ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিরাজগঞ্জ-৪

বড় দু’দলেই মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড়, রয়েছে কোন্দল

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:১৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বড় দু’দলেই মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড়, রয়েছে কোন্দল

উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার যমুনাপাড়ের জেলা সিরাজগঞ্জে নির্বাচনী ভোটের হাওয়া

উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার যমুনাপাড়ের জেলা সিরাজগঞ্জে হালকা শীতের আমেজের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী ভোটের হাওয়াও জোরেই বইতে শুরু করেছে। এর বাইরে ৯ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী আসন সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া)। আসনটিতে দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বড় একটা ভোট ব্যাংক রয়েছে। টানা তিন মেয়াদে বিজয়ের পর চতুর্থবারের মতো নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে নির্বাচনী মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।

বিএনপি নির্বাচনী মাঠে ততটা সরব না হলেও আসনটি ফিরে পেতে চেষ্টার কোনো কমতি নেই। তবে বড় দু’দলেই মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড়ে মনোনয়ন নিয়ে কম-বেশি অভ্যন্তরীণ বিরোধ, দ্বন্দ্ব রয়েছে।
একটি পৌরসভা ও ১৪ ইউনিয়ন নিয়ে এ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৯১ হাজার ১১৪। উল্লাপাড়া সিরাজগঞ্জ জেলার অন্যতম গুরুতপূর্ণ একটি নির্বাচনী এলাকা। সরকারের এক সময়ের জাঁদরেল আমলা এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম এইচটি ইমামের আসনও হচ্ছে এই উল্লাপাড়া।

গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচনী এই আসনটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এক সময় পাট বন্দর ছিল এই উল্লাপাড়ায়। ২০০১ সালে চার দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোরী পুর্ণিমা রাণী শীল। মামলাটি দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সেই মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত হয়েছে। 
এ আসনে ১৯৯১ সাল থেকে চারবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। অপরদিকে বিএনপি প্রার্থী ধান শীষ প্রতীক নিয়ে লড়ে দু’বার বিজয়ী হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রধান এ দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যেই রয়েছে দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং। তাই দলের প্রার্থী বাছাইয়ের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন দু’দলের নেতারা। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ এই আসনটি নিজেদের দখলে রেখেছে। আসনটিতে চতুর্থবার জয়ের আশা নিয়েই কাজ করছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। 
সিরাজগঞ্জ-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের তানভীর ইমাম দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনেও মনোনয়ন পেতে দৃঢ় আশাবাদী। তবে তানভীর ইমাম ছাড়াও আসনটিতে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ জাহেদুল হক জাহিদ, বর্তমান পৌর মেয়র এসএম নজরুল ইসলাম, সাবেক এমপি আব্দুল লতিফ মির্জার কন্যা মুক্তি মির্জা মনোনয়ন পেতে নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। 
বিএনপিতেও রয়েছে একাধিক প্রার্থী। মনোনয়ন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে টানাপোড়েন অনেকটাই স্পষ্ট। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে সাবেক এমপি এম. আকবর আলী, অ্যাডভোকেট শামসুল আলম, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল হক ও জামায়াতের রফিকুল ইসলাম খানও নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নির্বাচনী মাঠে থেকে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন।
আগামী দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে এই আসনে সকল দলেরই আগ্রহী সম্ভাব্য প্রার্থীরা যার যার অবস্থান থেকে মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মাঠে সরব হলেও বিএনপি প্রার্থীদের মাঠে তেমন দেখা যাচ্ছে না। দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার হাট-বাজারে নিজ দলের সমর্থকদের নিয়ে গণসংযোগ করছেন।
গত তিনটি নির্বাচনে পরপর তিন দফা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এ কারণে ভোটের বিচারে অনেকাংশেই এগিয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনেও এ আসনটি ধরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। অপরদিকে হারানো আসন পুনরুদ্ধারে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভেতরে ভেতরে মাঠে কাজ করছেন। বিএনপির নেতৃবৃন্দের দাবি, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এই আসনটিতে বিএনপি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবে। 
একাদশ জাতীয় সংসদের একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম জনকণ্ঠকে বলেন, সংসদ সদস্য হিসেবে আমার নির্বাচনী এলাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণাকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সহায়ক ভূমিকা পালন করেছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, প্রায় ৭৫ ভাগ ভূমিহীন-আশ্রয়হীন পরিবারকে জমি ও বাড়ি দেওয়া হয়েছে।

