
জমি নিয়ে বিরোধ হয়ে আসছে সেই সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে। আগে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো, এখনো আছে। তবে বর্তমান সময়ে জমি নিয়ে ভাই-বোন ও প্রতিবেশীর মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়। আবার ভূমি রেজিস্ট্রেশন, নকল ওঠানো, রেকর্ড তল্লাশি ও সংশোধনের নামে ঘুষ গ্রহণ ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ ভূমি অফিসের কর্মচারীর বিরুদ্ধে বহুদিনের পুরনো। এদের পদ-পদবি ছোট হলেও অবৈধ আয়-রোজগারে এরা অনেক অর্থবিত্ত, ধনসম্পত্তির ও বাড়ি-গাড়ির মালিক। ভুল দাগ নম্বর, অযথা সময় নষ্ট, অপ্রয়োজনীয় খরচ এবং দালালের খপ্পরে পরে সর্বস্বান্ত হয়েছে এমন নজির আছে প্রচুর। অসৎ কর্মচারী সহায়তায় জমি অন্যজনের নামে রেকর্ড করা, বোনের অংশে ভাইয়ের দখলে, মামলা-মোকদ্দমা করেও সীমানা ও মালিকানার সংকট দূর হয় না এমন নানা সমস্যা যেন লেগেই আছে। এমন বাস্তবতায় কয়েক বছর পূর্বে ভূমি রেজিস্ট্রেশন বিভাগকে ডিজিটালাইজ করার উদ্যোগ নিলেও শতভাগ সেবা থেকে এখনো বঞ্চিত ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। সার্ভার, বন্ধ কম্পিউটার নষ্ট, দক্ষ অপারেটরের অভাব, অসৎ কর্মচারী দৌরাত্ম্য ইত্যাদি নানা অজুহাতে ডিজিটাল ভূমি সেবায় শুধুই হয়রানি আর ভোগান্তি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০১৭ সালের যে সার্ভার থেকে এতদিন সেবা নিশ্চিত করা হতো সেই সার্ভার থেকে এখন নতুন সার্ভারে তথ্য হস্তান্তর চলমান আছে। বর্তমানে ঢাকাসহ সারাদেশের ভূমি অফিসগুলোতে চলছে এ নিয়ে ব্যাপক অরাজকতা। পুরনো সার্ভার থেকে নতুন সার্ভারে তথ্য হস্তান্তরের কারণে মিউটেশন, খাজনা বা এলডি ট্যাক্স এবং ই-পর্চা উত্তোলনে জটিলতা তৈরি হয়েছে। ফলে জমি হাত বদল চলছে মন্থর গতিতে। ফলে শুধু জনভোগান্তিই নয়, পাশাপাশি সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। সার্ভারের এই তথ্য বিভ্রাটের কারণে দেশের একটি বড় অংশই ভূমি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে, নামজারি ও খাজনা পরিশোধ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ছেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ও বিদেশগামীরা। জটিল রোগে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তির পরিবার জমি বিক্রি করে রোগীর চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। বর্তমানে ভূমিসংক্রান্ত সেবা পেতে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় অনেকে সময়মতো জমি বিক্রি করতে পারছেন না। এ সংক্রান্ত জটিলতায় অনেকের বিদেশযাত্রা থেমে রয়েছে এবং অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না। এছাড়া খাজনা আপডেট করতে না পারায় বহু নাগরিককে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তবুও জনগণের ভোগান্তি দূরীকরণ, দুর্নীতি রোধ এবং মামলা কমানোর লক্ষ্যে সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর দেশের ২১ জেলায় একযোগে চালু হয় ডিজিটাল রেকর্ড রুম। বর্তমানে সারাদেশে এই সেবা চালু রয়েছে। এ ব্যবস্থাপনায় ঘরে বসেই নাগরিক খতিয়ানের সার্টিফায়েড কপির অথবা মৌজা ম্যাপ সংগ্রহ করা যায়। অনলাইনে ফি দেওয়ার পর নির্ধারিত সময় এবং নির্ধারিত স্থান থেকে অথবা ডাকযোগে খতিয়ানের সার্টিফায়েড কপি পাওয়া যায়। সার্ভারটিতে এ পর্যন্ত ৫ কোটি ১৩ লাখ খতিয়ান ডিজিটাইজ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬৫ লাখ নামজারি আবেদনের মধ্যে ৫৭ লাখ আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। সার্ভার সংস্কার পুরোপুরি শেষ হলে এই কাজের গতি আরও বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে এই সেবাকে আরও সহজ করতে এবং প্রান্তিক মানুষের ভূমিসেবা নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর চালু হয় ভূমিসেবা হটলাইন নাম্বার। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারে না এমন নাগরিক চাইলে ১৬১২২ এই নম্বরে কল করে প্রত্যাশিত ভূমিসেবা গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া নাগরিক সেবা প্রাপ্তিতে যে কোনো অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু এই নাম্বারে কল করে কোনো সেবা তো দূরের কথা, সামান্যতম তথ্যও সংগ্রহ করা যায় না। কৃষিজমি সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য একটি উদ্যোগ হলো ‘মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডিজিটাল ভূমি জোনিং’। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের সব মৌজায় ডিজিটাল ও স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে মানচিত্র তৈরি করে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে, যেখানে দেশের ১ লাখ ৩৮ হাজার ৪১২টি মৌজার ম্যাপ ডিজিটাইজ করার কথা। এ প্রকল্প কার্যকর হলে কার্যকর ডিজিটাল ক্যাডাস্ট্রাল ম্যাপ তৈরি হবে। ফলে এক ক্লিকেই দেখা যাবে জমির শ্রেণিবিন্যাস, বর্তমান জমির মালিকের নাম, এই জমি বিগত সময়ে কে কার কাছ থেকে হস্তান্তর করেছে তার যাবতীয় তথ্য।
