
ইসলাম কেবলমাত্র কিছু আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর ধর্ম নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। ইসলামে জ্ঞানের প্রধান উৎস হলো আল কুরআন, যা সৃষ্টিকুলের আদি উৎস থেকে যত আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কিতাব। যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল ধরার বুকে পথহারা মানব জাতিকে পথ দেখাতে আলো ছড়াতে এসেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় দেড় হাজার বছর আগে, আরবের মরুভূমি মক্কায় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে, বিশ্ব মানবতার মুক্তির মহান দিশারি, সর্বকালের সর্বযুগের মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন হয়। তিনি তার হায়াতে জিন্দেগির ৬৩ বছরের জীবনে মানব জাতির উদ্দেশে যা কিছু বলেছেন, করেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন কিংবা মৌন সমর্থন জুগিয়েছেন তার সবই বিশ্ব দরবারে হাদিস শাস্ত্র হিসেবে পরিচিত। অসংখ্য হাদিস গ্রন্থের মধ্যে বোখারী, মুসলিম, নাসাঈ, তিরমিজি, আবুদাউদ, ইবনে মাজাহ, বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ। এগুলোকে এক সঙ্গে সিয়াহ ছিত্তাহ বলা হয়। ইসলামের সকল স্কুল অব থট এ হাদিস গ্রন্থগুলো মেনে চলে। শরিয়াহ আইন বা বিধানের প্রধান ভিত্তি হলো কুরআন ও সুন্নাহ, যার মূলনীতি অপরিবর্তনীয় চিরকাল। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নিরিখে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শাস্তির বিধানে কিছুটা তারতম্য দেখা দেয়, যা ইসলামী শরিয়ার অনন্য সৌন্দর্য এবং অতি উচ্চতর মানবিকতার প্রকাশ।
শরিয়ত হলো গোটা মানব জাতির জন্য আল্লাহ তা’য়ালা প্রদত্ত এমন বিধান, যা বান্দার জন্য অত্যাবশ্যকীয় পালনীয়। জীবনে চলার পথের যাবতীয় প্রয়োজনের সমাধান দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমেই একজন মানুষ দুনিয়া ও পরকালীন জীবনে কল্যাণকামী হবেন। স্থান-কাল-পাত্র ও পরিস্থিতির ভিন্নতা এবং নিয়ত সমাজ ও পরিবেশের পরিবর্তনে ফাতওয়া তথা ফয়সালায় পরিবর্তন ঘটে। ফয়সালা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটি একটি মূলনীতি। যারা এই মূলনীতির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে অক্ষম তারা আল্লাহর আইনের ফয়সালার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভ্রান্তির শিকার হন। ইসলামী শরিয়ত সর্বতোভাবে মানুষের মঙ্গলকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামী শরিয়ত মানুষের অহেতুক কোনো কষ্টকে বৈধতা দেয়নি। কারণ ইসলামী শরিয়তের মূল ভিত্তিই হলো মানুষের জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধন। আল্লাহ তা’আলার প্রজ্ঞা, তাঁর কর্মকৌশল ও সর্বক্ষেত্রে সর্বকর্মে তাঁর অস্তিত্বের প্রতিফলন ও প্রমাণ নির্ণয় করা এবং আম্বিয়ায়ে কেরামের সততা প্রমাণ করার বিধানই হলো ইসলামী শরিয়ত। বস্তুত ইসলামী শরিয়ত ন্যায়, সমতা, দয়া, সহমর্মিতা, যুক্তি ও কল্যাণের মূর্ত প্রতীক। এ কারণে যেসব বিষয় ন্যায়ের পরিবর্তে অন্যায়, ইনসাফের পরিবর্তে জুলুম, উদারতার বিপরীতে কঠোরতা, সহজের পরিবর্তে জটিল, কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ, যুক্তির পরিবর্তে অযৌক্তিক এবং সহজ হওয়ার পরিবর্তে কঠিন বলে বিবেচিত হয়, তা কখনো শরিয়তের আইন হতে পারে না। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যুক্তি দিয়ে তাকে যতোই সঠিক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হোক। বিশ্ব বিখ্যাত স্কলার আল্লামা ইবনে কাইয়েমের (র.) জগৎ বিখ্যাত কিতাব “ই’লামুল মু’কিঈন”-এ সংক্রান্ত বিষদ আলোচনা করা হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দ্বীনি কল্যাণ ও প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে শরিয়তের ফয়সালাতে শর্তাধীন পরিবর্তন ঘটে থাকে। ইবনে কাইয়েম বিষয়টির ওপর নবী করিম (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, আয়েম্মায়ে মুজতাহিদীনের সিদ্ধান্ত ও মতামত সবিস্তারে দলিলসহ বিশ্লেষণ করেছেন।
