ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটবলে বিশৃঙ্খলা ক্রেজ, নাকি অশনি সঙ্কেত?

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

ফুটবলে বিশৃঙ্খলা ক্রেজ, নাকি অশনি সঙ্কেত?

রুমেল খান ॥ বুধবার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ভবনে ডিসিপ্লিনারি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ফেডারেশন কাপের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে রেফারিকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে এবং ফাইনালে প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে মারামারিতে জড়ানোর অপরাধে বড় ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে একাধিক ফুটবলার, এক ম্যানেজার এবং দুই বলবয়কে। গত ৮ নবেম্বর আবাহনী-আরামবাগ কোয়ার্টার ফাইনালে আবাহনীর কাছে ৩-২ গোলে হারার পর ম্যাচ শেষে রেফারিকে মারধর করার অপরাধে আরামবাগের ম্যানেজার রাশেদুল হাসান সুমনকে এক লাখ টাকা জরিমানা এবং এক বছরের নিষেধাজ্ঞা, আরামবাগের দুই বলবয় রাকিব হোসেন ও জুয়েল রানাকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া আরামবাগকে জরিমানা করা হয় ৫ লাখ টাকা। এছাড়া গত ২৩ নবেম্বর অনুষ্ঠিত আবাহনী-বসুন্ধরা কিংস ফাইনাল ম্যাচে মারামারির জন্য ৮ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন বসুন্ধরার ডিফেন্ডার সুশান্ত ত্রিপুরা। এছাড়া তাকে জরিমানা করা হয়েছে ১ লাখ টাকা। তার সতীর্থ ফরোয়ার্ড ও অধিনায়ক তৌহিদুল আলম সবুজকে দেয়া হয়েছে ৬ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। আবাহনীর ডিফেন্ডার মামুন মিয়ারও হয়েছে সবুজের মতোই একই শাস্তি। ২ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন আবাহনীর ফরোয়ার্ড নাবিব নেওয়াজ জীবন। অভিযুক্ত ফুটবলারদের আপীল করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ফেডারেশন কাপে ম্যানেজার্স মিটিং-এ ব্রাদার্স ইউনিয়ন, নোফেল স্পোর্টিং এবং আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের টিম ম্যানেজার উপস্থিত না থাকায় এবং ওই প্রতিযোগিতার প্রি-ফাইনাল প্রেস কনফারেন্সে বসুন্ধরা কিংসের হেড কোচ উপস্থিত না থাকায় ‘ওই তিনটি দলকে ১৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। মৌসুম শুরু হয়েছে ফেডারেশন কাপ দিয়ে। শুরুতেই ফুটবলে এই যে গ-গোল, বিশৃঙ্খলা... এগুলো নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছেন, এগুলো দেশের ফুটবলকে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। এমনিতেই ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমতির দিকে। তার ওপর মাঠে এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে তো এই খেলাটির জনপ্রিয়তা আরও কমে যাবে এবং কেউ খেলা দেখতে মাঠেই আসবে না। তাছাড়া মাঠে পুলিশি নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ হয়েছে বাফুফে। প্রায়ই দেখা গেছে খেলা শেষে গ্যালারির দর্শকরা মাঠে ঢুকে পড়েছে বিনা বাধায়। এছাড়া রেফারির সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে গ্যালারি থেকে জলভরা প্লাস্টিকের বোতল মাঠে ছুঁড়ে মারা তো আছেই। আর গালাগাল তো ফ্রি। তবে এর বিপরীত মতও রয়েছে। কেউ বলছেন, এ রকম মারামারি, হট্টগোল ফুটবলে থাকবেই, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই এমনটা হয়ে থাকে। এটা কোন সমস্যা বা অশনি সঙ্কেত নয়। কেউ আবার উদাহরণ দিতে চান সাম্প্রতিক সময়ে আর্জেন্টিনার দুই