
বাংলাদেশের শহর ও মফস্বলজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং প্রতিদিনের অনিবার্য আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মোহাম্মদপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের নানা প্রান্তে কিশোর গ্যাংয়ের হিংস্রতা ও অপরাধপ্রবণতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। শুধু অপরাধের সংখ্যা নয়, অপরাধের ধরন, বিস্তার এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়ায়ও এসেছে গভীর পরিবর্তন। সর্বশেষ সরকারি ও সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, সদস্যসংখ্যাও দ্বিগুণের কাছাকাছি। এই প্রবণতা আমাদের সমাজের জন্য নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ: আতঙ্কের বাস্তবতা
২০২৫ সালের মে মাসের মাঝামাঝি রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার জাফরাবাদ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের চাপাতির কোপে একই পরিবারের ছয়জন গুরুতর আহত হয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, রাতের গভীরে বাড়িতে হামলা চালিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হয় পরিবারের সদস্যদের, যার মধ্যে একজনকে আইসিইউতে ও তিনজনকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। একই সময়ে কুমিল্লা নগরীতে প্রকাশ্যে ২০০-২৫০ জন কিশোর অস্ত্র হাতে মহড়া দেয়, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে বলে খবর মিলেছে।
আশার বিষয় হলো, সম্প্রতি পুলিশ ও র্যাবের যৌথ অভিযানে দুই দিনে ২৮ জন কিশোর গ্যাং সদস্য, অস্ত্র সরবরাহকারী ও শেল্টারদাতা গ্রেপ্তার হয়েছে। আবার, মোহাম্মদপুরে ‘লও ঠেলা’ গ্যাংয়ের ৯ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে চাপাতি ও ধারালো অস্ত্রসহ। সর্বশেষ, ২১ মে রাতে মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার ও আশপাশের এলাকায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৫৭ জন কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে, যাদের মধ্যে কুখ্যাত ‘পাটালি গ্রুপ’-এর ৪৪ জন রয়েছে।
এসব ঘটনা নিছক বিচ্ছিন্ন নয়। বরং, দেশের প্রায় প্রতিটি শহর ও বড় উপজেলা এখন কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ঢাকায় অপরাধে জড়িতদের ৪০ শতাংশই কিশোর এমন তথ্যও উঠে এসেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোহাম্মদপুরে মাদকবিরোধী অভিযানে পুলিশের ওপর কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় চার পুলিশ সদস্য আহত হন। হাতিরঝিলে কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গুলিবিনিময়ে পথচারী ও কিশোর আহত হন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, খুন, ধর্ষণ, সাইবার অপরাধসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোরেরা।
পরিসংখ্যান ও বিস্তার: উদ্বেগজনক বাস্তবতা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ২০২৪ সালে ছিল ২৩৭টি, সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় ২,৩৮২ জন। ২০২২ সালে গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ১৭৩টি, সদস্য ছিল প্রায় ১,০০০ জন। অর্থাৎ, মাত্র দুই বছরে গ্যাংয়ের সংখ্যা বেড়েছে ৩৭ শতাংশ এবং সদস্য বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ। ঢাকায় সক্রিয় গ্যাংয়ের সংখ্যা ১২৭টি, চট্টগ্রামে ৫৭টি এবং দেশের অন্যান্য বড় শহর ও মফস্বলে আরও অনেক গ্যাং রয়েছে। রাজধানীতে গ্যাং সদস্যদের সংখ্যা এখন প্রতিটি থানা এলাকায় ৫০০ থেকে ১,০০০ জনের মধ্যে।
ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ৪০ শতাংশই কিশোর, এ তথ্য শুধু আতঙ্কের নয়, বরং সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগের কারণ। পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৩ সালে ৫৮৯ জন কিশোর অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছিল, ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৫৯৬ জনে। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অপরাধের ধরন ও কৌশল: আধুনিকতা ও সহিংসতার মিশেল
কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের ধরন দিন দিন আরও ভয়ংকর ও আধুনিক হচ্ছে। শুধু ছিনতাই, চাঁদাবাজি বা মাদক কারবার নয়, এখন তারা প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, ককটেল বিস্ফোরণ, গুলিবিনিময়, সাইবার অপরাধ, নারী পাচার, এমনকি খুন-ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। টিকটক, ফেসবুক, লাইকি, ইমো এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করে তারা নিজেদের ‘তারকা’ বানানোর প্রতিযোগিতায় নামে, ভিডিও ভাইরাল করার জন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে দেয়। অনেক সময় এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কিশোরী মেয়েদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানো, এমনকি বিদেশে পাচার করার ঘটনাও ঘটছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দল বেঁধে আড্ডা দেয়, উচ্চ শব্দে গান বাজায়, বাইক রেসিং করে, পথচারী ও সাধারণ মানুষকে উত্ত্যক্ত করে। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে এক গ্যাং আরেক গ্যাংয়ের ওপর হামলা চালায়, যা প্রায়ই প্রাণঘাতী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এসব কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ, পথচারী, এমনকি পুলিশও আহত হচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজেদের ‘বড় ভাই’ বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকের ছত্রছায়ায় নিরাপদ বোধ করে, যা তাদের অপরাধপ্রবণতাকে আরও উৎসাহিত করে।