ইসলামী শরিয়ত এমন এক রাজপথ যে পথের যাত্রী নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। জগতের সকল সৌন্দর্য ও কল্যাণ ইসলামী শরিয়ত থেকেই উৎসারিত ও প্লাবিত। জগতের সকল মন্দ ও খারাপ ইসলামী শরিয়ত অনুসরণ না করার ফসল। ইসলামী শরিয়ত দৃষ্টিনন্দিত, হৃদয়ের সঞ্জীবনী ও অন্তরের প্রশান্তি। ইসলামী শরিয়ত আল্লাহ প্রদত্ত এমন একটি নূর যা থেকে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা পথের দিশা পেয়েছেন। কুরআন ও সুন্নাহ এমন একটি প্রদীপ, যার দ্বারা সত্য সন্ধানী লোকেরা গন্তব্য খুঁজে পেয়েছেন। ইসলামী শরিয়ত মানব জাতির জন্য এমন এক পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা সকল যন্ত্রণাক্লিষ্ট পীড়া নিরাময় করে। আল্লাহ তায়ালা যখন পাপ পঙ্কিলময় পৃথিবীর মানুষকে ধ্বংস করে দেওয়ার ইচ্ছা করবেন তখন দুনিয়া থেকে ইসলামী শরিয়তের সকল নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। বস্তুত নবী করিম (সা.) যে শরিয়ত নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন তা সকল সৃষ্টি জগতের জন্যে কল্যাণের ভিত্তি এবং জীবন জীবিকা ও সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। ইসলামী শরিয়তের এসব নিদর্শন ও আদর্শ যদি জগতে প্রতিফলিত ও বাস্তবায়িত না হতো তাহলে জগৎ আজ অসভ্যতার অন্ধকারে তলিয়ে যেত। ইসলামী শরিয়ত যেহেতু মানবতার রক্ষা ও সৃষ্টি জগতের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্যে প্রণীত তাই এই শরিয়তের মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালা আসমান জমিনকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছেন। ইসলামী শরিয়তের নিদর্শন যদি অবশিষ্ট না থাকত তাহলে জগতের সভ্যতা বিগড়ে যেত এবং জগতের সব কিছু ওলটপালট হয়ে যেত। জীবন জীবিকা, সম্মান, ইজ্জত, মানসম্ভ্রম, শান্তি, নিরাপত্তা, আহার, ওষুধ রোগের প্রতিকার ব্যবস্থাও ইসলামী শরিয়তের অবদান।
আল্লাহর কাছে অবশ্যই অপরাধ ঘৃণ্য কাজ এবং অপরাধী আল্লাহর গজব ও শান্তির পাত্র। অপরাধ দমনকে রাসুল (সা.) মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বলে অভিহিত করেছেন। যাতে অপরাধ দমন করে সমাজে সৎ ও সততা বলিষ্ঠ হয় এবং কল্যাণের বার্তাবহ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়। সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-এর কাছে অন্যায় অপরাধে জড়িত শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি চাইলেন। যেমন- কোন শাসক বা বড় ধরনের কর্মকর্তা যথারীতি নামাজের প্রতি যত্নবান ছিলেন না। নামাজের ব্যাপারে তাদের মধ্যে মারাত্মক ধরনের গাফিলতি দেখা দিয়েছিল। রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে ক্ষমতাধর এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘না, তোমরা নামাজে গাফিলতি করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দমনমূলক ব্যবস্থা নিবে না, যতক্ষণ তারা সকল ওয়াক্তের নামাজ আদায় করে। ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত বড় ধরনের গোলযোগ এবং মুসলমানদের পারস্পরিক বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষগুলোর পূর্বাপর ঘটনা যদি কেউ নিরাবেগ মেজাজে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন, তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন, উল্লেখিত মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে এবং অন্যায় অপরাধের ক্ষেত্রে অধৈর্য, অসহিষ্ণুতার ফলেই সমূহ বিশৃঙ্খলা ও গণ্ডগোল সংঘটিত হয়েছে। যারা শাসক ও ক্ষমতাসীনদের অন্যায় অপরাধে অধৈর্য হয়ে সেগুলো নির্মূল করতে সংঘর্ষের পথ অবলম্বন করেছিলেন, দেখা গেছে তাতে অন্যায় অপরাধ অবদমিত না হয়ে আরও দুর্দমনীয় রূপ ধারণ করেছে। আগের অন্যায়কে ছাপিয়ে গেছে দমননীতি প্রয়োগের পরবর্তী অপরাধ।
