ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছেই

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনা-ডেঙ্গু

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:০২, ২০ জুন ২০২৫

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনা-ডেঙ্গু

রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনা ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত করোনায় ৮ জন এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩০ জন মারা গেছেন। আক্রান্ত করোনায় ৩৩১ জন এবং ডেঙ্গুতে ছয় হাজার ৯২৬ জন। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে।
ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত ৩০ মৃত্যু ॥ চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ৯২৬ জন। বৃহস্পতিবার আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪৮ ডেঙ্গুরোগী। তাদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু না হলেও চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩০ জন মারা গেছেন।

এ ছাড়া ২০২৩ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৫৭৫ জনের এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৬ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছরে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মোট ছাড়পত্র পেয়েছেন ছয় হাজার ১০৩ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১০৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৮ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩৫ জন, রাজশাহী বিভাগের (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৮ জন, খুলনা বিভাগ (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪ জন এবং রংপুর বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩ জন রয়েছেন।
ডেঙ্গুজনিত প্রাণহানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে ॥ ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগাম প্রস্তুতি বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, চার জেলায় বেশি এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। এই লার্ভা থেকে ডেঙ্গু মশা যেন তৈরি না হয় এজন্য এডিস মশা নিধন কর্মসূচি নিতে পারে সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার বিভাগ। কীটতত্ত্ববিদ ওষুধের পরিবর্তন আনতে পারেন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। তবে সচেতনতার জায়গাতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

সবাইকে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে বেশি মারা যাচ্ছে। রোগীর চিকিৎসার বিষয়ে আমরা নতুন করে গাইডলাইন করে দিয়েছি। দুঃখজনক হলেও সত্য ডেঙ্গুতে প্রাণহানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে। মৃত্যু কমাতে হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেহেতু স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব তারপরও স্বাস্থ্য বিভাগের তাদের সঙ্গে সমন্বয় থাকা উচিত। তবে সবার আগে দরকার গণসচেতনতা।

সংক্রমণ বাড়লেও প্রতিরোধ দুর্বল ॥ চলতি বছর রাজধানীর চেয়ে বাইরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনেক বেশি। দেশের মোট আক্রান্তের ২৫ শতাংশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। বিভাগের হিসাবে সর্বোচ্চ সংক্রমণ বরিশাল বিভাগে, ১ হাজার ৯৯৪ জন। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে গত বছর এ সময় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬০২, এ বছর ৭৭৭। উত্তরে সংখ্যা ছিল ৪৩৮, এবার ৪৬৯। ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো বাড়তে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রস্তুতি আছে।

বাজেটও আছে। ঈদের ছুটির জন্য তৎপরতা বন্ধ ছিল। আবার তা জোরেশোরে শুরু হবে।’ তবে মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনগুলোর তৎপরতায় খুব আশা দেখছেন না কীটতত্ত্বববিদরা। তাদের মতে, বর্তমানে রোগীর সংখ্যা এবং মশার বিস্তার বলে দিচ্ছে, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো মোটেও সক্রিয় নয়। আগে তা-ও কিছু কাজ চোখে পড়ত, এখন নেই। এখন পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে।
চলতি আবহাওয়া এডিস মশার উপযোগী ॥ ঈদুল আজহার ছুটির আগের দুই সপ্তাহ ধরে চলা তাদের জরিপে দেখা যায়, প্রতি ১৫টি বাড়ির মধ্যে ৭ থেকে ৮টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট পাওয়া গেছে। এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। লার্ভা জরিপে যে বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটি হলো লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ করা। এ ক্ষেত্রে স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। যদি এই ইনডেক্সের পরিমাণ ২০-এর বেশি হয়, তবে তা আশঙ্কাজনক বলে বিবেচিত হয়।

এখন এই জরিপ অনুযায়ী, ব্রুটো ইনডেক্সের হার ৫০-৬০। এই জরিপের নেতৃত্ব দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এবার এডিস মশার বংশবৃদ্ধির হার মারাত্মক। মশা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে। এখনকার আবহাওয়া পরিস্থিতি বড় সংক্রমণের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার ভ্যাপসা গরম। এটা ডেঙ্গুর এডিস মশা বৃদ্ধির একেবারে আদর্শ অবস্থা।
রাজধানীর ৫৯ ভাগ ভবনে     লার্ভা ॥ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন এক জরিপের তথ্য তুলে ধরে জানান, রাজধানী ঢাকার ৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বহুতল ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। গত বছর মে মাসে প্রকাশিত জরিপে এই হার ছিল ৪২ শতাংশ। এক বছরে বহুতল ভবনে এডিস মশার লার্ভা বেড়েছে ১৬ শতাংশ। জরিপে বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ১৪৭টি বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ কর ৪৬৩ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।

