আনজীর লিটনের ছড়া
সিঁড়িছড়া
আয়রে আয় টি-য়ে
ভাজছি রুটি ঘি-য়ে
ঘি-তে শুনি ভে-জাল
তরকারিতে দে-ঝাল
ঝাল খেয়ে পেট ব্য-থা
গায় চাপালাম খ্যা-তা
খ্যাতা আমার ছেঁ-ড়া
হঠাৎ দেখি ভে-ড়া
ও ভেড়া তোর বা-ড়ি কই?
রান্না করার হাঁ-ড়ি কই?
বাড়ি আমার না-ই-কা
এবার আমি যা-ই-গা।
লক্ষিন্দর-বেহুলা
নাচে মন ধিনা ধিনা
প্রাণেতে বাজে বীণা
লক্ষিন্দর বেহুলাকে
চিনিল, ঠিক কিনা?
ঠিক ঠিক ঠিক
লোকগাথার দৃশ্য তখন
ঝিক মিক ঝিক
ঠিক ঠিক ঠিক।
কাজলরেখা
লোকগাথার কাজলরেখা
তাহার সনে হইল দেখা
রাজবাড়িটার বাগান-ঘাসে
কাজলরেখা তাথৈ হাসে
হাসতে-হাসতে কাজলরেখা
ধরলো মধুর বাউল পালা
রাজকুমারের গায়ে তখন লক্ষ সূচের বিষের জ্বালা
কাজল বলে, হৃদয় দিলাম, ব্যথা রে তুই পালা-পালা।
ছেলে-মেয়ে
ছেলেরাও গান করে মেয়েরাও গান করে
ছেলে-মেয়ে সব্বাই রাগ-অভিমান করে।
ছেলেরাও স্কুলে যায় মেয়েরাও স্কুলে যায়
ছেলে-মেয়ে মাঝে মাঝে পড়াটড়া ভুলে যায়।
ছেলে-মেয়ে ছুঁয়ে দেয় পাহাড়ের কোলটা
ভালো লাগে ওদেরও বাউলের ঢোলটা।
ছেলেরাও যাই করে মেয়েরাও তাই করে
এক ঘরে কত কাজ, বোন করে ভাই করে।
অভিনয় করে ওরা, আঁকে ওরা কত ছবি
খেলা করে নাচ করে লিখে লিখে হয় কবি।
ছেলে-মেয়ে সব্বাই সমানে সমান তাই
ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ নাই নাই নাই নাই।
৫. ফাইল
পুরো ছ’টি মাইলÑ
অফিসে যান প্রাইভেটকারে
হাঁটতে পান না দেহের ভারে
গিন্নির শাড়ি ছেলের মায়না
গয়না-গাটির দেন যে বায়না
থিয়েটার ও ছবি দেখা
ছোট্ট মেয়ের নাচটি শেখা
মাসে-মাসে ভ্রমণ করা
গল্প-নাটক-নোভেল পড়া
ভালোয়-ভালোয় সবই সাড়া
কিন্তু চাইলে বাড়ি ভাড়া
বলেন তিনি সবুর করুন
দিন পাঁচেক পর দেব ধরুন
আটকিয়েছি ফাইল।
বাড়ি থেকে অফিস যে তার
পাক্কা ছ’টি মাইল।
৬. টক-শো
কথায় কথায় চিড়া ভিজা
চলছে দেখ টক-শো
রাত্রি এলে টিভি জুড়ে
চলছে কত মকশো।
বলছে কথা মু-ু-মাথা
ফলছে কচু গাছ যে
ডাঙ্গায় উঠে চক্ষু নাচায়
নদীর যত মাছ যে।
উঠছে কেঁপে শরীর-মাথা
উঠছে কেঁপে ভুঁড়ি যে
কথাগুলো ধারালো খুব
দলবাজিদের ছুরি যে!
৭. মানুষ
মানুষ বাঁচে বুদ্ধি নিয়ে
মানুষ বাঁচে কর্ম দিয়ে
মানুষেরা ভাবতে জানে
তাই তো বাঁচে শক্তি নিয়ে
সকল জীবের সেরা সে জীব
মানুষ বাঁচে ভক্তি নিয়ে।
মানুষ বাঁচে আশা নিয়ে
জন্মভূমির ভাষা নিয়ে
মানুুষই তো স্বপ্ন দেখে
মানুষ বাঁচে লক্ষ্য নিয়ে
মানুষই তো দেশটা গড়ে
ইতিবাচক পক্ষ নিয়ে।
** ফাইল
পুরো ছ’টি মাইলÑ
অফিসে যান প্রাইভেটকারে
হাঁটতে পান না দেহের ভারে
গিন্নির শাড়ি ছেলের মায়না
গয়না-গাটির দেন যে বায়না
থিয়েটার ও ছবি দেখা
ছোট্ট মেয়ের নাচটি শেখা
মাসে-মাসে ভ্রমণ করা
গল্প-নাটক-নোভেল পড়া
ভালোয়-ভালোয় সবই সাড়া
কিন্তু চাইলে বাড়ি ভাড়া
বলেন তিনি সবুর করুন
দিন পাঁচেক পর দেব ধরুন
আটকিয়েছি ফাইল।
বাড়ি থেকে অফিস যে তার
পাক্কা ছ’টি মাইল।
টক-শো
কথায় কথায় চিড়া ভিজা
চলছে দেখ টক-শো
রাত্রি এলে টিভি জুড়ে
চলছে কত মকশো।
বলছে কথা মু-ু-মাথা
ফলছে কচু গাছ যে
ডাঙ্গায় উঠে চক্ষু নাচায়
নদীর যত মাছ যে।
উঠছে কেঁপে শরীর-মাথা
উঠছে কেঁপে ভুঁড়ি যে
কথাগুলো ধারালো খুব
দলবাজিদের ছুরি যে!