মূল কারণ: সমাজ, রাজনীতি ও পরিবারের ব্যর্থতা
বিশ্লেষকরা মনে করেন, কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান ও বিস্তারের পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, পারিবারিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার, রাজনৈতিক আশ্রয়—সবকিছু মিলেই এই সংকটকে গভীরতর করেছে। অনেক সময় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি বা প্রভাবশালীরা কিশোর গ্যাংকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন, তাদের অপরাধকে প্রশ্রয় দেন। নির্বাচন, জমি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার—এসব কাজে কিশোরদের ‘মাসল পাওয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পরিবারের ভাঙন, অভিভাবকদের উদাসীনতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নজরদারির অভাব, সমাজের নৈতিক অবক্ষয়—এসবও কিশোরদের অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। অনেক সময় কিশোররা নিজের পরিচয়, আত্মসম্মান, সামাজিক স্বীকৃতি বা অর্থের জন্য গ্যাংয়ে জড়ায়। মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা ও গাঁজার সহজলভ্যতা, তাদের অপরাধপ্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আইন ও প্রশাসনিক উদ্যোগ: সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চালালেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। মোহাম্মদপুর, কুমিল্লা, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেপ্তার হলেও কয়েকদিন পরই তারা জামিনে বের হয়ে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। প্রচলিত শিশু আইন অনুযায়ী কিশোর অপরাধীদের সংশোধনাগারে পাঠানো হলেও তারা কতটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নিরুপায় হয়ে পড়ে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কিশোর গ্যাং দমনে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ সিটিজেন কমিটি গঠনের উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ: অস্থিরতা ও আশার সন্ধান
কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডবে সমাজে চরম অস্থিরতা ও অনিরাপত্তা তৈরি হয়েছে। সন্ধ্যার পর রাজধানীর অনেক এলাকায় সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পান। ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ, শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত, অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক সময় নিরুপায়। সমাজবিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, আজকের কিশোর অপরাধী আগামী দিনের বড় অপরাধী হয়ে উঠতে পারে, যা দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে দেবে।
তবে আশার কথা, সমাজের নানা স্তরে সচেতনতা বাড়ছে। অনেক এলাকায় অভিভাবক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও তরুণ সমাজ একত্রিত হয়ে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছেন। কিছু এলাকায় সিটিজেন কমিটি গঠন, স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক কর্মসূচি, মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে এসব উদ্যোগ এখনও পর্যাপ্ত নয়, প্রয়োজন আরও বিস্তৃত ও সমন্বিত প্রয়াস।
এখনই সময়, নইলে দেরি হয়ে যাবে
বাংলাদেশের কিশোর গ্যাং সমস্যা এখন আর শুধু আইন-শৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি সমাজ, রাষ্ট্র ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমোচনীয় সংকেত। অপরাধের সংখ্যা, বিস্তার ও ধরন সবদিক থেকেই পরিস্থিতি ভয়াবহ। কিশোরদের অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে যে বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে, তা সমাধানে প্রয়োজন সমাজ, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মিলিত উদ্যোগ। শুধু গ্রেপ্তার, অভিযান বা আইন দিয়ে এই সংকটের সমাধান হবে না, প্রয়োজন কিশোরদের জন্য নিরাপদ, সৃজনশীল ও মানবিক বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করা।
রাজনৈতিক স্বার্থে কিশোরদের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, পরিবারকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নজরদারি ও নৈতিক শিক্ষায় জোর দিতে হবে, সমাজকে মাদক ও অপরাধমুক্ত রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই কিশোরদের জন্য আধুনিক ও কার্যকর সংশোধনাগার, কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে কিশোর গ্যাং দমনে কঠোর হতে হবে।
আজকের কিশোরদের সঠিক পথে না আনতে পারলে আগামী দিনের বাংলাদেশ আরও অস্থির ও অনিরাপদ হয়ে উঠবে এ সত্য অনুধাবন করে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ, বিশেষ করে অভিভাবক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোর গ্যাংয়ের তাণ্ডব থামাতে না পারলে আমাদের সামাজিক বন্ধন, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সবই হুমকির মুখে পড়বে। সময় এখনও আছে, কিন্তু খুব বেশি নেই। এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে দেরি হয়ে যাবে।
মিমিয়া