ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

বাঙালীর ভাষা সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক প্রভাব

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাঙালীর ভাষা সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক প্রভাব

‘আমি বাঙালী, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়া তাই নিয়ে বাংলা জাতীয়তাবাদ।’ ভাষা এবং জাতি বিচারে আমরা প্রকৃতই খাঁটি বাঙালী বলে বিশ্ব দরবারে পরিচিত। বাংলা ভাষা আমাদের জাতিসত্তার প্রতীকÑ বাংলার মানুষ এই ভাষার মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সামাজিক ঐতিহ্যকে লালন করে। কিন্তু ভাষার প্রসার, বিকাশ সাধনে কিংবা উন্নয়নে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক প্রভাবে যুক্ত হয়েছে। কেননা বাঙালীভাষী উচ্ছ্বসিত জাতিতে হিসেবে যে আবেগ প্রকাশ করে তা মনে-প্রাণে অর্থাৎ সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করতে পারেনি। অথচ এই প্রক্রিয়া স্বাধীনতার পূর্বাপর, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় পূর্ব পর্যন্ত বেশ জোরদার ছিল। যা এই শতকেও চূড়ান্ত হয়নি- হচ্ছে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ভাষার বিশ্ব স্বীকৃতি পেলেও তার যথাযথ প্রয়োগ-ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট কিংবা স্পষ্টতর, কার্যকর সিদ্ধান্ত প্রণীত হচ্ছে না। আমরা জানি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘রাষ্ট্র...জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।’ কিন্তু চরম বাস্তবতা হচ্ছে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাভাষা শতভাগ চালু নেই। আমরা ভাষার ভেতর ভাষার মধ্যে বিরোধ তৈরি করি। বিভিন্ন অর্থে ভাষার বৈরিতা লুকিয়ে এক ঐক্যের অর্থ সঙ্কটের মধ্যে স্থাপন করছি। আর এ কারণে রাজনৈতিক এবং কিছু ধর্মজ ভাষা ব্যবহারে ভুল প্রয়োগে ভাষার ভুল বোঝাবুঝি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে- সাধারণ বাংলা শব্দ এক শ্রেণী থেকে অন্য শ্রেণীতে বিরোধী অর্থের যোগান দিচ্ছে। এটা অবশ্য ভাষাতাত্ত্বিক জটিলতা-ভাষাতাত্ত্বিক দুর্বলতা আর বিপরীত অনৈক্য-অনিরপেক্ষতা প্রকাশ করে। একশ্রেণীর দালাল এবং অসাধু চক্র আমাদের বাস্তবতা মেনে নিতে পারছিল না। এরই প্রেক্ষিত বলা যেতে পারে দেশ বিভাগের মধ্যেই আর ধর্মীয় হানাহানির বীজ থেকেই এই ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। আমরা পালাইনিÑপালাব কোথায়? জানি এই সঙ্কট আর ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে দরকার পারস্পরিক সহনশীলতা- এক অপরকে বোঝা যা স্বাধীনতার চরম পর্যায়ে ভারতকে দেখেছি। কিস্তু ভাষা-আন্দোলনে এমন বন্ধু কাছে পাইনি! আমরা বিদ্বেষ নামক বিষকে খতম করে এখন বিশ্বাসের সর্বব্যাপ্ত বাতাবরণ তৈরি করেছি। সর্বস্তরে সমন্বয়ী চিন্তাধারার নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলনের মাধ্যমে বাঙালী জাতিতে বিশ্ব প্রগতির পাথেয় রচনা করতে হবে। আমি মনে করি মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িকতার আর ভাষাপ্রবণ মানসিকতায় সাহসী জবাব দিতে হবে। কোন ছাইচাপা আগুন আর কোন অজুহাতে উস্কে দিতে চাইলে তা সর্বোচ্চ মূল্যে ঠেকাতে হবে। ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা এবং বিদ্বেষ আমাদের নিরাপদ রাখতে পারে না। একুশ বাঙালীর শক্তি-ভাষার আগুন। সংগ্রাম, ত্যাগ এবং আত্মবিসর্জনের বিনিময়ে আমাদের মাতৃভাষা। এর ইতিহাস বাঙালী জাতির আত্মপরিচয় ও গৌরবের সোনালি ইতিহাস। সেই মূল্যবান গৌরবগাথা সোনালি অধ্যায়ের কোন অসম্মান এই বীরের জাতি কী করে সহ্য করবে! কীভাবে এর অপব্যবহার মেনে নিজেকে ছোট করবে? প্রকৃত বাঙালী-বাংলাদেশী এটা মেনে নিতে পারে না। তাই বলা যায় সংস্কৃতি যেমন জাতির পরিচয় তেমনি এর রাজনৈতিক প্রভাব যদি নেতিবাচক হয় তাহলে এর চেয়ে আর কষ্টের-দুঃখের কিছু নেই। যখন আমরা শুধুমাত্র রাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীল তখন রাষ্ট্র হয়ে ওঠে অসহায়- যে রাষ্ট্রের একমাত্র শক্তি জনগণ। এ জন্য ফরাসী ভাষাবিদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিশেল ফুঁকো বলেছিলেনÑ ‘সত্যিকার ক্ষমতা রাষ্ট্রযন্ত্রতেই আবদ্ধ থাকে না। ক্ষমতার অনেক কুশলতা আছে, আরও প্রক্রিয়া- কিন্তু এসব রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিদ্ধ না করলেও এড়িয়ে চলার প্রেক্ষিত থাকে না। ক্ষমতার নিচে, বাইরে ও সংলিপ্ত ক্ষমতার কার্যবিধি সূক্ষ্ম, ক্ষুদ্র ও প্রাত্যহিক স্তরে কাজ করে। যা কিছু স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত, এমনকি স্বতঃসিদ্ধ উপপাদ্য বলে হচ্ছে- সবটাই রাজনৈতিক ও নির্মিত। ক্ষমতা ও ক্ষমতা-ভাষ্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান সেখানে দৃঢ় মূল করতে শক্তি যুগিয়েছে। স্থিতি অবস্থা অটল রাখে ক্ষমতার কলকাঠি। রাজনীতি বোধটা এখান থেকেই উঠে এসেছে।’ দীর্ঘ তেইশ বছর সংগ্রাম ও যুদ্ধ শেষে বাঙালী যেমন একটি নতুন রাষ্ট্র পেয়েছিল তেমনি ‘বাঙালী’ নামক একটি জাতিসত্তার নিজস্ব স্বাধীন ভূ-খ-ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাষাবিপ্লব ঘটে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। প্রতিষ্ঠিত হয় এদেশের প্রাণের ভাষা মায়ের ভাষা বাংলা। আমরা বীর ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে আমরা কখনও আপোসকামী নই। সত্যিকার অর্থে বাঙালীর জীবনচর্চা, তার ভাষা ও সংস্কৃতিতে পবিত্র জ্ঞান লালন করেন। সেই ভাষা ও সংস্কৃতি যখন আক্রান্ত, বিভ্রান্ত, লাঞ্ছিত তার বিরুদ্ধে অমোঘ ব্যবস্থা গ্রহণেই স্বাভাবিক বিষয়- এটাই বাঙালীচেতনা। তবেই দেশবাসী আত্মনির্ভরশীল হবেন। বিদেশী ষড়যন্ত্র ঠেকাতে- জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার শক্তিই আমাদের ভরসা। জাতীয়তাবাদ চেতনা উদ্বুদ্ধতার মূলমন্ত্র বাঙালিপনা যার শক্তি আমরা ইতিহাসের সাক্ষ্য ভাষা আন্দোলনের দীক্ষা। বিশ^ব্যাপী আমরা স্মরণীয়-এবং আদর্শ। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভাষার শিক্ষা সর্বাঙ্গে অনুসরণ করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করি আমাদের ভাষার ঐতিহ্য-ব্যবহার এবং প্রয়োগ সাহেবী বাবুর চেয়ে গ্রামাঞ্চলে অনেক বেশি। তা হলে শিক্ষা আমাদের মূল ঐতিহ্যকে লালন করতে পারছে না বলে ধরে নিতে হবে। যখন বিশ^মানবের কাছে আমরা গৌরবের জাতি হিসেবে চিহ্নিত- সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত, জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষাতে যুক্ত হচ্ছে ঠিক সে সময় আমরা সরকারী-বেসরকারীভাবে অবহেলিত-বিদেশী ভাষার আগ্রাসনে। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন- বাঙালীরা মৃত্যুঞ্জয়। বারে বারে বিভিন্ন অঙ্গে তারা ফিরে আসেন এই বাংলায়- কখনও কবিতায়, কখনও গানে-গল্পে, ছড়া, উপন্যাসে, প্রবন্ধেই শুধু নয়, বাংলার শিক্ষা-দীক্ষাসহ প্রাত্যহিক জীবনে। বাংলার মাটি, বাংলার জলকে পুষ্ট করেছেন তিনি। আলোর সাধনই করেছেন আর বোধের-মননের ভাষাকে করেছেন সমৃদ্ধ- সবার মুখের ভাষা হয়ে বিশ্ব আকাশে মুক্ত মেঘের আলাপন করেন। বাঙালীর যে লালিত্য ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তাকে লালন করেছেন নিজের জীবনে যেমন তেমনি প্রসারিত করেছেন বিশ্বমানবের কাছে। বাঙালীর ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শেষ জীবন পর্যন্ত লড়াই করেছেন- সংগ্রাম করেছেন। বাংলাভাষা ভাষার এই লড়াই এই সংগ্রাম আমাদের সবুজ ছাত্ররাই শুরু করেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে আবারও নতুন প্রজন্ম-তরুণ প্রজন্ম যাদের কাছে জাতির স্বপ্ন তুলে দেয়া আছে- তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বরাবরই ছাত্ররাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশ-জাতি এই ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে মূল ভিত্তিটা আশা করে। আর সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এসে সর্বস্তরে বাংলা প্রবর্তন করবেন। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার প্রশ্নে প্রাণপণ অটুট থাকতে হবে। রাজনীতির সংঘাতময় পরিস্থিতি আমাদের হাজার বছরের অর্জন- গৌরব অনেক সময় বাধাগ্রস্ত করে। এই স্থূলহীন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাঙ্গন যেমন সংস্কৃতির প্রথম পাঠ অন্তত সেখানে ভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোন মূল্যে বৈরিতা ছাড়িয়ে উঠতে হবে এই জাতিকে। আমাদের বিশ্বনন্দিত জাতিতে পরিচিত হতেই হবে- তবেই আমাদের মুকুট মর্যাদাপ্রাপ্ত হবে। অনেকেই আমাদের মিত্রদেশী ভাষীর নির্মম অত্যাচার-জুলুম আমাদের ভাষার ওপর। আমরা কখনই তা ভুলে যেতে পারব না। মনে পরে আমরা ইতিহাসের এক চরম দুঃসময়ের মধ্যে পথ পাড়ি দিয়েছি- পথে হাঁটছি। অযথাই ভাঙছি ভাষা-ভাঙছি দেশ-ভাঙছি মসজিদ-মন্দির, কেউ গির্জা, কেইবা বৌদ্ধ উপাসনালয়, আসলে আমরা ভাঙছি মনুষ্যত্ব আর সভ্যতার শেষ্ঠ সময়। এই ভাঙ্গা-গড়ার ভেতর অতিক্রম করছি ডিজিটাল প্রবাহ-ডিজিটাল বিশ্ব। স্বাধীনতা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি- এর সুফল নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক অর্জন আমাদের সে কথাও বলি। আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই। এক মহানায়কের নেতৃত্ব আর আহ্বানে আজকে যে বিরাট অর্জন সন্তুষ্টির উচ্চতর অধ্যায় তা কখনই ভুলব না। ঠিক সেভাবে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মেলবন্ধনে এই জাগরণ সম্ভব- এখানে রাজনীতির একক প্রয়োজনের কাছে কোনভাবেই শুধু আত্মসমর্পণ করলে চলবে না, তার জন্য চাই, রাজনীতি ও সংস্কৃতির এমন মেলবন্ধন, যা আমাদের সামাজিক বিপ্লবের দিকে প্ররোচিত করবে বলে মনে করি। বাংলা ভাষা একটি পৃথিবীর উজ্জ্বল আলো এই আলোর উদ্ভাসিত হয়ে বিশ্বমানব আলোকিত হবে।
×