ভূমি ব্যবস্থাপনায় মিউটেশন বা নামজারি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। জমি কেনা বা অন্য কোনো উপায়ে পাওয়া জমির মালিকানা পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকেই নামজারি বলে। আগে সনাতন পদ্ধতিতে করা হলেও বর্তমানে নামজারি অনলাইনে করা হয় আর এই ডিজিটাল পদ্ধতিই হলো ই-নামজারি বা ই-মিউটেশন। সারাদেশে ভূমি ই-নামজারি সেবা চালু করা হয় ২০১৯ সালের ১ জুলাই। প্রচলিত পদ্ধতিতে নামজারি নিয়ে মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানির শেষ ছিল না। ই-নামজারি মানুষের হয়রানি অনেকটাই দূর হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ৮ লাখ সুবিধাভোগী অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই ভূমি উন্নয়ন কর দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। ৩ কোটি জমির তথ্য ইতোমধ্যে ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রায় ৭০ শতাংশ নাগরিক স্বচ্ছভাবে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করেছেন। অন্তত ৫০ শতাংশ নাগরিকের হয়রানি কমেছে। প্রতিদিন ৩০-৪০ লাখ টাকা তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে। অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে জমির খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) দেওয়া যাবে। ভূমি কর দেওয়ার এ সুবিধার কারণে মানুষের ভূমিসংক্রান্ত হয়রানি কমার পাশাপাশি দুর্নীতিও কমেছে।
বর্তমান প্রশাসন দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় ভোগান্তি ও দুর্নীতি কমাতে বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত চারটি সেবাকে সংযুক্ত করে একটি আধুনিক ‘ল্যান্ড সার্ভিস গেটওয়ে’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে এসব সেবা নিতে আলাদা রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন হবে না। এই গেটওয়ে সারাদেশের সব ভূমি সার্কেলের উন্মুক্ত করা গেলে নাগরিকদের আরও সহজে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। প্রকল্পের আওতায় ঢাকা জেলার ১৯টি ভূমি সার্কেলে উন্নত ও ব্যবহারবান্ধব ই-মিউটেশন সফটওয়্যারের পাইলটিং শুরু হয়েছে এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের নেতৃত্বে চার ধরনের ভূমিসেবা অনলাইনে নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। সেবাগুলো হলো- এলডি ট্যাক্স (সারাদেশে), ই-মিউটেশন (পাইলট ফেজ, ঢাকার ১৯টি সার্কেল), ই-পর্চা (সারাদেশে), ই-খতিয়ান এবং মৌজা ম্যাপ (সারাদেশে)। এলডি ট্যাক্স সেবার মাধ্যমে এরইমধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ভূমিরাজস্ব আদায় হয়েছে। তবে যেহেতু ই-মিউটেশন বিচারিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত এবং এতে একাধিক সংস্থা ও দপ্তর সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাই এই সেবার পদ্ধতি এবং ই-নথি ব্যবস্থা সহজিকরণে আরও পর্যাপ্ত পাইলটিং প্রয়োজন। ডিজিটালাইজেশনের পরবর্তী পর্যায়ে বেসরকারি এবং ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ওয়ার্ড পর্যায়ে ভূমিসেবা উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, এক সময় ভূমিসেবা নিতে গিয়ে ঘুষ-বাণিজ্যসহ হয়রানি ও ভোগান্তির যেন শেষ ছিল না। এখন ভূমি সংক্রান্ত অনেক সমস্যা যেমন উন্নয়ন কর, ই-নামজারি, ডিজিটাল ভূমি রেকর্ড, খাসজমি বন্দোবস্ত, অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, সায়রাত মহাল ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ, ভূমি জোনিং কার্যক্রম, ভূমি রেকর্ড আধুনিকীকরণের মতো সেবা অনলাইনে সমাধান করা যাচ্ছে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে দুর্নীতি ও ভোগান্তি এখন অনেকটাই কমেছে। এর স্বীকৃতিও পেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর বাস্তবায়নের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস)’ পুরস্কার জিতেছে বাংলাদেশ। জনগণের ভোগান্তি দূরীকরণ, দুর্নীতি রোধ এবং মামলা কমানোর লক্ষ্যে সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের এই উদ্যোগ জনগণের হাতের মুঠোয় পৌঁছে যাক দ্রুত এটাই ভুক্তভোগীদের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল