ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ॥ শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যৎ

কর্নেল আবু মোহাম্মদ সিদ্দিক আলম

প্রকাশিত: ১৯:৩৩, ১৯ জুন ২০২৫

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ॥ শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যৎ

একবিংশ শতাব্দীর এই প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের পদচিহ্ন রাখছে এবং শিক্ষা খাতও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করি, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই প্রযুক্তি শিক্ষকদের প্রতিস্থাপন করবে নাকি তাদের ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে- এই প্রশ্নটি এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষার্থীর সংখ্যাধিক্য এবং উপকরণের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং শিক্ষার নতুন দিগন্ত

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষাদান, শেখার প্রক্রিয়া এবং মূল্যায়নে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। এটি শিক্ষকদের প্রশাসনিক কাজের বোঝা কমিয়ে তাদের শিক্ষাদানে আরও বেশি মনোযোগ দিতে সাহায্য করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা বিভাগগুলো নাগরিকদের নিরাপদে এবং কার্যকরভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বসবাস ও কাজ করার জন্য প্রস্তুত করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। একইসঙ্গে তারা অনুসন্ধান করছে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষাগত সমতা বাড়াতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের ফলাফলের উন্নতি ঘটাতে পারে। বিশাল পরিমাণ ডাটা বিশ্লেষণ, ব্যক্তিগতকৃত শেখার উপকরণ তৈরি এবং প্রাকৃতিক ভাষার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার ক্ষমতাসহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সুযোগ প্রদান করে। এটি শিক্ষাকে কেবল শ্রেণিকক্ষের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একটি উন্মুক্ত এবং অ্যাক্সেসযোগ্য পদ্ধতিতে রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি করে।

ব্যক্তিগতকৃত শেখার অভিজ্ঞতা: (AI)-এর 
প্রধান অবদান

শিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ সুবিধাগুলোর মধ্যে একটি হলো ব্যক্তিগতকৃত শিক্ষার অভিজ্ঞতা (Personalized Learning Experiences) প্রদানের ক্ষমতা। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাদান পদ্ধতিতে একজন শিক্ষককে একসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীর বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে হয়, যা প্রায়ই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরন, শক্তি, দুর্বলতা এবং গতি বিশ্লেষণ করতে পারে। এই ডাটার ওপর ভিত্তি করে, AI-চালিত টুলগুলো কাস্টমাইজড শেখার বিষয়বস্তু তৈরি করতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের নিজস্ব গতিতে শিখতে এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী অনুশীলন করতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি AI টিউটরিং সিস্টেম একজন শিক্ষার্থীর নির্দিষ্ট ভুলগুলো শনাক্ত করতে পারে এবং সেই ভুলগুলো সংশোধনের জন্য অতিরিক্ত অনুশীলন বা ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে। এটি শিক্ষকদের জন্য সময় বাঁচায় এবং শিক্ষার্থীদের আরও কার্যকরভাবে শিখতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রায়ই বেশি (যেমন, প্রতি ৩১ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক), সেখানে ব্যক্তিগতকৃত শেখার ব্যবস্থা শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা সমাধানের পথ দেখাতে পারে। এটি গ্রামাঞ্চল এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে যোগ্য শিক্ষক এবং সম্পদের অভাব রয়েছে। AI এখানে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি পূরণ করতে না পারলেও বিদ্যমান সম্পদকে সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবে যেখানে তারা তাদের নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী শিখতে পারবে, যার ফলে শেখার প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের আগ্রহ এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি  পাবে।

