ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালির প্রিয় শীতের আড্ডা

সন্ধ্যায় শুরু, পালা বদলে চলে গভীর রাত পর্যন্ত

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ৩০ নভেম্বর ২০২২

সন্ধ্যায় শুরু, পালা বদলে চলে গভীর রাত পর্যন্ত

বগুড়ার নবাববাড়ি সড়কে জেলা পরিষদ চত্বরে জমে উঠেছে শীতের আড্ডা

ভোরের তেরছা রোদ কুয়াশার আঁচলচিরে জলরাশিতে ঝিলিক তুলেছে। সেখানে এক জোড়া সাদা হাঁস সদ্যস্থান সমাপনে উচ্চকণ্ঠে খোশখবর দিচ্ছে- শীতের নাচন শুরু হয়েছে। এই নাচনে দ্রুতই জমে উঠছে বাঙালির প্রিয় আড্ডার পালা। অন্যান্য সময়ের চেয়ে শীতের আড্ডা সবচেয়ে মধুময়।
দেশের নগরী ও শহরাঞ্চলের জন সমাগম পয়েন্টগুলোতে সন্ধ্যায় আড্ডা শুরু হয়। অংশগ্রহণকারীদের পালাবদল চলে রাত অবধি। আড্ডার এই পালাকে কেন্দ্র করে চা দোকানি ফুচকাওয়ালা চিতই পিঠাওয়ালারা রাস্তার ধারে ফুটপাতে পসরা সাজায়। মহানগরী উত্তর ঢাকা সিটির মোহাম্মদপুরে শেখেরটেক এলাকায় সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দেখা গেল শীতের সান্ধ্যকালীন খাবারের সঙ্গে আড্ডা জমে উঠেছে।

দক্ষিণ ঢাকা সিটির এলাকাগুলোতেও একই অবস্থা। পুরান ঢাকার শীতের বিলাস তো মহাআড্ডা। তা ঘরে ও বাইরে। বগুড়া নগরীতে দেখা গেল লেখক চক্রের শীতের আড্ডা জমে ওঠে। এই সময়ের আড্ডার আলোচনার একটি অংশ কেড়ে নিয়েছে ফিফা বিশ^কাপ ফুটবল। বেশিরভাগ দর্শক বিশে^র ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। ফুটবল ক্রেজের পাশে বড় আসন কেড়েছে রাজনীতি। বিশ^কাপ থাকবে এক মাস।

আরও এক মাস চলবে বিশ্লেষণ। প্রায় এক বছর পর সাধারণ নির্বাচন। সাধারণ নির্বাচনের আড্ডার পালা শুরু হয়েছে। এখানেও আলোচনায় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে এবার শীত থাকবে এপ্রিল পর্যন্ত। সুতরাং শীতের আড্ডা দীর্ঘ হয়ে থাকবে।
গ্রামের এই আড্ডা দুই দফায়। সকালের মিষ্টি রোদে ও সন্ধ্যায়। শীত নিরারনে খড়কুটা জ্বালিয়ে চারধারে গোল হয়ে বসে উষ্ণতার সঙ্গে আড্ডাও চলে সমান তালে। এই আড্ডাগুলো ব্যক্তি ও পরিবার থেকে সমাজ, দেশ থেকে বিশ্বের তাবত খবরের বিশ্লেষণ। মানব জীবনের এমন কিছু নেই যা এসব আড্ডায় আলোচনায় আসে না। গ্রামের আড্ডাতেও বাড়তি যোগ হয় রাজনীতি।         
ছেলে বুড়ো সকলেই আড্ডার ভক্ত। জেন্ডারের কোনো ভেদাভেদ নেই। আড্ডার বিতর্কের পালা শুরু হলে থামতেই চায় না। অমীমাংসিতই থাকে। কখনো বলা হয় আড্ডায় না গেলে পেটের ভাত হজম হয় না। এই আড্ডা থেকেই বের হয়ে আসে অনেক সৃষ্টিশীলতা। লেখালেখির সঙ্গে যারা যুক্ত তারা সৃষ্টির অনেক ক্লু ও খোড়াক পেয়ে যায় আড্ডায়। অনেক না বলা কথা অবচেতনে বলা হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স স্টুডেন্ট সেন্টার (টিএসসি) চত্বর ছিল সৃষ্টিশীল আড্ডার চারনভূমি। কত কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক শিল্পীর জন্ম হয়েছে এসব আড্ডায়।
আড্ডার সেই চিরন্তন গান গেয়েছেন মান্না দে। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’। গানের এই কথাগুলো প্রবীণদের নস্টালজিক করে চোখে জল এনে দেয়। প্রজন্মের কাছেও আড্ডার এই গান অধিক প্রিয়। তারও সেদিনের মতো করে আড্ডা জমায় সেলফোনে অন্তর্জালে চ্যাটিংয়ে। আড্ডা সকল দেশে সকল জাতির মধ্যে আছে। কেউ সময় কাটাতে। কারও কাজ নেই খই ভাজের আড্ডা।

কেউ মধ্যম পন্থায়। বর্তমানের আড্ডা উন্মুক্ত স্থানেই হয় বেশি। দেশের এমন কোন জেলা, উপজেলা, গ্রাম নেই যেখানে আড্ডা নেই। একেক আড্ডার ধরন আলাদা তবে বৈশিষ্ট্য একই সুতোয় বাঁধা। আড্ডা জমিয়ে তোলার কিছু পয়েন্ট থাকে। বর্তমানে এইসব পয়েন্টে জনসমাগম দেখে চা-ওয়ালা,পিঠাওয়ালা চটপটিওয়ালা, ফুচকাওয়ালা বাদাম ওয়ালারা পসরা সাজিয়ে বসেছে।  
বর্তমানে এরা যে পয়েন্টগুলোতে ভ্রাম্যমান গাড়ি নিয়ে দাঁড়ায় সেখানে কাঠের বেঞ্চ প্লাস্টিকের চেয়ার সাজানো থাকে। কাস্টমার এসে একটু আয়েশে বসে ফুচকা চটপটি সহ মুখরোচক খাবার খায়। বসে আড্ডাও দেয়। তরুণ তরুণীরা স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে। ইন্টারনেট ফেসবুকে প্রবেশও হয় আড্ডাও চলে।  এদের কেউ নগরীর ওয়াইফাই জোন এলাকায় বসে। বগুড়া শহরের সাতমাথায় কৃষ্ণচূড়া চত্ত্বর, নবাব বাড়ি সড়কে শহীদ খোকন পার্কের গেটের সামনে আড্ডা জমে। ভ্রাম্যমান চায়ের দোকানীরাও অনেক ধরনের চা বানায়।

লাল চা লেবু চা, আদা চা, গ্রিন টি, দুধ চা, ব্লাক কফি, দুধ দেয়া কফি, তুলসী চা, মশলা চা, মরিচ চা। চায়ের যে কত ধরন। বগুড়া নগরীর জেলা পরিষদের সামনে লেখক চক্রের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে শীতের জমপেশ আড্ডায় অংশ নেয় দেশের কবি সাহিত্যিকগন। ভারত থেকেও এসেছিলেন। তারা বললেন পশ্চিমবঙ্গে শীতের আড্ডা এতটাই জনপ্রিয় যে আড্ডা ছাড়া ঘুমই হয় না।  

×