মানুষ
মানুষ বাঁচে বুদ্ধি নিয়ে
মানুষ বাঁচে কর্ম দিয়ে
মানুষেরা ভাবতে জানে
তাই তো বাঁচে শক্তি নিয়ে
সকল জীবের সেরা সে জীব
মানুষ বাঁচে ভক্তি নিয়ে।
মানুষ বাঁচে আশা নিয়ে
জন্মভূমির ভাষা নিয়ে
মানুুষই তো স্বপ্ন দেখে
মানুষ বাঁচে লক্ষ্য নিয়ে
মানুষই তো দেশটা গড়ে
ইতিবাচক পক্ষ নিয়ে।
** জ্ঞান বৃক্ষ
মাকিদ হায়দার
আসবে না জেনেও জানিয়ে রাখি পাবার আশা।
আকাশ কুসুম।
আমি না থাকার পরেও যদি কেউ খুঁজতে আসে
সেই ভয়ে এখুনি ঘুমিয়ে যাই
যত্রতত্র পথে ঘাটে।
বেশ কিছুদিন ফেরারী ছিলাম, দুর শালবনে,
অচিরেই যেতে হবে, যে কোন গুহায়
কোনদিন যদি তার চোখে পড়ি
বাঁধবেন তিনি তার
চোখের আঁচলে।
আমি ভীতুদের একজন
তব্ মাঝে, মাঝে শলা করি
বুদ্ধিমান বৃক্ষের সাথে
কখনো কি কোনদিন পারবো যেতে, হারানো
সেই আবাসীর কাছে, আবাসীর ঘরে আছে
নাকি ডোরাকাটা বাঘ।
শেষমেশ রয়ে সয়ে বলি
আমার বাড়ির পাশে ছিল একখানা নদী
শিখিনি সাঁতার
যদি জানতাম,
হয়তো সাঁতরে গিয়ে তাকে আসতাম দেখে।
কেঁদে কেঁদে জানালো আমাকে
বৃক্ষ গৃহিণী।
কি হবে তোমার তার কাছে গিয়ে আসবে না যিনি
ঘরে যার আছে ডোরাকাটা বাঘ।
** মিথ্যার মুকুট
মহাদেব সাহা
মনে হচ্ছে, নিজেই নিজেকে আমি সত্যি কথা বলিনি একটিও
একটিও জন্মদোষ, মিথ্যা অসন্তোষ, অভিমান,
ঘাসের ঘোমটা পরে স্তোকবাক্যে ঢেঁকেটি আহত মুখ
শুধু শব্দ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছি শব্দহীন নিবিড় জঙ্গল
দেখছি বোবলি এই অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে হাঁটা;
এই জন্ম ও জীবন, শরীর থেকে উঠে আসে আরো শরীর বৃত্তান্ত এক শব্দ
আরো ঘুম, আরো ঘুঙুর, রাত্রীর অধিক রাত্রী
সব মিশে যায় ঘন ঘাসে দৃষ্টির আড়ালে,
জেগে ওঠে শরবিদ্ধ তমসা তিমির কোন অন্ধ ভবিষ্যৎ
সমস্ত বাক্যই আজ মনে হয় স্তম্ভিত স্তব্ধতা;
শব্দ দিয়ে যা লিখেছি সব মিথ্যা, মায়া ও মুখোশ
কোথা সেই সত্যটুকু পাই, সেই অবিচল সত্যের শ্বাস,
পঙ্কতির ভিতরে শুধু পঙ্কতিবদ্ধ মিথ্যা রয়েছে লুকিয়ে
চেয়ে দেখি মাথায় পরেছি আমি শুধু এই মিথ্যার মুকুট।
** মাটির নৈকট্যে যাবো
নাসির আহমেদ
এই বিল এই ধুধু শূন্যতার ওই জলরাশি
নদী হয়ে যেতে পারে নদীর বিভ্রমে
নদী নয়, পলিময় বিলই বটে, শহর ছাড়িয়ে
এইখানে এসে দেখি শাদা মেঘ মাটি ছুঁয়ে আছে।
আসলে কি মেঘ, নাকি মেঘের মতন শাদা কিছু
বিলের ওপারে শুভ্র একঝাঁক বক যাচ্ছে উড়ে
তুমি বলবে দূরে বলে হয়তো দেখার হচ্ছে ভুল।
বিল যদি নদী হয়, মেঘ যদি শাদাবক দূরে
তা হলে ওই যে শীর্ণ পত্র পুষ্পহীন মরা গাছ
তাতে যদি দেখি রাশি রাশি ফোটা ফুল
দোষ কি এমন ইতিবাচক দৃষ্টির দৃশ্যপটে।
আসলে কবির কাজ স্বপ্ন নিয়ে বহু দূরে যাওয়া
বিপরীতে স্রোতে আত্মহননের হাওয়া
যতই যাক না বয়ে মৃত্যুভয় ছড়াতে ছড়াতে
আমি যাবো নদী হয়ে খরাদীর্ণ মাঠকে ভরাতে
নরম পলির স্বপ্নে মৃত্যু অতিক্রম করে শস্যবীজ বুনে
ফসল ফলিয়ে যাবো মাটির নৈকট্যে।
**
বেলাল চৌধুরী
দাউদ হায়দার
আমাদের এই ধূমল উপত্যকায়
যে-কজন এখনো উজ্জ্বল,
যুক্তিজাগরে, বা, নানা অভিধায়
সমকালতটে পুরোহিত দল
মধ্যমণি বেলাল চৌধুরী?
