ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুই দিনেও গ্রেপ্তার হয়নি

কুমিল্লা দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করছে জঙ্গিরা

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২২ নভেম্বর ২০২২

কুমিল্লা দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করছে জঙ্গিরা

সামরিক শাখার প্রধান মশিউর রহমান ওরফে আইমান

ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশের চোখে-মুখে পিপার স্প্রে ছুড়ে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান মশিউর রহমান ওরফে আইমান। তার নেতৃত্বে আদালত প্রাঙ্গণে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে এ অপারেশনে অংশ নেয় ১০ থেকে ১২ জন। আদালত প্রাঙ্গণ থেকে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে রবিবার দুপুরে ছিনিয়ে নেওয়ার পর মঙ্গলবার পর্যন্ত দুইদিনেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশঙ্খলা বাহিনী।
ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে। চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশিও চালানো হচ্ছে। জঙ্গিরা এখনো দেশের ভেতরেই আছে এবং তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি। জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১০ জঙ্গিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট-সিটিটিসি।

কারাগার থেকে ‘সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি, সাজাপ্রাপ্ত বা একাধিক মামলায় দ-প্রাপ্তদের’ আদালতে উত্থাপনের সময় ডা-াবেড়ি পরানোর ব্যবস্থা নিতে কারা সদর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন প্রসিকিউশন পুলিশের প্রধান। আদালতে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের জন্য ৩০টি হেলমেট ও ৩০টি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট দেওয়া হয়েছে। দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাস্থল, কারাগারসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও জ্ঞিাসাবাদ করেছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। আদালতে ও কারাগারে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে আদালতে ও কারাগারে নিরাপত্তার অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা ছিল বলে পুুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারে বসেই মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ৪ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয় গত মে মাসে। কারাগারের ভেতরে জঙ্গিদের সঙ্গে কারাগার ফটকে স্বজন সেজে দেখা করে পরিকল্পনার কথা বলেছে সহযোগী জঙ্গিরা। কারাগারের মধ্যেই স্মার্টফোন ব্যবহার করেছে তারা। ৪ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হলেও তারা দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়। যে  দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি, তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। তারা জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের জন্য মোটরসাইকেলটি বিক্রয় ডটকমের মাধ্যমে আতিকুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি কিনে নেয় গত মে মাসে। পুলিশ আতিকুজ্জামানকে খুঁজতে গিয়ে দেখে, তার এনআইডি, ছবি সবকিছুই ভুয়া। এমনকি মালিকানাও তারা বদল করেনি। পুরান ঢাকার বাসিন্দা হাসান আল মামুন নামে মোটরসাইকেলটির নিবন্ধন থাকাকালেই গত মে মাসে বিক্রি করে দেওয়া হয় বলে সিটিটিসির কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে।

সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিকে তারা শনাক্ত করেছেন। খুব শীঘ্রই তাকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আশাবাদী কর্মকর্তারা। কারাগারের মধ্যে জঙ্গিরা কিভাবে স্মার্টফোন ব্যবহার করল, সেটাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিতে তাদের আদালতে আনা-নেওয়া এবং কোর্ট চত্বর তারা দীর্ঘদিন মনিটরিং করেছে। আসাদুজ্জামান জানান, এই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তির সঙ্গে আরও কারা জড়িত ছিল, তাদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে।

জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা কিভাবে হয়েছে, সেটাও আমরা গোয়েন্দার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। পরিকল্পনা ও অপারেশনে কারা কারা ছিল, এরই মধ্যে গোয়েন্দা তথ্যে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি। তাদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেপ্তার করা আমাদের মূল লক্ষ্য। সিটিটিসি প্রধান বলেছেন, ৪ জনকে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, তবে দুইজনকে তারা নিয়ে যায়। প্রথমে ৪ জন নেমেছে, তাদেরই তারা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।

যদি একসঙ্গে আরও বেশি জঙ্গি নামলে হয়তো তাদেরও ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিল আনসার আল ইসলামের শীর্ষপর্যায়ের জঙ্গিরা। যে ৪ জনকে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে, তার মধ্যে মো. আরাফাত রহমান (২৪) ও মো. আ. সবুর ওরফে রাজু ওরফে সাদ ওরফে সুজনকে (২১) নিতে পারেনি।
যেভাবে জঙ্গিরা পালিয়েছে ॥ ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আদালতের ফটকের সামনে থেকে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আনসার আল ইসলামের ১০ জন থেকে ১৮ জনের মতো জঙ্গি অংশ নেয়। তারা ৮টি মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে এসে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে তাদের একটি দল আদালতে পুলিশের ওপর হামলা করে।

