে। ইতিমধ্যে ওরা আদমদীঘির পথে। আমরা স্পটে গিয়ে তিন পাকিস্তানি সৈন্যের লাশ দেখতে পাই।

কুসুম্বি যুদ্ধের ১৫ দিন পর ফের পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের মুখোমুখি হই কুসুম্বি পাশের বিশিয়া গ্রামের মধ্যে। সেখানে দুই পক্ষে ব্যাপক গোলাগুলি চলে। কিন্তু ঘরবাড়ি ও গাছপালার কারণে কোনো পক্ষই সঠিক নিশানা পাচ্ছিলাম না। এজন্য কোনো হতাহত হয়নি। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষ রণে ভঙ্গ দিয়ে যে যার দিকে পিছু হটে যায়। বিশিয়া যুদ্ধের সপ্তাহখানেক পর একই ঘটনা ঘটেছিল আদমদীঘির বিহিগ্রাম হাটে। অব শেষে আদমদীঘি ও সান্তাহারের চার পাশের সব মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট মিলিতভাবে ১২ ডিসেম্বর আদমদীঘি সদর এবং ১৪ ডিসেম্বর সান্তাহারের পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটিতে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে তাদের বিতাড়িত করার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হবার দু’দিন আগে আমাদের পুরো আদমদীঘি শত্রুমুক্ত করি।

×