কবে থেকে আমার ব্রাহ্মণ, গুরু
হিসেব রাখিনি? বয়স হয়তো কুড়ি
বোহেমিয়ান জীবন, জীবনের পাঠ শুরু,
মুক্তিরঙে মেতে উঠি? সবকিছু মুলতবি রেখে
একদা আশ্রিত ভিনদেশে?
দিন যায় পথেপ্রান্তরে, নিদাঘবেলার এলিজি, সে কে
আমার অসুখে ভীষণ উষ্ণতা রাখে মননের চিদদেশে !
বেলাল চৌধুরী আজ গৃহান্তরে,
এই দুঃসংবাদ যদি সত্যি হয়
আমার অম্বরে
সঘন আঁধার, ভুলে যাচ্ছি বৃষ্টিধারার প্রণয়
** এলিজি ২০১৬
আসাদ মান্নান
মানুষ নিয়ত মরেÑ এই চিরন্তন সত্যটাকে
মেনে নিয়ে একদিন স্বজনের বুক খালি করে
জগৎ সংসার ছেড়ে যেতে হয় মৃত্যুর গুহায় :
প্রত্যেক জীবের জন্মে মৃত্যু তার নিজস্ব অক্ষরে
অবিরাম লেখে তার অনিবার্য নীল পরোয়ানা;
বিশ্বস্ত নফর এক সারাক্ষণ পায়ে পায়ে হাঁটেÑ
যখন নদীর জল উড়ে গিয়ে মেঘে শুয়ে থাকে
তখন মৃত্যুর থাবা কোনও শক্তি সরাতে পারে না।
অথচ তোমার মৃত্যু হে আমার অচেনা আপন!
পাতকিনী গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া দানবের হাতে
কিছুতেই যায় না মানা; তুমি নও আজ শুধু এক
মাতৃহারা দু’ এতিম শিশুর জননী কিংবা অই
ভীষণ সাহসী যুবা দেশপ্রেমী বাবুলের বউÑ
তোমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে শহীদের খুন।
পাখিরা পাখিরা পাখিরা (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী-ছাত্রীদের উদ্দেশে)
শেখ আতাউর রহমান
সলিম আলী, তোমাকে এশবারÑ
কেবল একটিবার দু’চোখ ভরে দেখতেই
দিল্লীতে পৌঁছুলাম যেই, শুনি তুমি আর নেই !
Ñ এ বেদনা আজো ধিকিধিকি জ্বলে আমার বুকের মধ্যেই!
বল বন্ধু বল, সুদূর বাংলা থেকে কেন এশটিবারÑ কেবল একটিবার
তোমাকে দেখতে যাওয়া?
তুমি যে আমার বিপুল বিস্ময়, আমার সফল স্বপ্নপুরুষ, তাই প্রাণভরে একবার
তোমাকে দেখতে চাওয়া। হায়! অবশেষে সত্যই হলো নাÑ পাওয়া!
আমিও যে আরেক সলিম আলীÑ
সহস্র পাখিদের ভিড়ে আমারো তো আজীবন আমরণ বসবাস
বহুদিন বহু বহু মাস।
যদিও আমার হাতে সলিম আলীর বায়নোকুলার নেই,
তবুও আমার পাখিবন্ধুরা বিশ্বাস করে এই ঃ আমার বুঝি ত্রিনয়ন আছে
তাই অমোঘ নিয়তির মতো ভিড় করে ওরা আসে, কখনোবা নিরিবিলি বসে পাশে
এবং আরো সঙ্গোপনে নিবিড় ঘনিষ্ঠ হয় আমার হৃদয়ের খুব কাছে।
ওদের দুঃখ-ব্যথা যত, প্রেম আর ক্ষত, সুখ, অ-সুখ আর নতুন বইপড়ার আনন্দকথা
Ñ সব অবিরল বলে যায় আমাকেÑ
বুঝি না কেন আমার প্রতি ওদের এত বিশ্বাস, কেন এত অবিশ্বাস্য মুগ্ধতা !
সতীর্থ শহিদুল, লিলিনাথ আর দাউদি’র আত্মহননের গল্প
বলে যায় ওরা মাথা রেখে আমার টেবিলে অবিরল চোখের জলে এই আরাধ্য বন্ধুর কাছে।
সুবন্ধুপাখিরাগো ভুলিনিতো সেইসব দুখিস্মৃতি, আমার যেসবÑ সব মনে আছে।
তাইতো আমিও সলিম আলীÑ
আজীবন কেটে গেল এইসব শ্যামল সতেজ
পাখিদের কোলাহলে থৈ থৈ অতল জলেই
হয়তো সলিম আলী ভেবে নিয়েছে ওরা আমাকেই।
হায়! কি বিচিত্র জীবন আমার!Ñ
লাল নীল সবুজ আর সফেদসাদাÑ
কতো পাখি কতো গান অন্তহীন হাজার হাজার
এমনও তো হয়েছে কখনোÑ কোনো এক মধ্যরাতে মুঠোফোনে
ফোঁপানো কান্না ভেসে আসে, কেন স্যার ‘আনাকারেনিনা’ পড়তে
বলেছিলেন, কেন কেন কেন?Ñকি উত্তর দেবো?
‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে !’
Ñতাই বলি ওকে,
বেশ মেয়ে বেশ, আমিই দায়ী, তুমি তাই-ই ভেবো।
সুপ্রিয় বন্ধুপাখিরা আমার, এবার আমার কনফেশন শোনো, আমার ভূম-লে
তোমরাই সতেজ অক্সিজেনÑ
প্রাণভরে নিয়েছি টেনে এই অমল বিমল অফুরন্ত হাওয়া
আমার পিপাসার্ত বুকে
মরিনি তাই ধুঁকেধুঁকেÑ বেঁচে আছি আজো আনন্দ সুখে!