হিজরতের আগে মক্কায় নবী করিম (সা.)-এর চোখের সামনে মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হতো। কিন্তু তখন এগুলো দমনের মতো শক্তি নবীজীর (সা.) ছিল না। চোখের সামনে অন্যায় অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেও নবীজী (সা.) নীরব ভূমিকা পালন করতেন। আল্লাহর কুদরতে যখন মক্কা বিজয়ের ঘটনা ঘটে গেল, নবীজীর কর্তৃত্বে নীত হলো মক্কা নগরী, কাফের শাসিত মক্কা মুসলমানদের শাসনাধীন চলে এলো তখন কাবা গৃহ সংস্কার করে নবীজী ইব্রাহীম (আ.)-এর মূল কাঠামোয় ফিরিয়ে আনার সংকল্প করলেন। কিন্তু সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নবী (সা.) পরবর্তীতে ব্যাপক সংস্কার পরিকল্পনা মূলতবি করে দিলেন এই কারণে যে, সদ্য ইসলামে দীক্ষা নেওয়া মক্কার মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘদিনের কাবার অবকাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন বিরূপতা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ইব্রাহীমী কাঠামো বিনষ্ট হওয়ার কারণে কাবা শরিফের বর্তমান ত্রুটির চেয়েও আরও বেশি ত্রুটি-বিচ্যুতি জন্ম নেবে। এই মূলনীতির ভিত্তিতেই নবীজী অন্যায় ও অপরাধে জড়িত শাসক, ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেননি।
অপরাধ প্রবণ কতিপয় লোককে যদি কেউ জুয়া খেলায় লিপ্ত থাকতে দেখে, আর তাদেরকে জুয়ার আড্ডা থেকে তুলে এনে শরিয়ত সম্মত খেলাধুলা যেমন- তরবারি চালনা, ঘোড়া চালনা, কিংবা শারীরিক ব্যায়াম, কারাতে ইত্যাদির মতো খেলায় লিপ্ত করতে পারে তাহলে খুবই ভালো। নয়তো অপরাধ প্রবণ এই লোকগুলোকে তাদের অপরাধ কর্মে বাধা দেয়া হবে আইন ও বুদ্ধি বিবেচনার দৃষ্টিতে চিন্তার দীনতার প্রতিফলন। অনুরূপ কেউ যদি কোথায়ও কিছু লোককে অবৈধ খেলাধুলায় লিপ্ত থাকতে দেখে অথবা অশ্লীল নৃত্য সংগীতের আড্ডা জমাতে দেখে এবং এদেরকে যদি কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে এনে বৈধ ও ভালো কাজে লিপ্ত করতে পারে তবে সেটি হবে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু তাদের কাজে বাধা দিয়ে কেউ যদি তাদের ভালো কাজে লিপ্ত করতে না পারে তবে তাদের কাজে বাধা না দেওয়াই হবে উত্তম। কেন না বাধা দেওয়া হবে তাদের আগের চেয়ে মারাত্মক অপরাধের দিকে ঠেলে দেওয়া। কারণ একটি লঘু অপরাধে লিপ্ত থাকার কারণে তাদের দ্বারা আরো মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অবকাশ ছিল না। সেই অপরাধ কর্মে বাধা দিয়ে তাদের ভালো কাজে লিপ্ত করতে না পারাটা হবে আরও জঘন্যতম অপরাধের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। যে কোনো অপরাধ দমনের কতিপয় আপেক্ষিক দিক রয়েছে। যেমন-
১. অন্যায়, অপরাধ নির্মূল করে সে ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।
২. অন্যায়, অপরাধ সম্পূর্ণ নির্মূল সম্ভাব না হলেও অপরাধের ব্যাপকতা হ্রাস করা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা।
৩. একটি অপরাধ নির্মূল করতে গিয়ে আরেকটি অপরাধের জন্ম দেওয়া।
৪. একটি অপরাধ দমন করার কারণে এর চেয়েও আরও মারাত্মক অপরাধের আবির্ভাব ঘটা।
উল্লেখিত চার শ্রেণির দমন কার্যক্রমের প্রথম দুটি পর্যায়ের দমন কার্যক্রম পরিচালনা করা শরিয়তের দাবি। তৃতীয় পর্যায়ের দমন ব্যবস্থাটি বিবেচনা সাপেক্ষ। অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনার পর যদি বিষয়টি আমলযোগ্য বিবেচিত হয় তাহলে দমন তৎপরতা চালানো যাবে। কিন্তু চতুর্থ পর্যায়ের অপরাধ দমন তৎপরতা কিছুতেই চালানো যাবে না। ইসলামী শরিয়তের নিগড়েই রয়েছে মানব জাতির অমীয় কল্যাণ।
লেখক : সাংবাদিক
প্যানেল