প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই প্রায় ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯৪ মিটার দীর্ঘ করতোয়া নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ, উল্লাপাড়া উপজেলা সদর হতে চলনবিল অধ্যুষিত মোহনপুর-উধুনিয়া সড়ক প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কে উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশনে একশ’ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে।  
তিনি বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রায় শতভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণসহ স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা ভবনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি যদি আমাকে দলীয় মনোনয়ন দেন, নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হতে পারলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে একজন সহযাত্রী হতে চাই।

তা ছাড়াও উল্লাপাড়ায় অসমাপ্ত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ ও সম্প্রসারণ, নারী শিক্ষা প্রসার, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, বাল্যবিয়ে রোধ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় দারিদ্র্যমুক্ত উল্লাপাড়া গড়তে ভূমিকা রাখব।
আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক এমপি বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভোট ব্যাংক তছনছ করে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সহায়তায় জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিল। আমি ভোটারের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করেছিলাম। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দল আমাকে মনোনয়ন দিলে জনগণ আবারও আমাকে ভোট দিবে বলে বিশ্বাস করি।
অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহেদুল হক জাহিদ বলেন, আমি আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের একজন সন্তান, কথা বলার বয়স হবার পরপরই আমি আমার পরিবার থেকে জয় বাংলা শিখেছি। পঁচাত্তর পরবর্তীতে উল্লাপাড়ায় আমার পিতা জহুরুল হক আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেছে। দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। তিনি এও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এ আসনটি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চাই এবং তাঁকে (শেখ হাসিনা) প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসাতে চাই। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমি সহায়ক শক্তি হতে চাই।
অন্যদিকে, বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি এম. আকবর আলী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার চায় তাদের অধীনে নির্বাচন হোক। যদি এই সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে জনগণ ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে না, পুলিশ প্রশাসন দিয়ে জোর করে ভোট নেওয়া হবে। তাই তাদের কেউ হারাতে পারবে না। এজন্য এ সরকারের অধীনে বিএনপি ভোটে যাবে না। নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে মানুষ গণতন্ত্র ফিরে পেলে বিএনপি ভোটে যাবে। তিনি বলেন, আমি এমপি থাকাকালীন উল্লাপাড়ার শিক্ষাখাতসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছি, যার ফল জনগণ এখনো পাচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে উল্লাপাড়ায় এম. আকবর আলীর বিকল্প নেই বলে তিনি দাবি করেন। 
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল বাতেন হিরু জানান, দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহের কারণে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমান এমপি তানভীর ইমামের নেতৃত্বে দলীয় শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, দল এখন আগের তুলনায় অনেক সুসংগঠিত।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেমন জনপ্রতিনিধি চাই প্রশ্নে উপজেলার মোহনপুরের উত্তম কুন্ডু জানান, সৎ, নির্লোভ ও কঠোর হস্তে সন্ত্রাস দমনের যোগ্যতা সম্পন্ন নেতৃত্ব চাই। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এ অঞ্চলের এমপি মহোদয়ের হস্তক্ষেপে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছি। 
উধুনিয়া গ্রামের আব্দুল মান্নান জানান, এই সরকারের আমলে গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতায়ন হয়েছে, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মিত হয়েছে, রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে। চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্ধকার থেকে যারা আলোর পথ দেখিয়েছে এবং দেখাবে আমরা ভোটাররা তাকেই ভোট দেব। শীতের অতিথি পাখির মতো বা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ভোট চাইলেই তাকে ভোট দেওয়া যাবে না। 

×