আরো শোনো আমার অন্তিম সুবচন
যে-বিনম্র বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি আজোÑ বেঁচেও থাকবো আমরণ ঃ
আজ থেকে বহুদিন পরে একদিন
আমার গোধূলিমুখ তোমাদের স্মৃতির আকাশ
করে দেবে ব্যথাতুর উদাসীন
আজ থেকে বহুদিন পরে একদিন!!
** মোগল-বৈভব
দুখু বাঙাল
সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে জল-ঝড় রাতে
ঝড়কে ছাপিয়ে ঠিক উঠেছিল অন্য এক ঝড়
জানি না কীসের ছলে নেভালে হাতের আলো
অতঃপর হাত রাখলে সোনার কঞ্চিতে।
খরতাপে দগ্ধ এক মিসেস চৌধুরী
ছেলে মানুষের সঙ্গে এ ছিল আপনার শুধু
মিনতির অশ্রুকণা-ছেলেমানুষীই।
ভরা জ্যোৎস্নার মুখে ছুড়ে দিলে অন্ধকার
যে আঁধারে ফুটে উঠল গানির বিষণœœ তারা
ফুটি ফুটি কদমের প্রথম পৌরুষ
এই বুঝি ছিল তার মোগল-বৈভব।
বহুদিন পরে ফের আত্মঘাতী ঝড়ে
মনে হলো মানুষের লক্ষ্মীছাড়া ইচ্ছেগুলো
মাঝে মধ্যে ওরকমই করে।
চাটগাঁ’র মিসেস চৌধুরী
জলে কি ডাঙায় আপনি জানি না কিছুই
আপনার ইচ্ছেটাকে দূর হতে আজ শুধু
বৌদ্ধ ভিক্ষুর মতো জোড় হাতে নমস্কার করি।
উপহার
আলমগীর রেজা চৌধুরী
আমার এইটুকু তোমাকে দেই
ফলবান লাউগাছ, আঙ্গিনার গুল্মেলতা,
জানালা ঘেঁষে উঁচু তালগাছের গোলটুপি
পুকুর জলে জলকেলিময় একটি দুপুর,
নবনীতার ফিরে না আসা ক্লান্ত বিকেল
আর আমাদের অভিমানী রাতের গল্প।
মরা নদীর মুখে কুয়াশার রেখা
আটকেপড়া ট্রলার জোয়ারের প্রতিক্ষায়Ñ
কখন ফিরে পাবে কল্লোলিত জলের যৌবন।
আমি তাও তোমাকে দেইÑ
অস্ত্র হাতে জন্ম দেয়া ভূখ- জন্মভিক্ষা উপহার...
এক জীবন, যা প্রয়োজন তোমাকে দিতে চেয়েছি।
** স্মৃতি : খ-চিত্র
সৈয়দ রফিকুল আলম
আমাদের জন্মভিটে গ্রামের বাড়িতে বছরে ছয়-সাতবার আমরা ভাই-বোনেরা মিলে আচার অনুষ্ঠানে একত্রিত হই, সেদিন মধ্য দুপুর রাতে দুগ্ধ ফেননিভ সোনার থালায় উছলে পড়া রাশ পূর্ণি চাঁদের আলোক বিভায় ¯œাত উল্লাসে উতলা হয়ে উঠি, সবাইকে ডেকে বলি উঠোনে পাটি বিছিয়ে শিশু বয়সে তৃতীয়া তিথিক্ষণে মা উঠোনে শীতল পাটি বিছিয়েÑ ভাই-বোনকে একত্রিত করে চাঁদের মহিমা কীর্তনে আবিষ্ট হতেন, মা বলতেন ঐ যে গোল চাঁদে ঝুকা বুড়ি তাঁতের মাকুতে স্বচ্ছ মিহি পাতলা মসলিনের সুতো বুনছেন তা কেন জানিসÑ তার অযুত নিযুত নক্ষত্র শিশুদের টোপরে মুড়িয়ে দেবেন বলে যাতে তারা আরো যেন দৃশ্য মুখে দীপ্যমান হয়। জ্বল জ্বল তারাগুলো জ্বলছিল তখন, হঠাৎ আকাশ আলো করে একটা উল্কাপি- মর্ত্যরে পানে ছুটে আসে। মা কিছুটা অবাক বিস্ময়ে মর্মাহত হয়ে বললোÑ এটাই প্রকৃতির অবিসংবাদিত প্রক্রিয়া, স্থায়ী কিছু নেই যেমন অমানিশি ও পূর্ণিমা একসাথে যায় না, মানুষের মধ্যেও যেসব প্রাপ্তি আছেÑ আছে অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা, দুর্ভোগ, প্রকৃতি ও জীবন অঙ্গাঙ্গী জড়ালে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়...। হঠাৎ এই চাঁদনী রাতের স্মরণাতীত স্মরণে আমার মাথার উপর দিয়ে একটি কালো বাদুড় তার ডানার কালো ছায়া ফেলে উড়ে গেলÑ মায়ের চিরসত্য কল্পনা রাজ্যের ছেদ ঘটলো। কিয়ৎক্ষণ পর আমার সেল ফোন বেজে ওঠলো। অন্যপ্রান্তে ঢাকা থেকে আমার ছেলে.... ধ্রুব কম্পিউটার বিজ্ঞানে শেষবর্ষে পড়ে, পাঁচ সাতদিন হতে একশত চার পাঁচ ডিগ্রী জ্বরে ভুগছে, সে খুব বিনীতভাবে বলল বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েছি নিদানপত্র অনুযায়ী ওষুধপত্র সেবন করছি। আমি জানি আমার ছেলের প্রতি প্রভূত আদরে কোন কুণ্ঠাবোধ করবে না তবু ভর্ৎসনার সুরে বললাম জানাওনি কেন? সপ্তাহ হতে তোমাদের ফোন বন্ধ। সে বলল আপনি বিষয়টা অনুধাবন করতে পারবেন। কিন্তু আপা.... কেঁদে কেটে উড়াল দিত। ষড়ঋতুর পাল্টাপাল্টির মতো মানুষের জীবনেও আলো-আঁধারির অজান্তিকে এক সুতোয় গাঁথা।
উষ্ণতা ও আলোছায়া
হাসান হাফিজ
বিভ্রম বলেছি ওকে, ঠারেঠোরে ইঙ্গিতে বলেছি।
ভালোবাসা ভুল করে হুলুস্থুলু বাধালো কেন যে!