জনপ্রিয় ক্লাব বোকা জুনিয়র্স এবং রিভার প্লেটের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতিকে। ইংল্যান্ডের ফুটবল সমর্থকরা তো সারাবিশ্বেই দাঙ্গাবাজ হিসেবে কুখ্যাত। আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ডেও মাঠের মধ্যে ফুটবলাররা মারামারি করেন এবং শাস্তিও পান। কিন্তু তা নিয়ে কেউ সমালোচনা করে না। কাজেই বাংলাদেশের ফুটবলে এগুলো নিয়ে এত আশঙ্কা ও সমালোচনা করার কী আছে? বরং এগুলো ঘটলে নতুন প্রজন্ম দেশীয় ফুটবল সম্পর্কে আরও আগ্রহী হবে এবং স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসা দর্শকের পরিমাণও বাড়বে। তাছাড়া সব খেলাতেই তো আর বিশৃঙ্খলা-গ-গোল হয় না। আর গ-গোল তো অন্য খেলাতেও হয়, তাহলে শুধু ফুটবলের বদনাম হবে কেন? তবে আরেক শ্রেণীর ফুটবল অনুরাগীরা মনে করেনÑ বিশৃঙ্খলতা কারোরই কাম্য নয়। তবে ফুটবলের এই উত্তাপ কিন্তু দেশীয় ফুটবলের সোনালি অতীতকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। তবে কি সেই সোনালি যুগে আবারও ফিরে আসছে দেশের ফুটবল? এই প্রজন্ম কি জানে সত্তর ও আশির দশক ছিল দেশীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ? সে সময় মাঠ মাতাতেন হাফিজ, সালাউদ্দিন, এনায়েত, বাবলু, চুন্নু, সালাম মুর্শেদী, জোসি, মনু, মহসিন, আসলাম, কায়সার, সাব্বির, ওয়াসিমরা। সে সময় আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে পুরো দেশ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যেত। বিকেলে খেলা, অথচ সকাল থেকেই স্টেডিয়ামের গ্যালারি হাউসফুল। স্টেডিয়ামে ৫০-৬০ হাজার দর্শক হাজির। টিকেট ‘ব্ল্যাক’-এ বিক্রি ছিল অবধারিত। অনেকেই সেই টিকেট না পেয়ে আক্ষেপে পুড়তেন। ড্র করলে বা হারলে দুই ক্লাবের ফুটবলারদের ভয়ঙ্কর গালিগালাজ শুনতে হতো তাদের সমর্থকদের কাছ থেকে। ক্লাবে হামলা-ভাংচুর করতো সাপোর্টাররা। বিক্ষোভ-মিছিল হতো। রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর ও পোড়ানো হতো। পুলিশ প্রায়ই লাঠিচার্জ-গুলিবর্ষণ করতো। দু’দলের সমর্থকদের মধ্যে গ্যালারিতে প্রবল মারপিট হতো। অনেকে আহত এবং নিহত পর্যন্ত হতো। দলবদলের সময় থাকতো টান টান চরম উত্তেজনা। চলচ্চিত্রে ‘আবাহনী-মোহামেডান’ নিয়ে গানও হয়েছে। আবাহনী-মোহামেডানের সেই ক্রেজ এখন আর নেই। এটা সত্যিই ভীষণ দুঃখজনক। তবে গত কয়েক মৌসুম ধরে পেশাদার লীগে শেখ জামাল, চট্টগ্রাম আবাহনী, শেখ রাসেল এবং সাম্প্রতিক সময়ে বসুন্ধরা কিংসের মতো ক্লাবগুলো বড় বাজেটের দল গড়ে আবারও জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছে দেশের ফুটবলকে। প্রতিটি দলেই ভালমানের বিদেশী ফুটবলার আছে। আছে রাশিয়া বিশ্বকাপের খেলোয়াড়ও। এছাড়া স্থানীয় ফুটবলাররাও বেশ ভাল করছেন এবার। শিরোপার লড়াইটা এখন আর দুই-তিনটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আগের চেয়ে বেশি। মাঠে সেটার প্রতিফলন ঘটে। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে তাই মারামারি, গালাগালি হতেই পারে। এ ধরনের বিশৃঙ্খল কেউই আশা করেন না। তবে মাঠের লড়াইয়ের পাশাপাশি ফুটবল নিয়ে গ্যালারিতেও যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে এটাকে অনেক ফুটবলবোদ্ধারা সরাসরি সমর্থন না দিলেও ফুটবলের সুদিনের পূর্বাভাস হিসেবেই দেখছেন। মৌসুম শুরু হতেই এ ধরনের দৃশ্য অনেক প্রবীণ ফুটবল দর্শকদের নষ্টালজিক করে তুলেছে। তাদের ধারণা- আবারও জেগে উঠছে দেশের ফুটবল। তাদের ধারণা কতটা সঠিক সেটা সময়ই বলে দেবে।
×