
ছবি: জনকণ্ঠ
খাগড়াছড়িতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চিকিৎসা সেবা; বন্ধ নতুন ভবন নির্মাণ কাজ ভোগান্তিতে লক্ষাধিক মানুষ
শত বছরের পুরনো নল খাগড়ার ঘরে ঝুঁকি নিয়ে চলছে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসা সেবা। ৬ বছরেও শেষ হয়নি ২ বছরের নির্মাণ কাজ। বলছি খাগড়াছড়ি জেলা দীঘিনালা উপজেলার একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কথা।
হাসপাতাল ঘরের দেয়াল জীর্ণশীর্ণ, ঝড়ে পড়ে গেছে সিমেন্ট এর প্রলেপ, বেরিয়ে পড়েছে নলখাগড়া। শত বছরের পুরনো নলখাগড়ার তৈরি ঘরে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকলেও এটি ব্যবহারের প্রায় অনুপোযোগী। উপজেলার লক্ষাধিক মানুষের একমাত্র চিকিৎসার ভরসা দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এমন করুণ অবস্থা। অবস্থা এমন যে, যে কোন সময়ে সামান্য বাতাসে ধসে পাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯২৪ সালে নলখাগড়া আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি টিনের ছাউনি ঘরে চালু করা হয় ডিসপেনসারি। সেই ডিসপেনসারি ঘরকে বিগত ১৯৮০ সালে চালু হয় ১০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এই ঘরেই বর্তমানে চলছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কার্যক্রম। ২০১১ সালে ৩১ শয্যায় উন্নীত করার লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে ভবন নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে পূর্বের ১০ শয্যা থেকে বাড়িয়ে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করার প্রকল্প নেয় স্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর।
খাগড়াছড়ি জেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ৪র্থ স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচি (HPNSP) প্রকল্পের আওতায় দীঘিনালা হাসপাতাল ১০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের লক্ষ্যে ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ২১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। এতে কেটি এমসি জেবি (কবির ট্রেডার্স ম্যাক কনস্ট্রাকশন) নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের দায়িত্ব পান। আর নির্মাণ কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছেন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর খাগড়াছড়ি।
চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতাল ভবনটি ৩০ এপ্রিল ২০২১ এর মধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে কতৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু পরপর ৯ বার কাজের মেয়াদ বাড়ানোর পরও নির্মাণাধীন ভবনের ৮৯ ভাগ কাজ সম্পন্ন হলেও ১১ ভাগ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এর মধ্যে মোট বাজেটের ১৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উত্তোলন করেন।
সম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, নলখাগড়ার তৈরি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের ছোট ছোট ছয়টি কক্ষে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগের চিকিৎসকেরা ছোট ছোট কক্ষে গাদাগাদি করে বসে আগত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। ঘরের খুঁটিগুলো নড়বড়ে। ঘরটির টিনের চালায় মরিচা ধরেছে। সিমেন্ট খসে গিয়ে নলখাগড়া ঝড়ে পড়েছে। চিকিৎসকের কক্ষের সামনের বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেবা নিতে রোগীরা।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক কর্মকর্তা বলেন, জীর্ণ ভবনটিতে বৃষ্টি হলে জরুরি বিভাগ, ড্রেসিং কক্ষ ওয়ার্ডে পানি পড়ে খসে পড়ছে টিনের মরিচা, সিমেন্ট বালি। তাছাড়া ১৪ জন ডাক্তারের পোস্ট থাকলেও মাত্র ৫জন ডাক্তার রয়েছে।
বৃহত্তর জনসংখ্যার এই উপজেলার একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় এবং সময়মত কাজে শেষ না করায় ক্ষোভ জানিয়েছে স্থানীয়রা।
উপজেলার পশ্চিম কাঠালতলীর বাসিন্দা মোঃ রাইয়ান এর পিতা মোঃ রবিন বলেন, গত তিনদিন আগে ছেলের ঠান্ডাজনিত কাশি নিয়ে ভর্তি করায়, হাসপাতালে রোগীদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়, টয়লেট ঠিক নাই, মহিলাদের গোসল করার ব্যবস্থা নাই। নতুন ভবন চালু না হওয়ায় আমাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
উপজেলার কামাকুছড়া এলাকার মান্টি চাকমা পেট ব্যাথা নিয়ে ভর্তি হয়। তিনি বলেন সামান্য কিছু হইলে আমরা খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। কোন পরিক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা নাই। এতে আমাদের মতো গরীব মানুষের কষ্ট হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালে বিভিন্ন রোগে ভর্তিকৃত আরেক রোগী জানান, পুরাতন জরাজীর্ণ ঘরে জরাজীর্ণ ব্যাডে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাঁরা। পর্যাপ্ত ব্যাড না থাকায় বহু রোগীদের ফ্লোরে বসে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তণয় তালুকদার বলেন, শত বছরের পুরনো জরাজীর্ণ ঘরে চিকিৎসা সেবা চরম ভাবে ব্যাহত হচ্ছে, আগে ভর্তি রোগীর জন্য কয়েকটি ওয়ার্ড থাকলেও নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণের জন্য ভেঙে এখন মাত্র দুইটি রুমে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে হয়। তাছাড়া নতুন হাসপাতালে ৯০ ভাগ শেষ হয়েছে কিন্তু একাধিকবার সময় বাড়িয়ে নেয়ার পরও শেষ করতে পারেনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ। স্বল্প শয্যা নিয়ে অতিরিক্ত রোগীর চাপ থাকায় আমরা চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। পুরোনো জরাজীর্ণ ঘরে বসে সেবা দিতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। রোগীর চাপ বেশি থাকায় শয্যা সংকটের কারণে ভোগান্তি হচ্ছে রোগীদের। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন ভবনগুলোর কাজটি দ্রুত শেষ হলে মানসম্মত সেবা পাবে উপজেলার হাজারো মানুষ।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের খাগড়াছড়ি জেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ হেলাল উদ্দিন বলেন, ৪র্থ স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচি (HPNSP) প্রকল্পের আওতায় দীঘিনালা হাসপাতাল ১০শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের লক্ষ্যে ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পর পর ৯ বার মেয়াদ বাড়ানোর পরও কাজটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভবন নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে বর্তমানে কাজ বন্ধ আছে। নতুন প্রকল্প অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত কাজ শুরু হবে না। তবে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্লান (DPP) এর আওতায় খুব শিগগিরই কয়েকটি রুমের কাজ সম্পন্ন করা হবে। যাতে করে হাসপাতালের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।
৫০ শয্যা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবা শুরু হলে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাবে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষসহ পাশ্ববর্তী রাঙামাটি জেলার লংগদু ও বাঘাইছড়ির উপজেলার মানুষ। প্রশাসনের তদারকির মাধ্যমে দ্রুত কাজ শেষ করে হাসপাতাল চালুর দাবি জানান স্থানীয় ভুক্তভোগীরা।
এএইচএ