সেই হিসাবে রাজধানীর ১৪ দশমিক ৭১ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার অস্তিত্ব রয়েছে। এবার বহুতল ভবনে এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে, রাজধানী ঢাকার ৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বহুতল ভবনে লার্ভা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নির্মাণাধীন ভবন ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আলাদ ভবন, আধাপাকা ভবনে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ, পরিত্যক্ত ভবনে ২ দশমিক ৮ শতাংশ এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে।
ঝুঁকিতে ঢাকার ১৩ ওয়ার্ড ॥ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার দুই সিটির ১৩টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এলাকাগুলোতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদ-ের থেকেও বেশি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো- ১২, ২, ৮, ৩৪, ১৩, ২২নং ওয়ার্ড। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো- ৩১, ৪১, ৩, ৪৬, ৪৭, ৪, ২৩নং ওয়ার্ড।  

দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
অর্থ সংকটে ডেথ রিভিউ বন্ধ ॥ এদিকে অর্থ সংকটে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার কারণ পর্যালোচনা (ডেথ রিভিউ) বন্ধ আছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশীদ। বুধবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু রোগের বাহকের কীটতাত্ত্বিক জরিপ (২০২৪-২০২৫) প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা জানান।

অধ্যাপক মো. হালিমুর রশীদ বলেন, আমি আসার পর ডেথ রিভিউ শুরু করেছিলাম। গত বছর যারা মারা গেছেন, তার মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ১২৪ জন রোগীর ফাইল নিয়ে একটা কমিটি করেছিলাম। কমিটি করে আমরা অনেকগুলো মিটিং করে মোটামুটি একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়েছিলাম যে কী কী কারণে মৃত্যু হচ্ছে। তো আর আমি আগাতে পারিনি। কারণ বুঝতে পারছেন, আমাকে যদি ৮-১০ জন লোকের একটা মিটিং করতে হয়, সেটা নিজের পকেট থেকে দিয়ে খুব বেশি কন্টিনিউ করা যায় না।
স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি ॥ এদিকে দেশের যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে সেসব এলাকায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি দেশে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বিশেষ করে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, বরিশাল, বরগুনাসহ যে সব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে মশক নিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ জরুরি।

এ ছাড়া, এ বিভাগের অধীন তৃণমূল পর্যায়ের কমিটিগুলোর মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক বার্তা প্রচার-প্রচারসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা অপরিহার্য। এসব বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে শূন্য পদে দ্রুত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা প্রয়োজন। এ অবস্থায় ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে উল্লিখিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগের সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে। আর এই বছরের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে একই এলাকায়। তাই ধারণা করা হচ্ছে, বরিশালের এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর হটস্পটে পরিণত হয়েছে।
করোনায় আক্রান্ত ৩৩১ মৃত্যু ৮ জন ॥ চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দেশে মোট করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৩১ জন। এ সময়ে মারা গেছেন ৮ জন। এদের অধিকাংশই চলতি জুন মাসে মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৮ জন। এদিন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সৌচাগারে পড়ে মনসুর রহমান নামে একজন করোনা রোগী মারা গেছেন।

চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট এক রিপোর্টে বলা হয়, করোনাকালে ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশে বাড়তি ৪ লাখ ১৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত সাড়ে পাঁচ বছরে মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫০২ জনের। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বারবার দাবি করেছে, সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ায় দেশে করোনায় মৃত্যু কম হয়েছে।
করোনার নয়া ধরন ॥ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) গবেষকেরা করোনার নতুন একটি ধরন শনাক্তের কথা বলছেন। এর নাম এক্সএফজি। এর পাশাপাশি এক্সএফসি ধরনটিও পাওয়া গেছে। দুটোই করোনার শক্তিশালী ধরন অমিক্রনের জেএন-১ ধরনের উপধরন। বাংলাদেশে নতুন ধরনের পাশাপাশি ভারতেও এনবি.১.৮.১ নামে একটি নতুন ধরনের বিস্তার দেখা যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গত ২৩ মে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, এনবি.১.৮.১ ধরন এখন ক্রমেই ছড়াচ্ছে। এর সংক্রমণের হারও বেশি। তবে করোনার আগের ধরনগুলোর চেয়ে এই ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি নয়। আইসিডিডিআরবির হেড অব ভাইরোলজি ল্যাবরেটরি মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে দেখছি। দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় সবাই নতুন একটি ধরন এক্সএফজিতে আক্রান্ত। এর পাশাপাশি এক্সএফসি ধরনটিও পাওয়া গেছে। দুটো করোনার শক্তিশালী ধরন অমিক্রনের জেএন-১ ধরনের উপধরন। 
সরকারি হিসাবে গরমিল ॥ আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা দাবি করছেন, করোনায় মৃত্যু নিয়ে সরকার যে সংখ্যা দিচ্ছে তা সঠিক নয়। মহামারি শুরুর সময় রোগ পরীক্ষার এবং চিকিৎসার সুযোগ কম ছিল। কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত অনেকের মৃত্যু বাড়িতে হয়েছে, অনেকের রোগ শনাক্ত হয়নি, অনেক ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়নি। অনেকে রোগ লুকিয়ে রেখেছিলেন, মৃত্যুর ঘটনাও জানাজানি হতে দেননি। অনেক ক্ষেত্রে লোকচক্ষুর অগোচরে মরদেহ কবর দেওয়া হয়েছে।

