বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সূদুর প্রসারি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। অনেক অসাধ্য কর্মসূচীর বাস্তবায়ন করেছিলেন। একটি দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য, বাঙালীর হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর একটি সময়োপোযোগী আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কোন বিষয় নেই যে তিনি স্পর্শহীন রেখেছেন। রেখে গেছেন বাংলাদেশের সকল উন্নয়নের শক্ত ভিত। আমার ধারণা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়নি এবং নতুন প্রজন্ম অনেকটা অন্ধকারেই রয়ে গেছে।
১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কালবিলম্ব না করে রাতে তিনি পাকিস্তানের পিআইএর একটি বিমানে লন্ডন যাত্রা করেন। ৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ছ’টায় লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে পৌঁছেন। লন্ডনে অনেক আনুষ্ঠানিকতা শেষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রাজকীয় কমেট বিমানে ৯ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু দেশের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। পথে তেল নেয়ার জন্য সাইপ্রাসে যাত্রা বিরতি ঘটেছিল। ১০ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। দিল্লীতে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত যাত্রা-বিরতিতে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে সৌজন্য কথাবার্তার পর ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানেই তিনি যাত্রা করেছিলেন ঢাকার উদ্দেশে। ব্রিটিশ কমেট বিমানটি তেজগাঁ বিমান বন্দর স্পর্শ করে বিকেল ৩টায়। তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ বাঙালীর ভালবাসা আর ¯েœহের পরশ ভেদ করে পৌঁছাতে তার সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা। রেসকোর্সে লাখো জনতার মাঝ থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারবর্গের সঙ্গে সন্ধ্যে পৌনে ছ‘টায় পৌঁছেন।
এত দীর্ঘ পথযাত্রা, দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা, জনসভা, আবেগ-উচ্ছ্বাস-কান্নার বিনিময়ের পর ১১ জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু সকল ক্লান্তি-ভাবাবেগ উপেক্ষা করে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। সেদিনই মন্ত্রিসভার সঙ্গে দুদফা বৈঠক করেন এবং বৈঠকে সংবিধান প্রণয়নসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু অস্থায়ী সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে বস্তুত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সরকারী বেসরকারী সকল সংস্থাসহ গোটা দেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। এবং সেনাবাহিনীর বাঙালী অংশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।
১৫ মার্চ, ১৯৭১ বাংলার জনগণ ও প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের দাবিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। এক ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কল্যাণের জন্যই তাঁকে এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে।’ তিনি সুস্পষ্টভাবে দেশবাসীকে জানান যে, ‘এই শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করার অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জনগণ যেন তা রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকে’। এক বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না। কারণ, প্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেকে মরণবরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে আর আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই। মুক্তির লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অব্যাহত থাকবে। আমি জনগণকে যে কোন ত্যাগের জন্য এবং সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে যে কোন শক্তির মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে আবেদন জানাই’। (দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ মার্চ ১৯৭১)। বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণাও স্বাধীনতার ঘোষণার নামান্তর। বঙ্গবন্ধু দেশের শাসন কার্য পরিচালনার জন্য ৩৫টি বিধি জারি করেন যার মাধ্যমে ১৫ মার্চ থেকে সমগ্র দেশ পরিচালিত হয়। বস্তুত, ১৫ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। দেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করার পর জনসাধারণ ও সরকারী কর্মচারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করতে লাগলেন।
প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠনে ব্রত গ্রহণ করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটিকে মুমূর্ষু অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য অহর্নিশ বিরামহীন প্রাণপাত পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সর্বত্র ছিল পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর ধ্বংসলীলার ক্ষতচিহ্ন। নাগরিকদের খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব ছিল প্রকট। কল-কারখানায় উৎপাদন শূন্যের কোঠায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু রাখা ও এককোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনসহ দেশের সমস্যা ছিল অগণিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ তিনি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালের বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থার পর্যালোচনা করে বিশ্বজুড়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন- স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাবে। দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। এমনি একটি ভয়াবহ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শাসনভার গ্রহণ করেছিল। নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সরকার প্রাথমিক অসুবিধা ও সঙ্কটগুলো কাটিয়ে উঠেছিলেন। দেশের প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তদানুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ প্রমাণ করে যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রাথমিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে একটি সুনিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবার সামর্থ অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়ের মধ্যে রয়েছে-
১. মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন-মুক্তিবাহিনীর জওয়ানদের কাজে লাগানোর জন্যে বঙ্গবন্ধু ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী, মিলিশিয়া, রিজার্ভ বাহিনী সংগঠনের বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এছাড়া দেশ গড়ার বিভিন্ন কাজে যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ প্রদান করেন।
২. ত্রাণ কার্যক্রম: রিলিফ ও পুনর্বাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে মঞ্জুরী দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
৩. মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ : মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র নিজেদের কাছে না রেখে তা ১৯৭২-এর ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সমর্পণের আহ্বান জানান। এতে সকল মুক্তিযোদ্ধা সাড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেন।
৪. স্বাধীন বাংলার প্রশাসনিক পদক্ষেপ : ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর একটা প্রশাসনিক শূন্যতা বিরাজ করছিল রাজধানীতে এবং দেশের সর্বত্র। নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তনের পর প্রশাসনকে কর্ম-উপযোগী করে তোলেন।
৫. ভারতীয় বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন- ১২ মার্চ ১৯৭২ ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে।
৬. ১৯৭২ সালের সংবিধানঃ তিরিশ লক্ষ শহীদ ও দু’লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তারই আদর্শ হিসেবে রচিত হলো রক্তে লেখা এক সংবিধান ৪ নবেম্বর ১৯৭২।
৭. ১৯৭৩ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন
৮. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা- বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর দারিদ্র্য পীড়িত বাংলাদেশের জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণ তথা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে জাতির জনক প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এই পরিকল্পনার লক্ষ্যসমূহ ছিল
ক. মূল লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য দূরীকরণ। এজন্য যারা কর্মহীন বা আংশিক কর্মহীন তাদের সবার কর্মসংস্থানের আয়োজন করা। তাছাড়া জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং সেইসঙ্গে এই আয়ের বণ্টনের জন্য যথাযথ আর্থিক ও মুদ্রানীতি প্রণয়ন ত্বরান্বিত হওয়া প্রয়োজন।
খ. জনগণের অত্যাবশ্যক পণ্যের চাহিদা যাতে মেটে সেজন্য, প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, ভোজ্যতেল, কেরোসিন ও চিনি।
গ. কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত কাঠামোতে এমনভাবে রূপান্তর সাধন প্রয়োজন যাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়, কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে এবং শ্রমশক্তির শহরমুখী অভিবাসন বন্ধ হয়।
৯. বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরী মনোভাব নয়’।
প্রথম তিন মাসের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ৬৩টি দেশের স্বীকৃতি লাভ। ৩ মাস ২১ দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ২ বছর ২ মাসের মধ্যে। সর্বমোট ১২১টি দেশ স্বীকৃতি প্রদান করে।
১০. ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ : ইসলামের যথার্থ শিক্ষা ও মর্মবাণী সঠিকভাবে ব্যাপক জনগোষ্ঠির মাঝে প্রচার- প্রসারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামি আদর্শের যথাযথ প্রকাশ তথা ইসলামের উদার মানবতাবাদী চেতনা বিকাশের লক্ষ্যে একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা ছিল জাতির জনকের সুদূর প্রসারি চিন্তার এক অমিত সম্ভাবনাময় ফসল।
১১. যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঃ বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার’ জারি করে। এতে দালাল, যোগসাজশকারী কিংবা কোলাবরেটরদের সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে-
ক. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে বস্তুগত সহযোগিতা প্রদান বা কোন কথা, চুক্তি ও কার্যাবলীর মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করা।
খ. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা যুদ্ধের চেষ্টা করা।
গ. মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার বিরুদ্ধে এবং মুক্তিকামী জনগণের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
ঘ. পাকিস্তানী বাহিনীর অনুকূলে কোন বিবৃতি প্রদান বা প্রচারে অংশ নেয়া এবং পাকবাহিনীর কোন প্রতিনিধি দল বা কমিটির সদস্য হওয়া। হানাদারদের আয়োজনে উপনির্বাচনে অংশ নেয়া।
পরবর্তীকালে একই বছরে এই আইন দু’দফা সংশোধন করা হয়। এই সংশোধনীতেও চার ধরনের অপরাধীকে ক্ষমা করা হয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে নেই তাদের ক্ষমা করা হয়। কিন্তু যারা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যা- এই চারটি অপরাধ করেছে তাদের ক্ষমা করা হয়নি। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৮১৮টি মামলার সিদ্ধান্ত হয়। এতে ১ জনের মৃত্যুদ-সহ ৭৫২ দালাল দ-িত হয়। তৎকালীন সরকার আইনগত ব্যবস্থা ত্বরিত করার জন্য ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এবং হত্যার দায়ে ১১ হাজার আটক থাকে।
সে সময় দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রকারীরা নিরাপরাধ মানুষকে রাজাকার বলে জনরোষে গণপিটুনী দিয়ে মেরে ফেলার প্রয়াস নিচ্ছিল অহরহ। এ কারণে দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করা এবং নিরাপরাধ ব্যক্তি যাতে সাজা না পায় সে কারণে বঙ্গবন্ধুর ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণার প্রয়োজন ছিল। কোনক্রমেই সাধারণ ক্ষমা মানে এই নয় যে, অপরাধীরা ক্ষমা পেয়ে যাবে। ৭৫ এর পর ২১ বছরে পরবর্তী সরকারসমূহ অত্যন্ত সুকৌশলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যায়নি।
উপরন্তু বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালের ১৯ জুলাই ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট’ জারি করেন যা পরবর্তীতে আইন হিসেবে সংবিধানে সংযোজিত হয় এবং অদ্যাবধি তা বহাল রয়েছে।