শিক্ষকদের জন্য প্রশাসনিক ও শিক্ষাদান 
সহায়ক AI

শিক্ষকদের দৈনন্দিন কাজের একটি বড় অংশ প্রশাসনিক দায়িত্বে ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ট্র্যাকিং, গ্রেডিং, সময়সূচি তৈরি এবং ডাটা ব্যবস্থাপনার মতো কাজগুলো সময়সাপেক্ষ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই ধরনের কাজগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করতে পারে, যা শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আরও অর্থপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া এবং সৃজনশীল শিক্ষাদানের উপর মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করে।
স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়ন: AI তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাসাইনমেন্ট এবং পরীক্ষাগুলোর মূল্যায়ন করতে পারে এবং ব্যক্তিগতকৃত প্রতিক্রিয়া প্রদান করতে পারে, যা শিক্ষকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় বাঁচায়। বিশেষ করে বহু-নির্বাচনী বা নির্দিষ্ট-প্রশ্নের ক্ষেত্রে অও দ্রুত ও নির্ভুলভাবে মূল্যায়ন করতে পারে। 
শিক্ষাদান পরিকল্পনা: AI শিক্ষকদের পাঠ পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করতে পারে, তাদের সময় বাঁচায় এবং নতুন ও উদ্ভাবনী শিক্ষাদান কৌশল খুঁজে পেতে উৎসাহিত করে। এটি বিভিন্ন শিক্ষাদান পদ্ধতির ডাটা বিশ্লেষণ করে শিক্ষকদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতিগুলো সুপারিশ করতে পারে, যা ক্লাসরুমে আরও গতিশীলতা আনবে।
শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ: AI-চালিত সরঞ্জামগুলো শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি ট্র্যাক করতে, তাদের ব্যস্ততা পর্যবেক্ষণ করতে এবং যেসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে, সে ক্ষেত্রগুলো শনাক্ত করতে সহায়তা করে। এর ফলে শিক্ষক সুনির্দিষ্টভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। যদি কোনো শিক্ষার্থী একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বারবার ভুল করে, AI সেই প্যাটার্নটি শনাক্ত করে শিক্ষককে সতর্ক করতে পারে, যাতে শিক্ষক সময়মতো প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারেন।
পাঠ্যক্রমের উন্নতি: AI সিস্টেমগুলো শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষমতা, শেখার শৈলী, পরীক্ষার স্কোর এবং এমনকি আচরণ সম্পর্কিত ডাটা প্রক্রিয়া করতে পারে। এই তথ্যের ভিত্তিতে, AI শিক্ষকদের কার্যকর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারে, যেমন কোন শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত সাহায্যের প্রয়োজন, কোন পাঠগুলো সবচেয়ে কার্যকর, এবং কোথায় পাঠ্যক্রমের সমন্বয় করা প্রয়োজন। এটি একটি ডাটা-চালিত পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষাকে আরও কার্যকর করতে সাহায্য করে।
শিক্ষার্থীদের জন্য রিসোর্স সুপারিশ: AI শিক্ষার্থীদের শেখার প্রোফাইল এবং পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অতিরিক্ত রিসোর্স, যেমন ভিডিও, নিবন্ধ, অনলাইন কোর্স বা অনুশীলন সামগ্রী সুপারিশ করতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য শেখার উপকরণ খুঁজে পেতে সময় বাঁচায় এবং তাদের আগ্রহ অনুযায়ী শিখতে উৎসাহিত করে।
এই সহায়ক ভূমিকাগুলো শিক্ষকদের কাজের চাপ কমিয়ে তাদের পেশাগত সন্তুষ্টি বাড়াতে পারে। ফলস্বরূপ, শিক্ষকরা তাদের মূল ভূমিকায়, অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান, পরামর্শ দান এবং তাদের মধ্যে কৌতূহল ও সৃজনশীলতা জাগ্রত করার দিকে আরও বেশি সময় দিতে পারবেন। এটি শিক্ষকদের আরও বেশি মানবিক এবং সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করবে, যা একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য।

শিক্ষার সমতা এবং অ্যাক্সেসিবিলিটি বৃদ্ধিতে AI

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে এবং সবার জন্য উচ্চ-মানের শিক্ষার প্রবেশাধিকার বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। অনগ্রসর এবং গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীরা প্রায়ই পর্যাপ্ত শিক্ষক বা উপকরণের অভাবে ভোগে। AI-চালিত ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, ইন্টেলিজেন্ট টিউটরিং সিস্টেম এবং অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো এই ফাঁকগুলো পূরণ করতে পারে।
২৪/৭ শেখার সহায়তা: AI-চালিত চ্যাটবট এবং ভার্চুয়াল সহায়কগুলো শিক্ষার্থীদের ২৪/৭ শেখার সহায়তা প্রদান করতে পারে, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এবং অধ্যয়নে সহায়তা করতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের তাদের নিজস্ব সময় এবং গতিতে শিখতে সক্ষম করে, যা ঐতিহ্যবাহী ক্লাসরুম সেটিংসে সম্ভব নয়।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য: AI বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও অ্যাক্সেসযোগ্য করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য স্বয়ংক্রিয় সাবটাইটেল তৈরি করতে পারে বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যকে অডিওতে রূপান্তর করতে পারে। AI এমন শিক্ষার্থীদেরও সমর্থন করতে পারে যাদের শনাক্ত করা হয়নি এমন শেখার ঘাটতি রয়েছে বা যারা চিকিৎসা বা সামাজিক পরিস্থিতির কারণে নতুন শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এটি পাঠ্যক্রমকে তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নিতে পারে, যা তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে।
ভাষার বাধা অতিক্রম: বহুভাষিক পরিবেশে AI ভাষার বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করতে পারে। এটি বিভিন্ন ভাষায় শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু অনুবাদ করতে পারে, যা বিভিন্ন ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের জন্য শেখার সুযোগ উন্মুক্ত করবে।

চ্যালেঞ্জ এবং নৈতিক বিবেচনা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শিক্ষায় একীভূতকরণ অসংখ্য সুযোগ নিয়ে এলেও, কিছু চ্যালেঞ্জ এবং নৈতিক বিবেচনাও রয়েছে যা সমাধান করা প্রয়োজন।
ডাটা গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা: AI সিস্টেমগুলো প্রায়ই বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল শিক্ষার্থী ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। এই ডাটার গোপনীয়তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাটা লঙ্ঘনের ঘটনা শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত জীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর ডাটা সুরক্ষা নীতি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে।
অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত: AI সিস্টেমগুলো বিশাল ডাটাসেটের ওপর প্রশিক্ষিত হয়। যদি এই ডাটাসেটে কোনো পক্ষপাত থাকে, তবে AI সিস্টেমও পক্ষপাতমূলক ফলাফল তৈরি করতে পারে, যা শিক্ষাগত বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি AI সিস্টেম প্রাথমিকভাবে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ডাটার ওপর প্রশিক্ষিত হয়, তবে এটি অন্য জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য কম কার্যকর হতে পারে। এই পক্ষপাত শনাক্ত এবং সংশোধন করা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলা ভাষার জন্য AI টুলসের অভাব: বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ AI টুলস ইংরেজি ভাষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। বাংলা ভাষার জন্য উন্নতমানের AI টুলস এবং ডাটাসেটের অভাব বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় AI এর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। স্থানীয় ডেভেলপারদের এ দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

শিক্ষকতা পেশার রূপান্তর, প্রতিস্থাপন নয়

সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি শিক্ষকদের প্রতিস্থাপন করবে? উত্তরটি হলো, না, তবে এটি শিক্ষকতা পেশাকে রূপান্তরিত করবে। AI পুনরাবৃত্তিমূলক এবং সময়সাপেক্ষ কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করে শিক্ষকদের আরও সৃজনশীল, মানবিক এবং কৌশলগত ভূমিকার দিকে স্থানান্তরিত করতে পারে। শিক্ষকরা আর কেবল তথ্য প্রদানকারী হিসেবে থাকবেন না, বরং তারা হবেন সুবিধাদানকারী (facilitators), পরামর্শদাতা (mentors) এবং অভিভাবক (guides)।
ভবিষ্যতে, শিক্ষকরা AI-এর সাহায্যে শিক্ষার্থীদের শেখার পথকে আরও ব্যক্তিগতকৃত, আকর্ষণীয় এবং কার্যকর করে তুলবেন। তারা প্রতিটি শিক্ষার্থীর শক্তি এবং দুর্বলতা সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবেন এবং সেই অনুযায়ী তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিকে খাপ খাইয়ে নেবেন। শিক্ষার্থীরা AI-এর মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার পাবে, কিন্তু শিক্ষকরা তাদের এই বিশাল তথ্য সমুদ্রের মধ্যে জ্ঞানকে অর্থপূর্ণভাবে সংগঠিত করতে এবং সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবেন।
সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা: AI বিষয়বস্তু তৈরি করতে পারলেও, সৃজনশীলতা, জটিল সমস্যা সমাধান এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার জন্য এখনো মানব মস্তিষ্কের প্রয়োজন। শিক্ষকরা এই উচ্চতর দক্ষতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন, যা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য অত্যাবশ্যক।
নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা: AI নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ বা আবেগিক বুদ্ধিমত্তা শেখাতে পারে না। এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করবেন, যা তাদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে AI এবং 
শিক্ষকের ভূমিকা

সরকার এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই AI-এর ব্যবহার সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে হবে, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নত করতে হবে। বাংলা ভাষার জন্য AI টুলস তৈরির দিকেও নজর দিতে হবে, যা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় AI এর একীভূতকরণকে ত্বরান্বিত করবে। শিক্ষকরাও এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে, নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং AI-কে তাদের শিক্ষাদানের একটি শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে। 

উপসংহার

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করতে যাচ্ছে, তবে শিক্ষকদের প্রতিস্থাপন করে নয়, বরং তাদের ক্ষমতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে। ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থা হবে একটি মানব-AI  সহযোগিতামূলক মডেল (Human-AI Collaborative Model), যেখানে শিক্ষকরা তাদের মানবিক গুণাবলী, সহানুভূতি এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার দক্ষতা নিয়ে কাজ করবেন, আর AI পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করবে এবং ডাটা-ভিত্তিক অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করবে। এটি শিক্ষকদের সময় বাঁচাবে এবং তাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে, যা শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করবে।
এই রূপান্তর সফল করতে হলে আমাদের শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং নৈতিক ব্যবহারের জন্য স্পষ্ট নির্দেশিকা প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে এটি শিক্ষকদের আরও কার্যকর, সৃজনশীল এবং ফলপ্রসূ হতে সাহায্য করবে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য আরও সমৃদ্ধ এবং ব্যক্তিগতকৃত শেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে। এটি কেবল একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লব নয়, এটি শিক্ষার একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করার সুযোগ পাবে এবং একটি উন্নত, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে। শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যৎ AI-এর সঙ্গে একীভূত হয়ে আরও শক্তিশালী এবং অর্থবহ হবে, যা মানবজাতির সার্বিক কল্যাণে অবদান রাখবে।

লেখক : সেনা কর্মকর্তা

প্যানেল

×