সরকারি হিসাবে আছে শুধু হাসপাতালে মৃত্যুর তথ্য। যারা হাসপাতালে আসেননি, যারা করোনার সব ধরনের উপসর্গ নিয়ে ভুগেছেন, তাদের মৃত্যু সরকারি পরিসংখ্যানে নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনাকালে মৃত্যু অনেক বেশি ছিল। ২০২২ সালের ১০ মার্চ বাড়তি মৃত্যুর অনুমিত সংখ্যা প্রকাশ করেছিল চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট।

এতে বলা হয়, করোনাকালে ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশে বাড়তি ৪ লাখ ১৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ২৯ হাজার ৫০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বারবার দাবি করেছে, সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ায় দেশে করোনায় মৃত্যু কম হয়েছে।
ভারতে না যাওয়ার পরামর্শ ॥ ভারতসহ কয়েকটি দেশে করোনার নতুন ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ওইসব দেশে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া না যাওয়ার বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংস্থার রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পক্ষ থেকে এই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। করোনার  ঝুঁকি মোকাবিলায় দেশের সব স্থল ও বিমানবন্দরে হেলথ স্ক্রিনিং ও নজরদারি বাড়াতেও বলা হয়েছে সেখানে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদের স্বাক্ষরে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে করোনার নতুন সাব ভেরিয়েন্ট, বিশেষ করে অমিক্রন এলএফ. ৭, এক্সএফজি, জেএন-১ এবং এনবি ১.৮.১ এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য সংক্রমণ প্রতিরোধে ভারত ও অন্য সংক্রামক দেশ এবং বাংলাদেশ থেকে ভারত এবং অন্য সংক্রামক দেশে ভ্রমণকারী নাগরিকদের জন্য দেশের সকল স্থল, নৌ, বিমানবন্দরের আইএইচআর ডেস্কে নজরদারি জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকি মোকাবিলায় কিছু কার্যক্রম নিতে হবে।’
উদ্বেগের পর্যায়ে নয়: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ॥ দেশে করোনা সংক্রমণ উদ্বেগের পর্যায়ে নয় বলে মনে করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের মতে, প্রতিবেশী তিনটি দেশে সংক্রমণ কিছুটা বেশি হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর সাংবাদিকদের বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ১৫৮ জন। আর জুন মাসের প্রথম ১০ দিনে শনাক্ত হয়েছেন ৫৪ জন।

এর অর্থ, সংক্রমণে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিডিসির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশীদ বলেন, থাইল্যান্ডে সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। ভারত ও মালয়েশিয়াতেও সংক্রমণ বাড়ছে। আইইডিসিআরের প্রতিনিধি জানান, দেশে এখন করোনার যে ধরন দেখা যাচ্ছে, তা অমিক্রন বা অমিক্রনের উপধরন। এর উপসর্গ তীব্র হতে দেখা যায়নি। তবে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই।
সংক্রমণ প্রতিরোধে কিছু নির্দেশনা ॥ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, সাতবার প্রয়োজনমতো সাবান দিয়ে হাত ধোবেন (অন্তত ২৩ সেকেন্ড), নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা, আক্রান্ত ব্যক্তি হতে কমপক্ষে ৩ ফুট দূরে থাকা, অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ না করা, হাঁচি-কাশির সময় বাহু/ টিস্যু/কাপড় দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখুন।

এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থল/নৌ/ বিমানবন্দর সমূহে আইএইচআর স্বাস্থ্য ডেস্ক সমূহে সতর্ক থাকা, হেলথ স্ক্রিনিং এবং সার্ভেল্যান্স জোরদার করা, দেশের পয়েন্টস অব এন্ট্রি সমূহে থার্মাল স্কান্যার/ ডিজিটাল হেন্ড হেল্ড থার্মোমিটারের মাধ্যমে নন টাচ টেকনিকে তাপমাত্রা নির্ণয় করা, চিকিৎসা কাজে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মাস্ক, গ্লাভস এবং রোগ প্রতিরোধী পোশাক মজুত রাখা, ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রোগ প্রতিরোধ নির্দেশনা সমূহ প্রচার করা এবং জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত ভারত ও অন্য আক্রান্ত দেশসমূহে ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
টিকা নেওয়ার পরামর্শ ॥ দেশে করোনার টিকা নেওয়ার আগ্রহ এখন তেমন দেখা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী বলছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র ৬৫ জন করোনার টিকা নিয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই বিদেশগামী যাত্রী। তারা আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে টিকা নিয়েছেন। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ করে বয়স্ক এবং জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের টিকা নেওয়া দরকার।

শুধু টিকা নেওয়া নয়, হাত ধোয়া ও মাস্ক পরার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এসব অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারের কাছে করোনার পর্যাপ্ত টিকা থাকলেও টিকা নিতে আগ্রহী খুব কম। করোনা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠায় টিকা দেওয়ার বিষয়টি সরকারও ভাবছে। ইপিআইয়ের এক সভায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

যেসব ব্যক্তি একটি ডোজ নিয়েছেন, তাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে ৬০ বছর বয়সী, ১৮ বছরের বেশি বয়সী অল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী, স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের টিকার আওতায় আনার কথাও বলা বলা হয়েছে।

×