
রাশেদ খান মেনন
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের কাছে ১০টি আসন চাইবে। কোনো দল নির্বাচনে আসুক বা না আসুক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচন কারোর জন্য বসে থাকবে না। ১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা যদি বিএনপি অস্বীকার করে তাহলে ভুল হবে। তবে এটা সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রেই প্রকল্প ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে। এটা খতিয়ে দেখা দরকার। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর আন্দোলন আমরা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করব। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলেও তিনি মনে করেন।
জোটের নির্বাচনে আপনার দলের কি ভূমিকা থাকবে এমন প্রশ্নের উত্তরে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা বহু আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১৪ দলীয় জোটে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। আগামীতে ১৪ দলের যে বৈঠক হবে, সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৪ দল জোটবদ্ধভাবেই অংশ নেবে।’
এবারের নির্বাচনে শরিক দলগুলো কি গতবারের চেয়ে বেশি আসন দাবি করবে? আর আপনার পার্টিই বা কতটি আসন চাইবে জোটের কাছে-এর উত্তরে রাশেদ খান মেনন বলেন, আমরা ১৪ দলের কাছে আসন চাইব। তবে আমাদের দল এবার ১০টি আসন চাইবে। গতবারের নির্বাচনে আমরা ছয়টি আসন চেয়েছিলাম।
১৪ দলীয় জোটের পরিধি বাড়ানো হবে কি না বা অন্য দল আসতে চাইলে কি হবে- এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ১৪ দলীয় জোটের পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। অন্য দল আসলে মহাজোট হতে পারে বা নির্বাচনী জোট হতে পারে।’
বিএনপির দাবি না মানলে নির্বাচনে আসবে না- এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি? এর উত্তরে মেনন বলেন, এখন বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, সেটা তাদের দলীয় স্দ্ধিান্ত। তবে আমি মনে করি এ সিদ্ধান্ত ভুল। অতীতেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা আসেনি। না আসার ফলে নির্বাচন একতরফা হয়েছে। এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে যদিও তারা যোগ দিয়েছিল কিন্তু তারা নির্বাচনী প্রচারণায় নামেনি। বরঞ্চ নির্বাচনটা খেলার ছলে নিয়েছিল। যার ফলে তারা খুব কমসংখ্যক আসন পেয়েছিল। এখন তারা যে অভিযোগ নিয়ে আসছে মূূলত তারা নিজেরাই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়নি। এবং নির্বাচনকে নিয়ে কিছুটা প্রহসনে পরিণত করেছিল। নির্বাচন বাণিজ্য করেছিল। আমি মনে করি এবার যদি তারা নির্বাচনে না আসে সবচেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। এবং এ দল থাকবে কি না সেটাও একটা সন্দেহের বিষয়।
বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে আপনারা কি তাদের রেখে নির্বাচনে যাবেন? এর উত্তরে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা নির্বাচনে যাব। নির্বাচন তো কারও জন্য বসে থাকবে না। সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে, সরকারের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হলে অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। সে নির্বাচন অবশ্যই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
শরিক দলগুলোর অনেক দাবিই মানা হয়নি। এ নিয়ে শরিকরা মনোক্ষুণ্ণ। এর পরেও কি আপনারা একসঙ্গে চলবেন? এর উত্তরে রাশেদ খান মেনন বলেন, এটা তো মনোক্ষুণ্ণের বিষয় না। রাজনীতির অর্থ হচ্ছে ছাড় দেওয়া এবং নেওয়া। এখানে কারও ক্ষেত্রে আমরা লাভবান হয়েছি, যেমন দুর্নীতি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। অন্যান্য যে দাবি ছিল, সেগুলো পূরণ হয়েছে। তবে নাগরিক জীবনের পরিবর্তনের যে দাবিগুলো ছিল সেগুলো আসেনি। উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে জনজীবনের যে সংকট ছিল সেগুলো মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে যে দাবিগুলো ছিল তা পূরণ হয়নি। ফলে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা জোট ভেঙে বেরিয়ে যাব। আমরা মনে করি, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতা শক্তি এখনো রয়েছে। তারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
জামায়াত-শিবির প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘাপটি মেরে আছে। তাদেরকে কীভাবে শনাক্ত করা যাবে। সে প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, এটা তো আমরা বহুবার বলেছি। জামায়াত-শিবির যেখানে আছে তাদেরকে বের করে দেওয়া দরকার। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের মধ্যেই অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এ কারণে তাদেরকে সহজে বের করা সম্ভব হচ্ছে না। নব্য আওয়ামী লীগাররা অথবা যারা ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগার হয়েছে, তাদেরকে চিহ্নিত করা দলের উচিত।
স্বাধীনতার পর দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বিএনপি বলছে, উন্নয়নের নামে লুটপাট হয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কি বলেন। তার উত্তরে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, দেশে উন্নয়ন হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা যদি বিএনপি অস্বীকার করে তাহলে ভুল কথা হবে। উন্নয়ন আমাদের চোখের সামনে দেখছি। বাস্তবতায় আমাদের অবকাঠামোগত প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই উন্নয়ন অবদান রাখছে। একটি পদ্মা সেতুই কেবলমাত্র আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে দুই দশমিক তিন ভাগ বৃদ্ধি ঘটাবে।
এই যে রেল সংযোগ হলো এটা একইসঙ্গে প্রবৃদ্ধি ঘটাবে। এই যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখছি মেট্রোরেল বলি অথবা আমাদের কর্ণফুলী টানেল তথা বঙ্গবন্ধু টানেলের কথা বলি, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা বলি, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে উৎপাদন আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তবে এটা সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রেই যে সমস্ত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যয় অনেক বেশি ছিল। এটা খতিয়ে দেখা দরকার। এর মধ্য দিয়ে কিছু লোক লাভবান হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বিষয়টি সরকারের তরফ থেকে খতিয়ে দেখা উচিত। সরকারের নিরীক্ষা ব্যবস্থা এগুলো খতিয়ে দেখবে আশা করি। এর সত্যতা-অসত্যতা তখন বেরিয়ে আসবে।
বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীরা নাক গলানোর বিষয়টি কীভাবে দেখছেন এর জবাবে মেনন বলেন, এটা আমরা সব সময়ই বলেছি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা মনে করি, বিদেশী এই মুরুব্বিয়ানার কোনো প্রয়োজন নেই। একটা সময় ছিল যখন আমরা তাদের ওপর নির্ভর ছিলাম। এখন তা নেই। সুতরাং আজকের এই ক্ষেত্রে এসে বিদেশীরা আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাবে-এটা আমরা মেনে নিতে রাজি নই। এটা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ বলেই আমরা মনে করি।
সিপিবিসহ কয়েকটি বাম দল বলছে, আপনারা আদর্শ থেকে সরে এসেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি করছেন। যে ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দলের জোট করা হয়েছিল তা এখন বাক্সবন্দি। এসব অভিযোগের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি? এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে সিপিবিও এক সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করেছে। দ্বিতীয়ত, এর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের মানুষের জীবনের যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, মৌলবাদ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা লাভবান হয়েছি। এই সত্যকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে সিপিবি বা এই দলগুলো প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদ সাম্প্রদায়িক পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করছে।
তাদের বর্তমান অবস্থা মূলত এই দক্ষিণপন্থি শক্তি কাছাকাছি অবস্থান ছাড়া আর কি। আর ২৩ দফা কর্মসূচির সবগুলোই বস্তবায়িত হয়নি-এমনটা সত্য নয়। আবার খুব সামান্য বাস্তবায়িত হয়েছে এটাও সত্য নয়। বাক্সবন্দি হয়ে আছে, এটা তো দীর্ঘ প্রক্রিয়া। লড়াইয়ের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের দাবিগুলোকে পূরণ করতে হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদেরকে আমেরিকা কানাডা দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে না। এক্ষেত্রে খুনিদের আশ্রয় দিয়ে কি তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে? তার উত্তরে মেনন বলেন, আমরা সবসময় বলে এসেছি যে, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারের দাবি হাস্যকর। কারণ নিজের দেশেই তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দায়ী হয়েছে। আমাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এটা তাদের মুখে শোভা পায় না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের তারা আশ্রয় দিয়ে খুনিদের আশ্রয় দিচ্ছে। এই যে তারা এত লম্বা কথা বলে, তাদের দেশেই খুনিরা আত্মগোপন করে থাকে। তারা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। আইনের আশ্রয়, আইনের কথা বলে তাদেরকে রক্ষা করেÑএ দুটি একসঙ্গে যায় না।
গত নির্বাচনে আপনারা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। এবার নৌকা প্রতীক না দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা নির্ভর করছে জোটের ওপর। জোটের সঙ্গে আলোচনা করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময়ে বাম দলগুলো কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে। উত্তরে প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০ বছরে বাম দলগুলোর দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে, ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে, সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়ে এবং বিএনপি-জামায়াত বিরোধী লড়াইয়ে অগ্রগামী ভূমিকা ছিল। সেই ভূমিকার মধ্য দিয়ে নিশ্চিতভাবে আমরা অনেককিছু অর্জন করতে পেরেছি।
দেখা গেছে, প্রতিটি নির্বাচনের সময় সংঘর্ষ হয়েছে। এ থেকে বেরুনোর উপায় কি? উত্তরে মেনন বলেন, সংঘর্ষ-সংঘাতকে আমরা নির্বাচন বিরোধী এবং সরকার পতনের হাতিয়ার হিসেবে মনে করি। তাদের সংঘর্ষ-সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
দেশের বাম দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য আছে। নির্বাচনে তারা কি ভূমিকা রাখতে পারে। জবাবে মেনন বলেন, ‘তারা যদি নির্বাচনে না আসে আমাদের করার কিছু নেই।’
রাজনীতিতে অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। নবীনদের বিষয়ে কিছু বলবেন? জবাবে মেনন বলেন, এখন অনেকেই রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে নবীনদের সামনে এসে দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ করতে হবে। তার মধ্য দিয়েই তারা এগিয়ে যেতে পারবে। আজকে তাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে। পৃথিবী বদলে গেছে। পৃথিবী পাল্টে গেছে। আমরা উননয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি। উন্নয়নশীল দেশের যে চ্যালেঞ্জ, আমাদের নতুন প্রজন্মকে সেই চ্যালেজ্ঞ নিয়েই আজকে এগোতে হবে। পৃথিবী এখন ডিজিটালি কেবল নয়, আর্টিফিসিয়াল ইনটিলিজেন্স পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে। এক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মকে আজকে এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিতে হবে। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ দেশকে একটি আধুনিক বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার দিকে এগুতে হবে।
বিএনপিসহ অন্যান্য দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। তাদের দাবি মানা না হলে নির্বাচনে আসবে না। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? উত্তরে তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিকভাবে তাদের জ¦ালাও-পোড়াও আন্দোলন মোকাবিলা করব। এ পর্যন্ত আমরা তাদের শান্তিপূর্ণভাবেই রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করেছি। আমাদের দল সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত রুখো, বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাস রুখো-এই স্লোগানে বাংলাদেশ দিবস পালন করেছি। মানুষকে সচেতন করেছি। বিএনপি যদি সন্ত্রাস করে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করব।