১৯৭২ সালের ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের ৪ নবেম্বর সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সংবিধানের ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ীদের ভোটাধিকার ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল করা হয়েছিল।
এসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের পরও স্বাধীনতা বিরোধীচক্র ও তাদের দোসররা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
১২. ১৯৭২ সালে সউদী আরবে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে ৬ সহস্রাধিক বাংলাদেশী মুসলমানকে হজ পালনে প্রেরণ।
১৩. বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি- ১৯৭২ সনের ১৯ মার্চ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত হয় ‘পঁচিশ বছর মেয়াদী’ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তি।
১৪. কুদরাত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন।
১৫. যমুনা সেতু ঃ ১৯৭৩ সালের ১৮-২৪ অক্টোবর জাপান সফরকালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকার সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে যমুনা বহুমূখী সেতু নির্মাণের সূচনা করেন।
১৬. জাতিসংঘের অধিকাংশ সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সদস্যপদ গ্রহণ।
১৭. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুনর্গঠন ঃ স্বাধীনতা অর্জনের পরপরেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটি আধুনিক সুসজ্জ্বিত বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
১৮. ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের ১৩৬তম সদস্যপদ লাভ ও ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ প্রদান।
১৯. বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৪-২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ছাড়াও বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও শিল্পীগণ উপস্থিত ছিলেন।
২০. ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, পাঁচ হাজার টাকার উপরে কৃষি ঋণ মওকুফকরণ এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে এনে সামাজিক অর্থে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জমি মালিকানার সিলিং পুনর্নির্ধারণ ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
২১. স্বাস্থ্য ব্যবস্থা : বঙ্গবন্ধু সরকার নগরভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ৫শ’ ডাক্তারকে গ্রামে নিয়োগ করেন। আইজিএমআর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শাহবাগ হোটেলে স্থানান্তর হয়েছে।
২২. বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী : ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় আশা আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশকে শিল্প সংস্কৃতি বদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠন এবং বাঙালীর হাজার বছরের কৃষ্টি- সংস্কৃতি- ঐতিহ্য ধরে রেখে আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশী শিল্পকলা একাডেমী গঠন করেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতি বিকাশের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান।
তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প গ্রহণ বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আজও স্বীকৃত।
২৩. দেশের শিল্পকাঠামো পুনর্গঠনে হাজার হাজার পরিত্যক্ত শিল্প কারখানাকে বেহাত হয়ে যাওয়া অবস্থা থেকে সংরক্ষিত করতে প্রণয়ন করতে হয়েছে জাতীয়করণ নীতি।
২৪. শূন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে শুরু করতে হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য।
বাংলাদেশ বিপ্লবের সাফল্যের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের উত্থান ঘটে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তিনি পরিণত হলেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বের ছাপ রাখতে সমর্থ হন। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ এবং বিশ্ব শান্তির প্রতি ছিল তাঁর দৃঢ় সমর্থণ। এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭২ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে প্রদান করে ‘জুলিওকুরি’ শান্তিপদক।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যত তমিস্রায় ছেয়ে যাবে’। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুতদারি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘এদের শায়েস্তা করে জাতীয় জীবনকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে আওয়ামী লীগের দুই যুগের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের গৌরবও ম্লান হয়ে যেতে পারে’।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির সকল স্বপ্ন/ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে ফেলেছিল। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও বাবার আদর্শকে আকঁড়ে ধরে রেখে আবার বাঙালী জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
দেশবাসী আশা করে, জাতির জনকের আদর্শ অনুসরণ করে সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক সামাজিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলবে যেখানে দেশবাসী নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ে তোলায় উদ্বুদ্ধ হবে। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবন আমাদের রাজনীতির বড় পাথেয়।
সেখানে বঙ্গবন্ধু আমাদের সকল প্রেরণার উৎস।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের স্বপ্ন ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমাদের দেশের সকল রাজনীতিবিদ সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবেন এটি জনগণের প্রত্যাশা।
জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর একই ধারায় জীবনের সকল ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন। বাস্তবিক অর্থে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। দেশের সকল প্রগতিশীল শক্তি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সুখী সমৃদ্ধি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন এটিই হোক এবারের জাতীয় শোক দিবসে আমাদের প্রত্যাশা।