নিভৃতি সে ভালোই বাসে না, ইচ্ছা করে কাছেও আসে না,
প্রকাশিত হয় দ্রুত, নিন্দা হুল বুক পেতে নেয়
বিষও পান করে ফেলে আবেগের উষ্ণতাবশত
কী করে ঠেকাই বলো এরকম অনিদ্র পতন?
নিজে নিজে নিমজ্জিত ম্লান দুরাশায়
ভেসে উঠতে চাইলেও পারছে না,
তার জন্যে শঙ্কা ক্ষোভ আহা উঁহু নাই
সেও কিন্তু বিভ্রমেরই আলোছায়া, মরীচিকা মায়া
চোরাগোপ্তা টালমাটাল আশনাইÑ
ভালোবাসা এত বেশি নির্লজ্জ কেন যে
ভালোবাসা এত অন্ধ সর্বনাশা দৈন্যে দেউলিয়া
মতিভ্রষ্ট কাঙালও কেন যে!
** অবসর
নাসরীন নঈম
মনের ভেতর একটি অসুখ
পীড়া দিচ্ছে খুব
ভাসতে ভাসতে কোথায় এলাম
পায়ের নিচে চোরাবালির স্তূপ।
শৈশবে তো একলা ছিলাম
পাশে ছিল না কেউ
মাঝে মাঝে ফুলে উঠতো
তীর ভাঙ্গা এক ঢেউ।
একটা দু’টা এমন কথা হাওয়ায় উড়ে
বুকের মধ্যে তীরের মত এসে বিঁধে
এমন মানুষ থাকতে পারে কেউ
কখনও ভাবিনি যে।
পাখির মত একলা থাকি ডালে
দিনে রাতে শুনি কেবল ঝরা পাতার গান
নদীর মত ভাঙতে লিখে গেছি
ইচ্ছেগুলো ভর দুপুরে করছে অভিমান।
কী যে করি কোথায় যে যাই
কোথায় আমার ঘর
সবাই কেমন দূরে দূরে অন্য মনে থাকে
চল্লিশ বছরের ঘরগেরস্থি সব হয়েছে পর।
** বেশধারী
গোলাম কিবরিয়া পিনু
ঢেকে রাখলেই ঘা শুকায় না
ঢেকে রাখলেই সংক্রমণ কমে না
মাছি হয়তো বা বসবে নাÑ
কিন্তু ঠিকই রোগজীবাণু বেড়ে যেতে পারে।
এত ঢাকাঢাকি কেন?
নারিকেলের বাহ্যিক অংশ ঠিক থাকলেও
ভেতরটা পচে যেতে পারে!
ঢাকনা ও আচ্ছাদন বাড়েÑ
তাপ্পি ও পট্টিকা বাড়ে
শুধু বেশধারী হয়ে উঠিÑ
লুকোছাপাÑ গুপ্ত থাকে গুপ্তস্থান
চোখে ধুলো দেওয়া কলুষ
ও ওঁচলামাটি!
ভেতরে ভেতরে স্বাস্থ্যহানিÑ
রোগবালাই ও ব্যাধিযন্ত্রণা
বৈকল্যÑ
কোঁকানো
তারপরও ডেকোরেশন!
এ্যান্টিবায়োটিক না হলে যেখানে চলে না
সেখানে ঝাড়ফুক!
দেহবিজ্ঞান না জেনে দেহচর্চা!
ঢেকে রাখলেই শুধু হবে?
** গঙ্গামুক্তি
রেজাউদ্দিন স্টালিন
স্বপ্নের দিন শেষ, কাল এলো স্মৃতিচারণের,
অতীত রোমাঞ্চকর ভবিষ্যৎ গভীর আঁধার।
প্রপিতামহের মুখ উৎসাহ যোগায় দ্রোহের,
তবু স্বপ্ন ভেঙে পড়ে মৃত্যুরাজ্যে বন্দী ইশতার।
প্রেমের প্রার্থনা পাপ, বিত্ত নেবে বেদনার ভার;
কীরণের জ্ঞান তুচ্ছ সম্পদের অসহ্য অহম।
অমরত্ব দিতে ব্যর্থ ক্রয় করা স্বপ্ননেকটার,
খরাক্লিষ্ট এই ভূমে নামবে কি বৃষ্টির রহম?
গ্রেইয়া পাহারা দেয় দিনরাত্রি মূর্খ গর্গনের,
অভিশপ্ত পাথরের পেটে আর কি উদ্ভিদ হবে?
আকাশ সুযোগ দেবে অবিরাম ক্ষীরবর্ষণের,
দৈন্যদগ্ধ এ সমাজে জন্ম নেবে অশোক নীরবে?
তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব গঙ্গামুক্তি দিলে,
গভীরথ হবে কোনো বঙ্গজন স্বপ্নের মিছিলে।
** ডেস্কটপে
জাফর ওয়াজেদ
আমার ব্যর্থতাগুলো নক্ষত্রপুঞ্জের মত লটকে আছে
তোমার ডেস্কটপে। সফটওয়্যার বদলানোর আগে,
নিজস্ব নতুন নেটওয়ার্কে প্রবেশের পর তুমি কি একবারও
ভুলেও ফাইল ওপেন করে দেখবে না! দু’একটি
নতুন-পুরানো সংলাপে ভরাবে না ফেসবুকের পাতা
হয়তো খুব বেশি শব্দের হবে না প্রয়োজন। ছন্দমাত্রা
তাল লয় ঠিক রেখে সাজানো হবে নতুন কবিতার ঘর-
গেরস্থালি দেখে দেখে হয়তো মুগ্ধ হবে জলপ্রপাত
তাকে কেউ বলবে না সফলতা বলবে না সার্থক জনম
তবু তাকে সযতœ লালন করে রেখো বীজ থেকে বৃন্তে,
বৃক্ষে ফোটে কিনা ফুল। যদি ফোটে সে তোমার সার্থকতা
আমার ব্যর্থতাগুলো ঝরে পড়ার আগে অন্তত একবার
তোমার ডেস্কটপে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে দাও যেন
ডিলিট করার আগে ব্যর্থতার কারণ খুঁজে নিতে পারি।
শব্দের বদলে দোয়েলের শবদেহ
মারুফ রায়হান
প্রকাশের অভিপ্রায়ে নয়, সত্য লুকোনো মিশনে
চালাবে নি®প্রাণ দেহে প্রহসন-ছুরি কতোবার?
বীভৎস যখন সত্য, শুক্নো রক্তমাখা,
থ্যাঁতলানো গলা পচা তাল তাল ধ্বস্ত মাংস শুধু
তখনো সত্যের শাঁসে তোমাদের নাভিশ্বাস!
পাতালে চালান করে দিতে চালাও শাবল
ছেঁদা করে দাও প্রকৃতির ফুসফুসÑ লাভ নেই
হামলে পড়ুক লোকালয়ে সমস্ত জঙ্গল ওই
তবু পারবে না বাঁচাতে মিথ্যেকে কোনোদিন
আলোর বদলে সূর্য হতে গলে পড়বে না অকিরণ
প্রতিবাদ উচ্চকিত করতে কবি নেবে শব্দের শরণ
হায় খোদা, শব্দের বদলে দোয়েলের শবদেহ
পড়ছে উপুড় হয়ে লাল-সবুজে মোড়ানো
কবিতার খাতার ওপর!
তবু জেনে রেখো এ-জমিনে
খুনীর কখনো কোনো মিত্র থাকবে না
ধর্ষকের জন্য শোক করুক কেবল মলভা-, আর
অস্ত্রের শক্তিতে অন্ধ অন্ধকার।
গলে যায় মোমের শরীর
মোশাররফ হোসেন ভূঞা
মরু পাহাড়ের মতো সমস্ত শরীরে তীব্রতর জলের তৃষ্ণা
অচিন ও অজানা কী এক উষ্ণতায় গলে যায় মোমের শরীর
জললীলায় বিষাক্ত জলকেলি, বাড়ে ক্লান্তির কোলাহল।
কোমল পাহাড়ের চূড়ায় আহ্লাদে বাদামী স্বপ্ন হাসে
অনাবিল আনন্দের মোহনায় তরঙ্গ তোলে সুখের তরল
স্বপ্নÑপাহাড়ের পাদদেশে ঘুমিয়ে পড়ে একান্ত পৃথিবী।
সুখপাখির কুজনে মুখরিত হলে মন, মরুপ্রান্তেও বসন্ত জাগে
পথ হারিয়ে দখিনের জানালায় নেচে ওঠে উদাস হাওয়া
এমন ফাগুনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিতকক্ষে প্রতিশ্রুতি হয়ে যায় খুন।
পৃথিবীর আদিম পাঠশালায় আদম হাওয়া পাঠে
বিদগ্ধ পাঠক ক্রমাগত ডুবে যায় গভীর গবেষণার অতলে
শুদ্ধতম সৃষ্টির উল্লাসে জলেরা জলেই হয় একাকার।
পকেটের অহঙ্কার : ১১
শিহাব শাহরিয়ার
জঙ্গলের সৌন্দর্য বুঝতে গিয়ে; আমি ভুলে, ঢুকে যাই জোনাকির পকেটে। আমার আর বোঝা হয় নাÑ ‘জঙ্গলতত্ত্ব’। কে যেন আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় বনভূমি থেকে পিতৃভূমিতে। এরপর আমি কোকিলের ‘চোখরং’ আবিষ্কারে নামি। আমাকে দেখে পিতৃভূমির বৃক্ষেরা ছায়াতত্ত্বের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ও নাড়ির টান, ও শেকড়ের বেদনা তোমরা; আমার মগজের ঘাসে ঢেলে দাও শৈশবের রোদ। আমি যেন ভুলে যাই, ঘুঘুর গলার রঙিন নক্সা। ভুলে যাই, যৌবনবতী জমিলার পেরোনো মধ্যরাত, ভুলে যাই নক্সী শিকা; অবশেষে মনে হয় আমার কোনো অহঙ্কার নেই, আমার কোনো পকেট নেই।
