
প্রযুক্তি জগতে এআই যে কীভাবে বদলে দিচ্ছে কর্মসংস্থানের চিত্র, তা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করছেন ২০ বছরের অভিজ্ঞ এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার শন কে। চাকরি হারিয়ে তিনি এখন দিন কাটাচ্ছেন নিউইয়র্কের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি ছোট্ট ট্রেলারে। কিছুটা মানবিক কষ্ট, কিছুটা ভবিষ্যতের শঙ্কা,দুয়েরই মিশ্রণ রয়েছে তার গল্পে।
২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা পেরিয়ে গেছেন। কোভিডের ধাক্কাও সামলে নিয়েছিলেন দ্রুত। কিন্তু গত বছরের এপ্রিল মাসে চাকরি চলে যাওয়ার পর শন বুঝতে পারলেন, এইবারের পরিস্থিতি আলাদা। চারদিক নীরব, ঠান্ডা আর উৎকণ্ঠায় ভরা। আর আগের মতো দ্রুত কোনো ইন্টারভিউ আসছে না, যেটুকু আসছে, সেগুলোর পিছনে রয়েছেন না কোনো মানুষ, বরং এআই-চালিত প্রোগ্রাম।
৪২ বছর বয়সি এই কম্পিউটার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট একজন পূর্ণাঙ্গ ‘ফুলস্ট্যাক’ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ওয়েব টেকনোলজিতে তার বিশেষ দক্ষতা। আগে যেখানে বছরে ১.২৮ কোটি টাকার সমান বেতন পেতেন, এখন সেখানে মাসে কষ্ট করে কয়েকশো ডলার আয় হচ্ছে খাদ্য ডেলিভারি আর পুরনো ইলেকট্রনিকস বিক্রি করে।
ক্যারিয়ার শেষের পথে, কারণ এআই?
ফরচুন ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শন জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০টি চাকরির আবেদন করেছেন, কিন্তু তার মধ্যে ১০টিরও কম ইন্টারভিউ পেয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের চোখে না পড়েই তার রিজিউমে বাদ পড়ে গেছে,কারণ, সেগুলোর স্ক্রিনিং করছে এআই।
মেটাভার্সের মতো ‘পরবর্তী বড় জিনিসে’ কাজ করেছেন তিনি। অথচ এখন সেই স্বপ্ন ছাপিয়ে গেছে জেনারেটিভ এআই-এর উত্থানে। চ্যাটজিপিটির মতো প্ল্যাটফর্মই এখন প্রযুক্তি আলোচনার কেন্দ্রে, আর শন-এর মতো দক্ষ পেশাজীবীরা রয়ে যাচ্ছেন পাশে পড়ে।
এক বছর ধরে বেকার
গত এক বছর ধরে চাকরির খোঁজে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন শন। কখনো নতুন টেক সার্টিফিকেট কোর্সের খোঁজ করছেন, কখনো ভাবছেন ট্রাক চালানোর লাইসেন্স (CDL) নেবেন কি না। কিন্তু অর্থের অভাব সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে শন মনে করেন, তার অবস্থা নিছকই এক ব্যক্তির দুঃখের গল্প নয়, বরং ভবিষ্যতের একটি স্পষ্ট সংকেত। তার কথায়, এআই এখন আর কেবল প্রযুক্তি নয়, এটি এক নতুন ধারা, যা কোটি কোটি চাকরির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চলেছে।
‘আমি এআই-বিরোধী নই, কিন্তু ব্যবহারে ভুল আছে’
তিনি নিজেকে এআই ‘ম্যাক্সিমালিস্ট’ বলেন অর্থাৎ, তিনি বিশ্বাস করেন সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে এআই মানবসভ্যতার উন্নতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা তাকে আশাহত করছে। তার মতে, এআই এখন মানুষের দক্ষতাকে সমৃদ্ধ করার বদলে সরাসরি প্রতিস্থাপন করছে, যা শুধু কর্মসংস্থান নয়, প্রযুক্তির ভবিষ্যতের জন্যও বিপজ্জনক।
শন-এর মত, সমস্যা প্রযুক্তিতে নয়, চিন্তাভাবনায়
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, সমস্যা মেশিনের স্মার্ট হয়ে ওঠা নয়, সমস্যা মানুষের চিন্তায়। কোম্পানিগুলো এখন শুধু খরচ কমাতেই ব্যস্ত, উদ্ভাবন বা টিমকে সমৃদ্ধ করার চিন্তা নেই। এতে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি জগত আরও সংকীর্ণ হয়ে পড়বে।
বিল গেটস কী বলেছিলেন?
'দ্য টুনাইট শো' অনুষ্ঠানে বিল গেটস বলেছিলেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে এআই মানুষের অধিকাংশ কাজই করে ফেলবে। তার ধারণা, এই পরিবর্তনের ফলে ৫ দিনের ওয়ার্কউইক হয়তো ২-৩ দিনেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। এই প্রযুক্তি কাজের ধরন বদলে দেবে, মানুষকে দেবে আরও বেশি অবসর আর সৃজনশীলতার সুযোগ।
মাইক্রোসফট এআই-এর সিইও মোস্তাফা সুলেমানও মত দিয়েছেন যে, এআই শুধু মানুষের কাজকে সহায়তা করবে না, বরং একসময় তা সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করবে।
বিল গেটসের আশাবাদের পাশাপাশি শন-এর বাস্তব অভিজ্ঞতা এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি করে। একদিকে প্রযুক্তির সম্ভাবনা, অন্যদিকে মানুষের অনিশ্চয়তা। এই চিত্র শুধু শন-এর নয়, বরং অগণিত টেক পেশাজীবীর ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি।
সূত্র:https://tinyurl.com/yeku7ryy
আফরোজা