ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

পথশিশুদের ভাগ্য কি বদলাবে না

হাছনুর রহমান খান

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২৪ জুন ২০২৫

পথশিশুদের ভাগ্য কি বদলাবে না

বাংলাদেশের শহর ও গ্রামীণ এলাকায় হাজার হাজার শিশু রাস্তায় ঘুমায়, কাজ করে এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। বাংলাদেশের শিশু অধিকার আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে সবাইকে সাধারণ শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে সাধারণ শিশু ও পথশিশুদের বয়সের তারতম্য না থাকলেও সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে রয়েছে বিস্তর ফারাক। এই ফারাকই একজন শিশুকে ‘পথশিশু’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই শিশুরা শৈশবের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে ওঠে। একজন শিশু কখনই পথশিশু হয়ে জন্মায় না। জন্মের পর তার পারিবারিক ও সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা একটা সময় তাকে পথশিশু হতে বাধ্য করে। একজন শিশুর ‘পথশিশু’ হয়ে বেঁচে থাকা কোনো দেশের জন্য কখনই সম্মানের হতে পারে না। এটি দেশের দায়িত্বশীলদের অক্ষমতা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতাকে প্রকাশ করে।
তবু প্রতিদিন খোলা আকাশের নিচে, রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, লঞ্চ টার্মিনালের পাশে, ফ্লাইওভারের নিচে, বাসস্ট্যান্ডে, ময়লা আবর্জনায় কিংবা রেলস্টেশনে মানবাধিকার বঞ্চিত এসব শিশু বেড়ে উঠছে। ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথভাবে তৈরিকৃত ‘স্ট্রিট সিচুয়েশন ইন বাংলাদেশ-২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩৪ লাখের বেশি মা-বাবাহীন পথশিশু রয়েছেÑ যারা অবজ্ঞা আর অবহেলায় দিন যাপন করছে। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, সভ্য সমাজে কিভাবে শিশুরা পথশিশুতে পরিণত হচ্ছে? এরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না, অনেক সময় তাদের ময়লা বাসি কিংবা খাওয়ার অযোগ্য খাবারও খেতে হয়।
ফলে বেশির ভাগই চরম পুষ্টিহীনতায় ভোগে। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে তারা ভিক্ষাবৃত্তি, চায়ের দোকান, কল-কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বর্জ্য সংগ্রহ, ফুল বিক্রিসহ বিভিন্ন রকম কাজ করে এবং কর্মক্ষেত্রে তারা প্রতিনিয়ত শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এক গবেষণায় দেখা যায়, পথশিশুদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে আটজনই বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয় মেয়ে পথশিশুরা। মেয়ে শিশুদের প্রায় ৪৬ ভাগই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।
অনেক শিশু জীবনযাপনের জন্য চুরি করে, বিভিন্ন কিশোর গ্যাং কিংবা কোনো অপরাধগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে সমাজের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের দিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করায়। ফলে সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করে। এছাড়া দেশের পথশিশুদের অর্ধেকই মাদকাসক্ত। তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় জড়িয়ে যায় মাদকে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পথশিশুদের অর্ধেকের বয়স ১০-এর নিচে। এসব পথশিশুর মধ্যে ৯৫ শতাংশ মাদক সেবন করে। সহজলভ্যতা ও দামের স্বল্পতার কারণে পথশিশুরা ড্যান্ডি ও গাঁজা সেবন করে। অল্প খরচ ও সহজে পাওয়া যায় বলে অধিকাংশ পথশিশুর কাছে ড্যান্ডি খুব জনপ্রিয় একটি মাদক। ড্যান্ডি মূলত এক ধরনের আঠা। ‘ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ’ বা ‘ড্যান্ড্রাইট’ নামের আঠাটিকেই মাদকসেবীরা ‘ড্যান্ডি’ বলে থাকে। প্রায়ই দেখা যায়, তারা ফোলানো পলিথিনের মধ্যে নাক ঢুকিয়ে সেই আঠা শোঁকে।
পথশিশুদের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। পথশিশুদের কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কাজ করছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা বেশ অপ্রতুল। কোনো উদ্যোগই টেকসই নয় বরং তা পথশিশুদের সাময়িক কষ্ট লাঘব করলেও দিনশেষে তাদের আবার পথে ফিরে যেতে হয়। এক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানবিক চেতনার উন্নয়ন ঘটানো বিশেষ প্রয়োজন।
পরিবারের দরিদ্রতা ও কাজের অভাবের কারণে শিশুরা পথে নেমে কাজ করতে বাধ্য হয়। এতে তাদের শৈশব হারিয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ এসব শিশুকে কাজে নিতে চায় না। ফলে বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকতে তারা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। শিশুদের যাতে কাজে না যেতে হয় সেজন্য পিতামাতার জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ আরও জাগ্রত করতে হবে। পরিবার প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ স্থান। কিন্তু এই পরিবারেই যদি শিশুরা অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এজন্য পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করতে হবে। সন্তানকে ভালোবাসতে হবে। সুশিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে।
সামাজিক বৈষম্য ও মূল্যবোধের অভাবে দিন দিন পথশিশুদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। শিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে দেওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। সামাজিকভাবে সবাইকে এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পর্যন্ত পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো বাস্তবিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। ‘পথশিশু কল্যাণ ট্রাস্টের’ মাধ্যমে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সেগুলো তেমন একটা আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তো আছেই।
রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে বর্তমানে দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের নানারকম সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। বিগত যে কোনো সরকারের তুলনায় এই সরকারের কাছে পথশিশুদের নিয়ে বেশি প্রত্যাশা করাই যেতে পারে। কেননা, প্রধান উপদেষ্টাসহ এই সরকারের অনেকেই দরিদ্রতা দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা আছেন। পথশিশুরাও দেশের সম্পদ। তারাও দেশের বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। তাদের মেধা ও বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে দেশকে আরও উন্নতির দিকে নেওয়া সম্ভব। তাই এসব শিশুকে বোঝা না বানিয়ে দেশ গঠনে তাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। কথায় আছে, ‘আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ’। এই কথাটি পথশিুদের বেলায় যেন বেমানান। কেননা তাদের ক্ষেত্রে জন্মের পর একমাত্র ভবিষ্যৎ হচ্ছে শুধুই অপমৃত্যু। তাই নতুন করে যেন আর কোনো পথশিশু তৈরি না হয় সেজন্য সম্মিলিতভাবে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে।

লেখক : উন্নয়নকর্মী

প্যানেল

×