অপর আরেকটি দল আশপাশের কয়েকটি গলির ভেতরে মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ঘটনার পর ওই দুই সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিসহ অন্যরা এসব মোটরসাইকেলে পালিয়ে যান। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমনটা জানতে পেরেছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সিসি ক্যামেরায় ৬ জনকে ছিনিয়ে নেওয়ার কাজে অংশ নিতে দেখা যায়।

ছিনিয়ে নেওয়ার পর জঙ্গিরা মোটরসাইকেলে করে রায়েরবাগ হয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকার দিকে গিয়ে সেখান থেকে নদীপথে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে তিন চাকার যানে করে মেঘনা সেতুর দিকে যায়। মেঘনা সেতু হয়ে কুমিল্লার সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করছে বলে তথ্য-উপাত্ত বলছে।
প্রসঙ্গত, গত রবিবার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ফটকে পুলিশকে মারধর ও চোখে স্প্রে নিক্ষেপ করে আনসার আল ইসলামের দুই সদস্যকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। ওই সময় ওই আসামিদের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি হলেন- মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব।

তারা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত। এ ছাড়া আরও কয়েকটি হত্যা মামলার আসামি তারা। লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যা মামলার প্রধান আসামি আনসার আল ইসলামের নেতা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পলাতক দুই জঙ্গিকে ধরিয়ে দিলে ১০ লাখ করে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। সারাদেশে জারি করা হয়েছে ‘রেড অ্যালার্ট’। দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় একটি মামলাও করেছে পুলিশ।
ডা-াবেড়ি পরানোর ব্যবস্থা করার চিঠি ॥ কারাগার থেকে ‘সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি এবং সাজাপ্রাপ্ত বা একাধিক মামলায় দ-প্রাপ্তদের’ আদালতে উপস্থাপনের সময় ডা-াবেড়ি পরানোর ব্যবস্থা নিতে কারা সদর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন প্রসিকিউশন পুলিশের প্রধান।
প্রসিকিউশন পুলিশের উপ-কমিশনার জসিম উদ্দিন বলেন, বিপজ্জনক আসামিদের ডা-াবেড়ি না পরানোর কারণে ইতোমধ্যে দ-প্রাপ্তদের আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। ডা-াবেড়ি পরানো থাকলে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতো। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কারা সদর দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারা পুলিশের মহাপরিদর্শক ওই চিঠি পাবেন। এছাড়া জঙ্গি ও সন্ত্রাসীসহ অন্যান্য দুর্ধর্ষ আসামিদের আলাদা প্রিজনভ্যানে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
ডা-াবেড়িতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা ॥ ফাঁসির আসামিদের আদালতে নেওয়ার সময় তাদের ডা-াবেড়ি না পরানোর বিষয়টি নিয়েও কথা ওঠে সেদিন। গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল বলেন, কারাগার থেকে আসামি আদালতে পাঠানোর সময় ডা-াবেড়ি না পরাত আদালতের নির্দেশনা থাকায় তাদের তা পরানো হয়নি।
২০১৭ সালে চার জঙ্গিকে ডা-াবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করার ছবি সংবাদমাধ্যমে এলে ডিআইজি প্রিজন্সকে তলব করে হাইকোর্ট। পরে আদালতের আদেশে বলা হয়, ডা-াবেড়ি পরিয়ে আদালত কক্ষে কোনো আসামিকে হাজির করা যাবে না। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেওয়ার সময় ডা-াবেড়ি পরানো যাবে।
কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুজাউর বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা কোনো আসামিকে ডা-াবেড়ি পরান না। ২০১৭ সালে নির্দেশনা ছিল ডা-াবেড়ি পরানো অবস্থায় আদালতে তোলা যাবে না। তবে কারাগারে থেকে আদালত পর্যন্ত পথে ডা-াবেড়ি পরানো যাবে। কারাগারের ফটক থেকে আসামির নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে পুলিশের হাতে। এখন ফটক থেকে আসামি নেওয়ার সময় ডা-াবেড়ি পরিয়ে নেওয়ার কথা আমরা পুলিশকে বলব। মেলের মাধ্যমে প্রসিকিউশনের চিঠি পেয়েছি। যে নির্দেশনা দিয়েছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও নিরাপত্তা জোরদার ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের (প্রসিকিউশন) উপ-কমিশনার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আদালতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে তিন প্লাটুন অতিরিক্ত পুলিশ আদালতে মোতায়েন করা হয়। তারা আজো দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া আদালত প্রাঙ্গণে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে ডিএমপি ও লালবাগ বিভাগ কাজ করছে। এছাড়া সাদা পোশাকে পরিস্থিত নজরদারি করছেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।

×