
বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব যেন আটকে থাকা একটি হৃৎপিণ্ড, যা বন্ধ হয়ে গেলে পুরো বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারেই প্রায় অন্ধকার নেমে আসে। বিশ্বের মোট জীবাষ্ম জ¦ালানি বা অপরিশোধিত তেলের অন্তত ২১ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ পরিমাণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রতিদিন এই সংকীর্ণ জলপথ ধরে পরিবহন হয়। এখন মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা যতই নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, বিশেষভাবে ইরান-ইসরাইল সংঘাতের আবহে; তখন হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। হরমুজ প্রণালী বিশ্ব জ্বালানিবাহী তেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট, যার মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বিশ্বের সমুদ্রে পরিবাহিত তেলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বিশেষত সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য একটি প্রধান রপ্তানি পথ। সংঘাত গুরুতর রূপ নিলে হরমুজ প্রণালী সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। যার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম হঠাৎ করে ব্যারেলপ্রতি ১৫০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধপরবর্তী ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও ওপেক প্লাসের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশের মতো জ¦ালানি আমদানিনির্ভর উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এটি হবে বহুমাত্রিক এক ধাক্কা। কারণ বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল এবং আন্তর্জাতিক মূল্যে তেলের দাম বাড়লে শুধু আমদানি ব্যয়ই বাড়বে না, বরং তাৎক্ষণিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ তৈরি করবে, যার প্রভাব সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা খাতে গিয়ে পড়বে।
মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করে, যা হরমুজ প্রণালী হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এই পথ দিয়ে যায়, যার ৭০ শতাংশই যায় দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোও সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। তাই হরমুজ প্রণালীতে কোনো বিঘ্ন ঘটলে, এসব দেশের তেলবাজারে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর এলএনজি রপ্তানির বড় অংশও এই পথেই পরিবাহিত হয়। ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক তেলবাজারে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। তেলের দাম সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে দেখা গেছে। আবার রেড সি এবং আরব সাগরের পথও ঝুঁকিমুক্ত নয়।
এমন এক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হরমুজ প্রণালী পথের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে, এখান দিয়ে কোনো ধরনের সরবরাহ বিঘ্নিত হলেই দেশের অর্থনীতির প্রতিটি স্তম্ভ কেঁপে ওঠে। বাংলাদেশের মোট তেল ও এলএনজি আমদানির ৮৫ শতাংশেরও বেশি আসে হরমুজ প্রণালী দিয়ে। অর্থাৎ, এখানকার কোনো সংকট মানে জাতীয় জ্বালানি বাজারে তাৎক্ষণিক চাপ, বাড়তি খরচ ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা। সম্প্রতি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, এপ্রিলের শুরুতে প্রতি ব্যারেল ৭২.৫০ ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে জুনের মাঝামাঝি সময়ে ৮৩.৭৫ ডলারে উঠে এসেছে। আর যদি এই প্রণালী সম্পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তেলের দাম একলাফে ১২০ ডলারের ওপরে উঠে যেতে পারে। এমনটি হলে বাংলাদেশের বার্ষিক তেল আমদানি খরচ ৫.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই বাড়তি খরচের বোঝা সরাসরি গিয়ে পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের কাঁধে। দু-তিন বছর ধরে ৮-৯ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতিসহ নানা ক্ষয়ক্ষতির প্রভাবে গত ৬ মাসে অন্তত ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এ অবস্থায় হরমুজ প্রণালীর বন্ধ হয়ে নিশ্চিতভাবেই যাওয়া বাংলাদেশকে গুরুতর আর্থিক সংকট সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ইতোমধ্যে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম এই হারে বাড়তে থাকলে শীঘ্রই দেশে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি লিটারে ৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে যদি হরমুজ প্রণালী দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকে এবং বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়, তাহলে দেশে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৬ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এতে শুধু জাতীয় বাজেটেই ২-২.৫ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ যোগ হবে না, একই সঙ্গে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ০.৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে, যার প্রভাব পড়বে শিল্প, পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ অর্থনীতির প্রতিটি স্তরে। এর মূল কারণ দীর্ঘ সময় ধরে নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতায় বিদ্যুৎ ও শক্তি উৎপাদনে আমদানিকৃত তেল ও এলএনজির ওপর বাংলাদেশের পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়া, যা এখন অর্থনীতির জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি সংকট ও দীর্ঘ লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইলসহ শক্তিনির্ভর শিল্পখাত, যেখানে উৎপাদন ৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পরিবহন ও কারখানার খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিও ৩-৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে, কর্মসংস্থান অনেক হ্রাস পেতে পারে। বাংলাদেশে সাধারণত ৩৫-৪০ দিনের জন্য, অর্থাৎ প্রায় ৪ লাখ টন তেলের মজুত থাকে। এরচেয়ে খূব বেশি মজুত করার সক্ষমতা দেশের নেই। এখন হরমুজ প্রণালী যদি দুই মাসের জন্য বন্ধ যায়, তাহলে কমপক্ষে ৮-১২ লাখ টন অপরিশোধিত তেলের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। সঙ্গে ৮টি এলএনজি কার্গো হারানোর ঝুঁকি আছে। এই অবস্থা গৃহস্থবাড়ি ও শিল্পখাত, দুটির জন্যই মারাত্মক সংকট বয়ে আনবে। আবার জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে বিকল্প হিসেবে দীর্ঘ রুট নিতে বাধ্য হলে পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এই অঞ্চলে জাহাজ চলাচলের বিমা প্রিমিয়াম ইতোমধ্যেই তিনগুণ বেড়েছে। অতীতে রেড সি জলপথে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলার সময়ও সরবরাহ চেইনে অল্প সময়ের বিঘ্নেই দ্রব্যমূল্য হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। অবশ্য বাংলাদেশ এই সংকটে একা নয়; ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো অন্য দেশগুলোও একই ঝুঁকিতে আছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাসের ওপর বাংলাদেশের উচ্চ নির্ভরতার কারণে প্রভাব এখানে সবচেয়ে বেশি হবে। শিপিং খাতের বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করেছেন, হরমুজ প্রণালীতে কোনো রকম বিঘ্ন, হামলা বা অবরোধ হলে পরিবহন খরচ, জ্বালানি সংকট এবং মূল্যস্ফীতি বাড়বেই।
বাংলাদেশ আমদানি করা তেল, এলএনজি ও কয়লার ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। এই নির্ভরতার কারণেই হুমকি বেশি। হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের মোট অপরিশোধিত তেলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ পরিবাহিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো এখান দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি রপ্তানি করে। উত্তরে ইরান, দক্ষিণে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত- এই প্রণালী পারস্য উপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই মুহূর্তে, শুধু সামরিক নয়, এক অর্থনৈতিক যুদ্ধও ঘনীভূত হচ্ছে। এই সংকটের কারণে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বব্যবস্থাই অস্থির-অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের বার্ষিক অপরিশোধিত তেল আমদানির প্রায় ১৪ লাখ টন, বেশিরভাগ আসে সৌদি আরব ও আবু ধাবি থেকে। বছরে মোট চাহিদা ৭.২ মিলিয়ন টন, যার প্রধান অংশ ডিজেল। শুধু অপরিশোধিত তেল নয়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তিতে পরিশোধিত তেলও আসে। দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত হলে দেশের জ্বালানি সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শিপিং খাতের আশঙ্কা, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বা এ অঞ্চলে সংঘাত বাড়লে, জ্বালানি আমদানিতে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটবে। দুই দেশের সামরিক সংঘাতের প্রাথমিক স্তরে ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক তেলের দাম ৭ শতাংশেরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। অবকাঠামো বা বাণিজ্যিক জাহাজ লক্ষ্যবস্তু হলে তার প্রভাব শেষ পর্যন্ত সাধারণ ভোক্তাদের ওপরই পড়বে। এই সংকটের ফলে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজি আমদানিতেও বিঘ্ন ঘটবে। যার ফলে শিল্প উৎপাদন, পরিবহন খরচ ও সর্বোপরি সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে এটি বাংলাদেশের জন্য সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জ্বালানি সংকট হয়ে দাঁড়াবে। দেশের আমদানিকৃত তেল ও এলএনজির ওপর নির্ভরতা এতটাই বেশি যে, দীর্ঘমেয়াদি বিঘ্ন একের পর এক অর্থনৈতিক ঝুঁকি ডেকে আনবে-মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, শিল্প উৎপাদনে হ্রাস, ব্যাপক বিদ্যুৎ ঘাটতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় চাপ তৈরি হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে বিকল্প উৎস ও সরবরাহ চেইন নিশ্চিত করা, সংকট মোকাবিলায় সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। কারণ, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি কেবল চাপেই নয়, দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার মধ্যেও পড়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক ওআইএমএফ পূর্বাভাস অনুযায়ী, জ্বালানি বাজারে একটি বড় ধরনের ধাক্কা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হারকে ১.২-১.৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে, যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের ৬.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। হরমুজ প্রণালীতে সামরিক বা কূটনৈতিক জটিলতা শুধু একটি জলপথগত প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং তা বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক বহুমাত্রিক সংকট ডেকে আনবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল