ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

দাসত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মত্যাগের প্রতীক এক ঐতিহাসিক ভোজ

‘দি লাস্ট সাপার’: শুধুই কি চিত্র?

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:৩৯, ২১ জুন ২০২৫

‘দি লাস্ট সাপার’: শুধুই কি চিত্র?

‘দি লাস্ট সাপার’

“দি লাস্ট সাপার” — এক চিত্রকর্মের নাম হলেও, এর চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে এই ঘটনা। একটি রাত, একটি টেবিল, আর ইতিহাসের এমন এক নৈশভোজ যা আজও হাজার বছরের রহস্য ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এটি কি সত্যিই কেবল যিশু খ্রিস্টের শেষ আহার? নাকি এই ভোজের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা ও মুক্তির এক গভীর গল্প?

একটি সাধারণ ভোজ, যা একসময় দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রতীক ছিল, সেটিই কি হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় ইতিহাসের এক মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা?

 

ইহুদি মুক্তি আন্দোলনের উৎসবে যিশুর অংশগ্রহণ

“দি লাস্ট সাপার” একটি বিশেষ উপলক্ষ্য—ইহুদি ধর্মের পাসোভার উৎসব। এই উৎসব প্রতি বছর পালন করে ইহুদিরা, মিসরের ফারাওদের দাসত্ব থেকে নিজেদের মুক্তির স্মরণে। হাজার বছর আগে, মুসা (আ.)-এর নেতৃত্বে ইহুদি জাতি দাস জীবন থেকে মুক্ত হয়ে পাড়ি জমায় নতুন জীবনের পথে।

পাসোভার উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয় এক বিশেষ রাতের খাবার, যা “সেদার মিল” নামে পরিচিত। সেই খাবারে থাকে—

🔵ম্যাটজাহ (পূরানোহীন রুটি) – তড়িঘড়ি করে মিশর ছাড়ার স্মারক

🔵তিতা শাকসবজি – দাসত্বের কষ্টের প্রতীক

🔵আঙুরের রস বা মদ – ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ব্যবহৃত

🔵ভাজা হাড় – কোরবানির স্মৃতিচিহ্ন


এই প্রতিটি উপাদান একেকটি ব্যথার ইতিহাস ও আশার প্রতীক। এই ভোজই ছিল যিশু খ্রিস্টের “শেষ নৈশভোজ”।

 

✝️ একটি বিশ্বাসঘাতকতা, একটি ভবিষ্যদ্বাণী

পবিত্র বাইবেল অনুসারে, শেষ নৈশভোজে যিশু তাঁর ১২ জন শিষ্যকে নিয়ে বসেছিলেন। খাবারের মাঝেই তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে একজন আজ রাতেই আমাকে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।” সেই বিশ্বাসঘাতকতা করেন জুডাস ইসকারিয়ট, যিনি রোমান সেনাদের হাতে যিশুকে তুলে দেন ত্রিশ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে।

এই ভোজেই যিশু তাঁর অনুসারীদের বলেন, “এই রুটি আমার দেহ, এই মদ আমার রক্ত—তোমরা এটি স্মরণে কর।” এভাবেই খ্রিস্টানদের ধর্মীয় আচার Holy Communion বা Eucharist-এর সূচনা ঘটে।


🎨 শিল্পকলায় চিরন্তন ‘দি লাস্ট সাপার’

ইতালির রেনেসাঁ যুগের কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তাঁর অমর চিত্রকর্ম “The Last Supper”-এ যিশু ও তাঁর শিষ্যদের সেই মুহূর্ত চিত্রায়িত করেন। এই চিত্রশিল্পে প্রতিটি মুখাবয়ব, দৃষ্টিভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গি হয়ে ওঠে একেকটি গল্প। বিশেষ করে জুডাসের ছায়াময় মুখ এবং অন্যদের বিস্ময়াবিষ্ট চেহারা এখনো বিশ্বজুড়ে আলোচ্য বিষয়।

 

মুক্তির উৎসব থেকে আত্মত্যাগের প্রতীক

দাসত্ব থেকে মুক্তির উৎসব পাসোভার, আর সেই পবিত্র ভোজের মাঝে এক মহা আত্মত্যাগের সূচনা—এমন অনন্য মিল ইতিহাসে বিরল।
এই ভোজে একদিকে আছে ইহুদিদের সংগ্রামী ইতিহাস, অন্যদিকে যিশুর পরিণতির পূর্বাভাস।
দু’টি ধর্ম, দুটি ঐতিহ্য—একই টেবিলে বসে একে অপরকে ছুঁয়ে যায়।


ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে মানবিক পাঠ

আজকের দুনিয়ায়, যেখানে ভেদাভেদ, সহিংসতা ও স্বার্থপরতা বেড়েই চলেছে, সেখানে “দি লাস্ট সাপার” আমাদের শেখায়—

▪️দাসত্ব থেকে মুক্তি মানে কেবল শারীরিক স্বাধীনতা নয়, মানসিক ও নৈতিক উন্মোচন

▪️বিশ্বাসঘাতকতা হতে পারে সবচেয়ে আপনজনের দ্বারাও

▪️আত্মত্যাগ, দয়া ও ঈশ্বরের ওপর আস্থা—এই তিনই মানুষের চূড়ান্ত মুক্তির পথ

 

‘দি লাস্ট সাপার’ কেবল একটি চিত্রকর্ম নয়—এটি ধর্ম, ইতিহাস ও মানবিক মূল্যবোধের সংযোগবিন্দু। এই নৈশভোজে যেমন ধরা পড়ে দাসত্ব থেকে মুক্তির আনন্দ, তেমনি প্রতিফলিত হয় আত্মত্যাগ ও বিশ্বাসঘাতকতার ট্র্যাজেডি। যিশুর শেষ আহারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক ধর্ম, গড়ে উঠেছে এক চিরন্তন বার্তা—যেখানে টেবিলের চারপাশে বসা মানুষগুলো শুধু খাবার ভাগ করেনি, ভাগ করেছিল বিশ্বাস, ভয়, সংকল্প ও বিদায়ের নীরবতা।

আজও ‘দি লাস্ট সাপার’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়: ইতিহাসের গভীরতম সত্যগুলো কখনও কখনও এক রাতের ভোজেই রচিত হয়।

 

তথ্যসূত্র:

  • বাইবেল (ম্যাথিউ, মার্ক, লুক, জন)
  • তোরাহ ও হিব্রু ধর্মগ্রন্থ
  • Leonardo da Vinci’s notebooks
  • Jewish Virtual Library & Encyclopaedia Judaica

Mily

×