অজগরের নন্দনতত্ত্ব
শাহীন রেজা
শুয়েছিল অজগর নন্দনের বনে
চারিদিকে নাগিনীর বিমূর্ত উল্লাস
অজগর ঘুমিয়েছিল, আহা ঘুম কতো ঘুম
ঘুম ভেঙ্গে এতো বন নয় এ যে নগরÑ নগর
ডালহৌসি স্কোয়ার; মারুতির হর্ন বাজে
এ্যাম্বেসেডর চেপে হুস করে চলে যায়
শিলং সুন্দরী; কটনপ্লেসে
অজগর তাকিয়ে থাকে
সড়ক দ্বীপে মাতঙ্গিনী হাজেরা
গান্ধী-সুভাসের মর্মর মূর্তিগুলো
অনুর্বর বাতাস চিরে কি রকম সহজেই
হয়ে যায় কার্বণ রোদ, দূষিত বাতাস
অজগর শুয়েছিল নন্দনের বনে
নন্দন কাননে পাখি বসন্ত গোলাপ
সেই বন একরাতে ডালহৌসি স্কোয়ার
‘কলকাতা-কলকাতা’
লাবণ্য মেশানো চোখে ধূসর আঁচড়
নন্দন স্বপ্নতত্ত্ব বিশ্লেষণে মগ্ন
মিলেনিয়াম বিজ্ঞান।
সত্যকথন
নাসরীন জেবিন
ফিরিয়ে নাও তোমার সকল মুখের যাবতীয় কবচ
আত্মসমর্পণ করে আজ সত্য বলো
অসত্য ভাষণের হাত থেকে বাঁচিয়ে দাও সকল চোরাপথ
একে একে ফিরিয়ে দাও যত অঙ্গীকার।
বিপথ গামী থেকে এনে দাও সব ধ্রুবতারা
কাকে বলে সত্য আর বিপথ উত্তর চেয়ো না
প্রতিরোধ করে এসেছে হৃদয় হাঁ-মুখ প্রতীক্ষায়।
আশাবরী আলোয় যে প্রথম আলাপ
যাকে তোমরা বলো ভালবাসা
জীবনের পেছনে যে জ্যোতি:প্রভা
যাকে বলো ভালবাসা
আকাশের সাথে মিশে থাকে বেদনার রং
যাকে আমিও বলি ভালবাসা
সব আজ ফিরিয়ে দিতে চাই
বাঁচতে চাই একা নিজে
বেওয়ারিশ শবের ভীড়ে।
ভিজে পা
আলোক সরকার
সেঁতসেঁতে
পুরনো দিন।
তাকে অভ্যর্থনা দাও।
তার উচ্চারণ ছেঁড়াখোঁড়া উচ্চারণ।
তমঃস্বিনী
ভেজাপায়ে ঘরে এসেছে।
সারা ঘর ভরে ভেজা আঙুলের ছাপ।
তার চলা থেমে থেমে চলা।
যারা আসতে চাইছে
সাজ নিয়ে আসছে ভঙ্গি নিয়ে আসছে
সবার রঙে রঙ মেলাবার কোনো তাগিদ নেই।
সব মিলিয়ে একটা অবর্তমান।
অবর্তমানের সাহচর্যে অনির্দেশÑ
ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর নিশ্চয়ই।
স্মৃতি সব সময় তালগোল পাকানো
রঙিন!
রঙিন এবড়োখেবড়ো ভিজে পা।
একটা আঙুলে আলতা
অন্য আঙুলে
সোনার রঙের গহনা।
আশ্বিন-সন্ধ্যার স্মৃতি
উৎপল কুমার বসু
থালায় সাজানো ফল, ধান-দূর্বা, কিছু ফুল-পাতা,
সামনেই লাল পিঁপড়ের সারি, অদূরে পতঙ্গদল, সীতা
পুজোয় বসেছে...
ওরা সামরিক, ওরা প্রবঞ্চক, শত্রু এসেছে নিকটেÑ
সংবাদসাশ্রয়কারী ঐ কীট, অনুকীট,
রক্ত আছড়ে পড়ছে
দেব-দেবীদের মাথার আড়ালে...
বৃহত্তম সত্যের জন্য তবে তৈরি হও
...আজ বুঝি চূড়ান্ত বিচার।
বিপ্রতীপ
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
ঘুমঘুম বকুল গাছের দিকে এক মনে তাকিয়েই আছো
এক মনে অপেক্ষারতÑ
কখন আসবে কেউ একজোড়া হলুদ কাগজ
যেভাবে অপেক্ষারত দলছুট কবিতারা তোমার পাতায়Ñ
দলা দলা রক্ত উঠছে ঘনঘন
ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোনও সোদপুর অলিতে গলিতে
ফুসফুস পোকা।
টিম্টিম্্ আলো কোলে ভিতরের ঘরে বসে নার্স
আনমনে একপদী পাঠ করে গেঁথে যান একাকী বাঘনখ...
গিল্টির কায়দাটা রপ্ত হয় নি আজও...
বাগানের এক কোণে লোপাটিরা হাতছানি দিয়ে ডাকে
আয় আয় আয়
কবি তবু নড়ছে না ভাঙা টুল ছেঁড়া কাঁথা ছেড়ে...
