
ছবি: সংগৃহীত
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা AI আজ প্রযুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগ থেকে শুরু করে বিনোদন পর্যন্ত জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এর জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। এআই নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠের মতো এর কিছু অন্ধকার দিকও রয়েছে, যা নিয়ে এখনই সচেতন না হলে ভবিষ্যতে মানবজাতিকে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হতে পারে। এআই-এর কারণে মানুষ যেসব সম্ভাব্য ঝামেলায় পড়তে পারে, সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:-
ভুল তথ্যের মহামারী ও Deepfake: AI ব্যবহার করে এখন খুব সহজে নকল ছবি, ভিডিও বা অডিও তৈরি করা সম্ভব, যা আসল থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। একে " deepfake" বলা হয়। এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির নামে মিথ্যা বক্তব্য বা আপত্তিকর ভিডিও তৈরি করে তার সম্মানহানি করা যায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা সমাজে দাঙ্গা সৃষ্টি করতেও deepfake ব্যবহার করা হতে পারে। যখন সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়বে, তখন সামাজিক বিশ্বাস ও স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়বে। বর্তমানের ইরান-ঈস+রায়ে+ল ইস্যুতে এমন কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যারা AI দিয়ে বানানো।
প্রাইভেসির জন্য হুমকি: AI সিস্টেমগুলো সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে ডাটা ব্যবহার করে। আমাদের অনলাইন কার্যক্রম, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, কেনাকাটার অভ্যাস, এমনকি মুখের ছবি ও কণ্ঠস্বর সবই এখন ডাটা। এই ডাটা ব্যবহার করে শক্তিশালী AI আমাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এমন সব তথ্য জেনে ফেলতে পারে, যা আমরা গোপন রাখতে চাই। এই ডাটা ভুল হাতে পড়লে বা বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে ব্যক্তির গোপনীয়তা ও স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব হবে।
- মানবিক দক্ষতার অবমূল্যায়ন ও অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা: আমরা যদি সবকিছুর জন্য AI এর ওপর নির্ভর করতে শুরু করি, তাহলে আমাদের নিজস্ব চিন্তা করার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাবে। শিক্ষার্থীরা হোমওয়ার্কের জন্য, লেখকরা লেখার জন্য এবং শিল্পীরা ছবি আঁকার জন্য সম্পূর্ণভাবে AI এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে মানুষের মৌলিক মেধা ও দক্ষতার অবমূল্যায়ন ঘটবে। অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা আমাদের একটি মেধাহীন ও অলস জাতিতে পরিণত করতে পারে।
কর্মসংস্থানের ব্যাপক সংকট: এআই নিয়ে সবচেয়ে বড় ভয়টি হলো চাকরি হারানো। যে কাজগুলো পুনরাবৃত্তিমূলক এবং তথ্যের ওপর নির্ভরশীল, যেমন- ডাটা এন্ট্রি, কাস্টমার সার্ভিস, ফ্যাক্টরির উৎপাদন, এমনকি অ্যাকাউন্টিং ও কোডিং এর মতো কাজগুলোও স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারাতে পারে। নতুন ধরনের চাকরি তৈরি হলেও, বিপুল সংখ্যক কর্মহীন মানুষের জন্য দ্রুত নতুন দক্ষতা অর্জন করে সেই চাকরি করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হবে। এর ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অস্থিরতা বাড়বে।
পক্ষপাতিত্ব ও বৈষম্যের বিস্তার: AI নিজে থেকে কিছু শেখে না, তাকে মানুষের তৈরি ডাটা দিয়ে শেখানো হয়। যদি সেই ডেটার মধ্যে লিঙ্গ, বর্ণ বা জাতিগত পক্ষপাতিত্ব থাকে, তবে AI সেই পক্ষপাতিত্বকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। যেমন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত AI যদি পুরানো ডাটার ওপর ভিত্তি করে শেখে যে পুরুষ কর্মীরা বেশি পদোন্নতি পায়, তবে সেটি নতুন আবেদনকারীদের মধ্যে পুরুষদেরকেই অগ্রাধিকার দেবে। একইভাবে, ঋণ প্রদান বা অপরাধী শনাক্তকরণের মতো সেনসেটিভ ক্ষেত্রে AI এর পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত সমাজে বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে।
নৈতিক ও আইনি জটিলতা: AI চালিত সিস্টেম যখন কোনো ভুল করে, তখন তার দায় কে নেবে? একটি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি যদি দুর্ঘটনা ঘটায়, তার জন্য গাড়ির মালিক, নির্মাতা নাকি সফটওয়্যার ডেভেলপার দায়ী থাকবে? কিংবা AI যদি কোনো রোগীর ভুল চিকিৎসা করে, তার দায় কার? এছাড়া, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হলে যুদ্ধক্ষেত্রে নৈতিকতার সীমা কোথায় থাকবে, তা নিয়েও বড় ধরনের প্রশ্ন উঠছে।
এআই নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি, যা মানবজাতির উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রযুক্তিকে অন্ধের মতো গ্রহণ না করে এর দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। AI এর প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য এখনই সুস্পষ্ট নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করা জরুরি। আমাদের এমন একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হবে, যেখানে AI মানুষের সহকারী হিসেবে কাজ করবে, প্রতিদ্বন্দ্বী বা নিয়ন্ত্রক হিসেবে নয়। প্রযুক্তির লাগাম মানুষের হাতেই রাখতে হবে, নাহয় এই আশীর্বাদই একসময় অভিশাপে পরিণত হতে পারে।
আঁখি