
বিচারক সংকটে মামলার জট কমছে না ॥ সাড়ে ৬ হাজার নারী ও শিশু মামলা ঝুলে আছে

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ রংপুরে বিচারক সংকটে মামলার জট কমছে না। গত দেড় বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৬ হাজার ৫শ’৫৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে ।
রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) এ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারক ২জন, সিনিয়র সহকারী জজ ২জন, ও সহকারী জজ ২জনসহ মোট ৬জন বিচারক না থাকায় মামলার জট খুলছে না। বিচারক সংকটের বিষয়টি আইন মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ২১ সেপ্টেম্বর নির্মিত রংপুর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিচারক সংকটের বিষয়টি আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, খুব তাড়াতাড়ি আদালতে বিচারক সংকটের বিষয়টি সমাধান করা হবে ।
এদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) এ্যাডভোকেট খন্দকার রফিক হাছনাইন বলেন, ২০১৬ সালের ৬জুন থেকে নারীও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে বিচারক নেই। এতে করে এই ট্রাইব্যুনালে অধিকাংশ মামলার শুনানী বন্ধ রয়েছে। ফলে মামলার নিস্পত্তি করতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হচ্ছে এবং বাদি ও আসামী পক্ষের মধ্যে জটিলতা বাড়ছে।
অপরদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল (২) এর সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট মাকজিয়া হাসান দিবামনি জানান, বিচারক না থাকায় জামিন শুনানী হচ্ছে না। তবে এখন নিয়মিত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত (১) এর বিজ্ঞ বিচারক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের মামলার বিষয়টি দেখছেন।
আদালত চত্বর ঘুরে দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দীর্ঘদিন বিচারক না থাকায় দীর্ঘদিনের মামলাগুলোর শুনানী হচ্ছে না। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০০৪ সালের মামলা নং-৪০০, বাদি রংপুর কোতয়ালী থানাধীন কামার পাড়া এলাকার একরামুলের সাথে কথা হলে তিনি জানান, নারী ও শিশু আদালতে বিচারক না থাকায় ১৩ বছর ধরে আমার মেয়ে হত্যাকান্ডের বিচার শেষ হয়নি। এছাড়াও এই মামলায় এখন পর্যন্ত কোন স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য নেয়া হয়নি। আইন মন্ত্রীর কাছে দাবি খুব তাড়াতাড়ি নারী ও শিশু আদালতে বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রমকে ত্বারাণি¦ত করবেন।
বৃহস্পতিবার রংপুর জেলাও দায়রা জজ আদালত চত্বরে কথা হয় সৈয়দ আব্দুল জলিল (৪৫)এর সঙ্গে। তার পিতা মৃত অতাব মন্ডল। পেশায় একজন রিক্্রা চালক। ২ ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে ঢাকার গুলশান এলাকায় রিক্রা চালান। বড় ছেলে মাহাবুব (৩৪) ঢাকায় রিক্রা চালান। ছোট ছেলে মোস্তফা (৩২) ঢাকায় একটি বিস্কুটের ফ্যাক্টরীতে কাজ করেন। সৈয়দ জলিল জানান, অভাবের সংসারে লবণ আনতে পান্তা ফুরায়। এক সময় তার পুকুরে মাছ আর গোলাভরা ধান ছিলো। এখন কিছুই নেই । সংসারে এখন ৩জন আয় করি তার পরেও ধারদেনা করে চলতে হয়। তিনি জানান, ১৯৯৩ সালে পীরগঞ্জের শানের হাট মেস্টা পাড়া এলাকায় জমি বিরোধের জের ধরে উভয় পক্ষে সংঘর্ষে ২টি হত্যাকান্ড হয়। এই ঘটনায় ওই এলাকার আনছার আলী মন্ডল ও ফুলজার মন্ডল গংদের আসামী করে রংপুর পীরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করি যার নং ৪৯/৯৩ইং। দীর্ঘ ১২ বছর মামলাটি চলার পর খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু গত ১ বছরে বিচারক না থাকায় এই মামলাটিতে এখন পর্যন্ত কোন স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ বা শুনানী করতে পারেনি।
মিঠাপুকুর উপজেলার ১৬নং মির্জাপুর রুহিয়া বানিয়াতপুর এলাকার শের আলীর জানান, ২০০৫ সালে ছোট রুহিয়া বিল এলাকার প্রায় ১৬ জন মৎস্যচাষী ইজারা নেই। ইজারা নেয়ার পর ওই বিলে মাছ চাষ করি। কিন্তু মাছ উত্তোলনের সময় মিঠাপুকুর ইসলামপুর এলাকার আবুল সর্দার ও তার লোকজন বাঁধা দেয়। এতে উভয় পক্ষে সংঘর্ষে প্রায় ৫০জন লোক আহত হয় এবং আবুল সর্দারের ছোট ভাই হাকিম সর্দার মারা যায়। পরে দিন আবুল সর্দার ২৪ জনকে আসামী করে রংপুর মিঠাপুকুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে যার জিআর নং ৭১। এই মামলায় আদালতে স্বাক্ষীরা না আসার কারণে ১৩ বছর ধরে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে বলে তিনি জানান।
রংপুর আইনজীবি সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট আব্দুল কাইয়ুম মন্ডল জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ২জন বিচারকসহ মোট ৬ জন বিচারক নেই। এতে করে বিচার কার্যক্রমে বাঁধ সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও একজন বিচারকের পক্ষে একাধিক ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব পালন করা কষ্টকর।
হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ রংপুরের কনভেনর এ্যাডভোকেট এম এ বাশার বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল একটি গুরুত্বপূর্ণ আদালত। এই আদালতে দেড় বছর থেকে বিচারক না থাকায় মামলায় জট সৃষ্টি হচ্ছে। বিচারক সংকটের কথা উল্লেখ তিনি বলেন, বিচারক না থাকায় বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। মামলার স্বাক্ষীরা আদালত থেকে ফিরে যাচ্ছে। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় ন্যায় বিচার থেকে বিচার প্রার্থীরা বঞ্চি হচ্ছেন। তিনি আইন মন্ত্রীর নিকট অতি সত্তর বিচারক নিয়োগ প্রদানের দাবি জানান।