অপু-দুর্গা
গার্গী মুখোপাধ্যায়
জুতোর বাক্সতে কিছু পুঁতি, রাংতা আর
ছেঁড়া ঘুড়ির কাগজ
তাই নিয়েই কেটে যায় কত অপুর দিন
দুর্গা আসে, আবার চলে যায়
ছেঁড়া আঁচলে মুখ ঢেকে কাটে
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা।
রেলগাড়ি ধোঁয়া ছেড়ে
পেরিয়ে যায় পথের পাঁচালীর সেই ছায়াঘেরা গ্রাম।
পেছনে পড়ে থাকে অপুর তালপাতার ভেঁপু।
আর দুর্গার ভাঙা আয়না।
দিন ঝরিয়ে এসে একা চাঁদ
তাপস রায়
ছিন্ন হয়ে আছে, বৃক্ষ থেকে ফুল
এবং মানুষও
উচ্চারণে এসে যেসব স্পর্শ প্রিয়মুখ
যেসব কান্নাহীন নীরবতা
তোমার চোখের বাহির হয়ে তোমাকেই
অপাঙ্গে তাকায়
দেখো না-ফুটে শালুক জলের উপরে এলো।
সারাদিন আমিও তো রক্তাক্ত মেঘ না-বুঝে
তার জলের অনুপ্রাস ধ’রে
স্নানের নিকটে গেছি, লোভী, চকচকে চোখ
এক একটি দহনবেলায় কেন রৌদ্রের
মনীষার কথা ভুলে আছি, কেন ভুল
সম্বোধন এসে তুলে নিয়ে যাবে স্নিগ্ধ আয়োজন।
কত কী ধমনি তুমি, আমি রক্তের নির্লজ্জতাটুকু
অন্ধকার ভেবে উঠি, আর কোনো গোধূলির চাঁদ
ফণীমনসার ঝোপে একা বসে থাকে।
পালটে যাচ্ছে
আকাশলীনা
পালটে যাচ্ছে চেনা পথ, ঘরবাড়ি মন,
পড়ে আছে ভাঙা কাহিনী রোমাঞ্চ জীবন।
না জন্ম না মৃত্যু চরাচর বুক চিরে।
বৃষ্টিতে ভেজে রোদ্দুর, নিঃশব্দ কবরে,
সাদা কালো ঋতু ভালো, প্রেম ছি ছি!
যে ছন্দে ছড়িয়ে পড়েছি ভুল ছিল বুঝি।
ফোঁটা ফোঁটা অভিমান হারিয়ে গেছে গহন জলে।
ভোর রাতে শ্রাবণের মালা তুলে রাখি নিরুপায় ছলে।
আগুন চাপা অনুভূতি জ্বলে পুড়ে ছাই,
পালটে যাচ্ছে সংজ্ঞাগুলো লোভী রক্তলাভায়।
নিঃশ্বাসে বিষ, মিথ্যে কথা দান অবিশ্বাস্য সভ্যতা ভেঙে খানখান,
সূর্য ওঠে চাঁদ হাসে ভালোবাসার কিনারা ছাপিয়ে,
গর্ভে জারজ সন্তান, স্পর্ধায় বাড়ে জরায়ু কাঁপিয়ে।
সূর্যানুসন্ধান
অমিত রায়
বৃষ্টিভেজা একটা পাখি শীতে কাতর
ডানা ঝাপটায় গাছের ডালে বসে।
মেঘলা দিনে বাদলা আঁধার
আকাশ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে খসে।
পথ নির্জন, ঝড়ো হাওয়া
মেঘের ধমক, আকাশ কালো।
সেই পাখিটা বাঁচার জন্য
খুঁজে বেড়ায় সূর্য-আলো।
সেই গাছটা হাওয়ার টানে কেবল দোলে
পাখি আওড়ায় হরেকৃষ্ণ নাম।
বয়স বাড়ে গাছের শাখায়, পাখির জীবন
মেটায় অনেক দাম।
নন্দিত অগ্নি-আশায় নতুন প্রাণের প্রার্থনাতে
ওড়ে পাখি গাছের থেকে অন্যখানে।
সেখানে সে জানতে পারে,
সেই মেয়েটার কাছে
একটা গোপন সূর্য আছে।
রঙের উৎসব
সোমনাথ রায়
আমার মাথায় তুমি হাত দিলে
পৃথিবীর তারারা আমার মুখ দ্যাখে
না দিলে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থাকে
আমার অস্তিত্ব, বলো তুমি উদার হবে কি?
তোমার প্রশ্রয় পেলে আমি অনায়াসে
যাবতীয় আবর্জনা মুহূর্তে পুড়িয়ে
শুরু করে দিতে পারি রঙের উৎসব
না পেলে বিবর্ণ হবো, তুমি সাক্ষী থেকো।
তোমার ছাতার সঙ্গে ছায়া মেখে হেঁটেছি যেদিন
বুঝেছি আকাশ আর মাটি পৃথিবীর
কতখানি কাছাকাছি অক্ষর যাপনে!
মানচিত্র ভেঙে দাও আমার জীবনে
পৃথিবীর নাগরিক হতে চাই আমি
তুমি মুক্তি দিলে আমি পাখি হতে পারি।
সম্পর্ক
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়
ইশারাকোরাসে সম্পর্ক বিস্তার হলে
দু’চোখ থেকে নামিয়ে রাখলে মেঘ
জলের ডাক শুনবে বলে অন্য কেউ
দ্যাখো, কেমন খুঁটে নিচ্ছে তাÑ
শিউলি কুড়ানোর মতো।
কে দিল ডাক ভিতর ঘরে
শুনব বলে দাঁড়িয়ে থাকি দু-এক জীবন
এখন তুমি ফেরার ট্রেনে
দু’চোখ ভরে আকাশ নিচ্ছ আমার কথা ভেবে
পাঠশালার পদ্য
অতনু ভট্টাচার্য
মিত্র আমার পেয়ে লাব আর ডুব
কথকের মনে নদী ডেকে যায় খুব
বাকি গাছ দেখে যায় তরল সড়ক
মনে পড়ে জন্মদাগ, জেগে ওঠে শোক
যাই পাবো আয়োজন জেনো মহাফের
জলে খালি মুখ দেখা অজানা সুখের
অস্তরাগ দেয় দাগ, হাড়ে লাগে কালি
এভাবে ভাবাই যেত, ওভাবে শেখালি।