বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিএনপির ৪২২ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রবিবার দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, এখন আমাদের যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে ধৈর্য ধরে সহনশীলতার সঙ্গে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা যেন কাজ করতে পারেন। তাদের সবাইকে কাজ করতে দিন। অতিদ্রুত সংস্কারকাজে তারা হাত দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এই কাজগুলো করা দরকার।
এই কাজগুলো অতিদ্রুত শেষ করে একটা নির্বাচনের দিকে যাওয়া, যে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে এবং জনগণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। তার পর বাকি কাজগুলো তারা সম্পন্ন করবে। এখানে আমাদের যেটা প্রয়োজন, ঐক্য অটুট রাখা, ধৈর্য রাখা, এই সরকারের সমস্ত কাজকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, নির্বাচনকেন্দ্রিক যে সংস্কারগুলো অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব জায়গায় আগে সংস্কার করতে হবে। যেমন, আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করে অনেককেই শাস্তি দিয়ে দিয়েছে। আমাদের শাস্তি দেওয়ায় দুই বছর তো নির্বাচন করতে পারব না। সেটার সংস্কার হওয়া প্রয়োজন।
আর অন্যান্য সংস্কার যেগুলো আছে, সেটা যে সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসবে, তারা করবে। অবশ্য আমরা বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো রাষ্ট্র মেরামতে প্রণীত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব আগেই দিয়ে রেখেছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা জানি যে, প্রশাসন এখন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদমুক্ত হতে পারেনি। এই ফ্যাসিবাদমুক্ত হতে না পারার প্রধান কারণ হচ্ছে, ফ্যাসিবাদ এত গভীরে চলে গিয়েছিল যে, সেখান থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী লোকজনকে খুঁজে বের করা কঠিন হয়েছে।
দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে চলমান অস্থিরতা ফ্যাসিবাদের দোসরদের ইঙ্গিতে বলে মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, শিল্পাঞ্চলগুলোতে যে অশান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে সুস্পষ্টভাবে ফ্যাসিবাদের দোসরদেরই ইঙ্গিত আছে। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এই জিনিসগুলো থেকে মনে হচ্ছে যে, একটা চক্রান্ত চলছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় হচ্ছে তা শুনে-টুনে যা বুঝি সীমান্তের ওপার থেকে ‘কথিত ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার অডিও-টডিও’ ফাঁস করে দেওয়া হয়, যেগুলোতে বিভ্রান্তিকর খবর থাকে।
অন্যদিকে আবার প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে যারা ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে, যেটা একেবারে নিরর্থক। এটা আমরা শুধু নয়, ভারত থেকে যে সকল সাংবাদিক এসেছিলেন তারা পর্যন্ত দেখে গেছেন, তারা রিপোর্ট করেছেন যেটা বলা হচ্ছে, সেটা সঠিক নয়। যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে সেটা সব সময় হয়, হতেই পারে।
সুতরাং চক্রান্তটা ওই জায়গায়। তবে আমরা চক্রান্ত পছন্দও করি না।
১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথযাত্রায় বিএনপির ভূমিকা, অবদান এবং প্রত্যাশার বিষয়গুলো তুলে ধরতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৮৭৫ জন নিহতের মধ্যে বিএনপির কমপক্ষে ৪২২ জন।
দেশের স্বাধীনতাকে যখনই গ্রাস করেছে স্বৈরতন্ত্র, প্রতিবারই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে বিএনপি। ১৬ বছরের স্বৈরাচারী দুঃশাসনকে চূর্ণ করে ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ আবারও মুক্তির স্বাদ পায়, গণতন্ত্রের পথ সুগম হয়। অসংখ্য ব্যক্তি ও পরিবার রয়েছে, যাদের বছরের পর বছর ধরে ত্যাগের মহিমায় আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে নিহত হন ৮৭৫ জন, যার মধ্যে কমপক্ষে ৪২২ জন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দেশজুড়ে নিহত হওয়া সকল শ্রেণি-পেশা-রাজনীতির মানুষগুলোর এই বিশাল অংশ যে বিএনপিরই নেতাকর্মী এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতক সংগ্রামের অনিবার্য ফল।
পোশাক শ্রমিক কিংবা রিক্সচালক, পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাম কিংবা ডান আদর্শের অনুসারী সকল মত ও পথের রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতাহতের পরিচয় যাই হোক না কেন, প্রতিটি প্রাণের মূল্য ও রক্তের মর্যাদা সমান।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের ঐক্যকে ধারণ করে, গণতন্ত্রের পক্ষের সকল শক্তির বলিষ্ঠ ভূমিকায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। দেশের জনগণের এই বিজয় শুধুই দেশের মালিকানা ফিরে পাওয়ার বিষয় নয়, এটি দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রতিশ্রুতি, যা অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত।
মির্জা ফখরুল বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের জন্য যে জাতীয় ঐকমত্য আমরা দেখেছি, তা কিন্তু হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। এটি মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যাচার-অবিচার, দুর্নীতি-দুঃশাসন, বঞ্চনা-অবজ্ঞা এবং শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে গণআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে গণঅভ্যুত্থানের সময় সর্বশক্তি দিয়ে রাজপথে নেমে আসে বিএনপি এবং সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জনগণের কাতারে নেমে আসে বিএনপির সঙ্গে সমমনা সকল রাজনৈতিক দল তথা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিসমূহ।
মির্জা ফখরুল বলেন, হাসিনাকে সরিয়েছি এখন একটা অন্তর্র্বতীকালীন সরকার আছে সে সরকার অতিদ্রুত আমাদের সকলের মতামত নিয়ে একটি সংস্কারের মধ্য দিয়ে তারা নির্বাচনে যাবে। যে নির্বাচনটা অবাধ নিরপেক্ষ হবে, জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। আমি একটু খোলামেলা বলছি, অনেক সময় দেখা যায় যে, অত্যন্ত দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের নেতরা এমন এমন কথা বলেছেন যে, যেটা সামগ্রিক ঐক্যের জন্য উপযোগী নয়। এটা একটা সমস্যা।